হঠাৎ করেই দেশের পাঁচটি শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অস্থিরতা বিরাজ করছে। বিভিন্ন দাবির আন্দোলন, ছাত্র সংসদ নির্বাচন ও সংঘর্ষের জেরে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে একাডেমিক অবস্থা প্রায় অকার্যকর হয়ে পড়েছে। যার মধ্যে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়া ছাত্র সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস উত্তপ্ত রয়েছে। আর স্থানীয়দের সঙ্গে সংঘর্ষে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
অন্যদিকে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ (বুয়েট) চারটি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে রোববার পর্যন্ত ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি পালিত হয়েছে। এই কর্মসূচি প্রত্যাহার করলেও আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
রোববার (৩১ আগস্ট) কম্বাইন্ড ডিগ্রির দাবিতে আন্দোলনরত বিশ্ববিদ্যালয়ের পশুপালন ও ভেটেরিনারি অনুষদের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায় একদল বহিরাগত। রাত পৌনে আটটার দিকে এ হামলার ঘটনা ঘটে। কম্বাইন্ড ডিগ্রির দাবি পূরণ না হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যসহ দুই শতাধিক শিক্ষককে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন মিলনায়তনে বেলা ১টা থেকে অবরুদ্ধ করে তালা ঝুলিয়ে আন্দোলন করছিলেন ওই শিক্ষার্থীরা।
রাতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা করছিলেন ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক মুফিদুল আলম এবং অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা) সৈয়দ শাহনেওয়াজ মোর্শেদ অপু। এ সময় শিক্ষার্থীদের ওপর লাঠি হাতে হামলা চালায় একদল ব্যক্তি। শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করে তারা শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন মিলনায়তনের তালা খুলে অবরুদ্ধ শিক্ষকদের বের করে দেয়।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের পশুপালন ও ভেটেরিনারি অনুষদের শিক্ষার্থীদের ‘কম্বাইন্ড ডিগ্রি’র (বিএসসি ইন ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল হাজবেন্ড্রি) দাবিতে চলমান আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে রোববার বেলা ১১টায় একাডেমিক কাউন্সিলের সভা হয়। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন মিলনায়তনে এ সভায় কম্বাইন্ড ডিগ্রি চালুর পাশাপাশি পশুপালন ও ভেটেরিনারি ডিগ্রিও চালু রাখার সিদ্ধান্ত হয়। তবে মোট তিনটি ডিগ্রি চালু রাখার সিদ্ধান্ত মানতে নারাজ পশুপালন ও ভেটেরিনারি অনুষদের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা।
একাডেমিক কাউন্সিলের সভায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সব অনুষদের দুই শতাধিক শিক্ষক অংশ নেন। সভা শেষে তিন ডিগ্রির সিদ্ধান্ত ঘোষণা দেওয়া হলে ‘এক পেশায় এক ডিগ্রির (কম্বাইন্ড ডিগ্রি)’ দাবিতে মিলনায়তনে তালা ঝুলিয়ে দেন আন্দোলনকারীরা। এতে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক এ কে ফজলুল হক ভূঁইয়াসহ অন্য শিক্ষকেরা।
পরবর্তী সময়ে রাত সাড়ে ৯টায় অনলাইনে জরুরি সিন্ডিকেট সভা হয়। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়। শিক্ষার্থীদের সোমবার (১ সেপ্টেম্বর) সকাল ৯টার মধ্যে হল ত্যাগের নির্দেশ দেওয়া হয়। ইতোমধ্যে শিক্ষার্থীরা হল ছেড়ে গেছেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
গত শনিবার (৩০ আগস্ট) রাত ১১টার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষের এক নারী শিক্ষার্থী ২ নম্বর গেট এলাকার কাঁচাবাজার সংলগ্ন ভাড়া বাসায় প্রবেশ করতে গেলে রাত ১১টার পর বাসায় ঢুকতে পারবে না বলে বাধা দেওয়া হয়। এ সময় দারোয়ানের সঙ্গে ছাত্রীর বাকবিতণ্ডার একপর্যায়ে তাদের মধ্যে হাতাহাতি হয়। এ সময় দারোয়ান নারী শিক্ষার্থীর গায়ে আঘাত করেন।
খবর পেয়ে কয়েকজন শিক্ষার্থী এগিয়ে এলে স্থানীয়রা দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তাদের ওপর হামলা চালায়। এ সময় মসজিদের মাইক ব্যবহার করে স্থানীয়রা আরও লোকজন জড়ো করে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর চারদিক থেকে হামলা চালায়। এতে টানা চার ঘণ্টা ক্যাম্পাসে উত্তেজনা বিরাজ করে। ওই ঘটনায় শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হন। এর মধ্যে অন্তত ১৫ জনকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।
এরপর রোববার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে রাতের ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই স্থানীয়রা আসিফ ভিলা নামক এক বাসায় অবস্থানরত কয়েকজন শিক্ষার্থীকে অবরুদ্ধ করে রাখে। খবর ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে পড়লে শিক্ষার্থীরা তাদের উদ্ধারে গেলে স্থানীয়দের সঙ্গে আবারো সংঘর্ষ হয়। স্থানীয়রা দেশীয় অস্ত্র, ইট-পাটকেল নিয়ে আক্রমণ চালায়। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য ও প্রক্টরসহ পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হন। সংঘর্ষ থামার পর সেখানে অভিযানে নামে যৌথবাহিনী।
রোববার বিকেল সাড়ে ৩টায় হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মুমিন সই করা বিজ্ঞপ্তিতে ১৪৪ ধারা চালু হলে এর প্রায় ৩০ মিনিট পরে ঘটনাস্থলে আসেন যৌথবাহিনীর সদস্যরা।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদল বেশ কিছুদিন দিন ধরে পাঁচ দফা দাবি জানিয়ে আন্দোলন করে আসছে। অন্য দাবিগুলো নির্বাচন কমিশন মেনে নেওয়ার আশ্বাস দিলেও প্রথম বর্ষের নবীন শিক্ষার্থীদের ভোটাধিকারের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। নবীন শিক্ষার্থীদের ভোটাধিকারের দাবিতে এর আগেও তারা দুই দিন বিক্ষোভ ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছে। একই দাবিতে রোববার মনোনয়ন ফরম বিতরণের শেষ দিনে ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা সকাল থেকে কোষাধ্যক্ষের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেন।
এদিন সকালে রাকসুর কোষাধ্যক্ষ কার্যালয়ের সামনে বারান্দায় রাখা একটি চেয়ার ভাঙচুর করেন তারা। এ সময় একটি বড় টেবিলও ফেলে দেওয়া হয়। পরে রাকসু ভবনের ফটকে তালা ঝুলিয়ে দেন তারা। এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচনের মনোনয়নপত্র বিতরণ বন্ধ হয়ে যায়।
সংগঠনটির সভাপতি সুলতান আহমেদ (রাহী) বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ইচ্ছাকৃতভাবে প্রথম বর্ষের প্রায় চার হাজার শিক্ষার্থীকে ভোটার তালিকা থেকে বাদ দিয়েছে। ভর্তি প্রক্রিয়া ও ক্লাস শুরুর তারিখ বারবার পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে শুধু নবীন শিক্ষার্থীদের ভোটাধিকার থেকে দূরে রাখতে। আমরা লক্ষ করছি, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ধীরগতিতে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের কার্যক্রম চালাচ্ছে, যা স্পষ্টতই একটি ষড়যন্ত্রের অংশ।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনকে কেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি কিছুটা অস্থির। এরমধ্যে রোববার সকালে ডাকসু নির্বাচনে এস এম ফরহাদের প্রার্থিতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় রিটটি দায়ের করেন বামজোট সমর্থিত প্যানেলের মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন বিষয়ক সম্পাদক প্রার্থী বিএম ফাহমিদা আলম।
রিট আবেদনে বলা হয়েছে, আগে ছাত্রলীগের কমিটিতে ছিলেন ফরহাদ। এরপরও তিনি কীভাবে ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্যানেলে প্রার্থী হলেন এমন প্রশ্ন তুলে তার প্রার্থিতা চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে।
রিটের শুনানির জন্য আগামীকাল মঙ্গলবার (২ সেপ্টেম্বর) দিন ধার্য করেছেন আদালত। বিচারপতি এস কে তাহসিন আলী ও হাবিবুল গণির সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে এর শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে।
আরও পড়ুন
ডাকসু নির্বাচনে নতুন ৪ সিদ্ধান্ত
এছাড়া রুমমেটকে ছুরিকাঘাতের অভিযোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে স্বতন্ত্র ভিপি প্রার্থী জালাল আহমদ জালালকে হল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। গত মঙ্গলবার মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহাম্মদ মুহসীন হলে এ ঘটনা ঘটে। আহত রবিউল হক ২০১৮-১৯ সেশনের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী।
বুয়েট ও অন্যান্য প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়
সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রকৌশল শিক্ষার্থীদের তিন দফা দাবিতে ডাকা ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি প্রত্যাহার করা হয়েছে। তবে দাবি আদায়ে নিয়মতান্ত্রিক কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন তারা।
রোববার রাত সাড়ে নয়টার দিকে প্রকৌশলী অধিকার আন্দোলনের সভাপতি ওয়ালি উল্লাহ এই তথ্য নিশ্চিত করেন। এর আগে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে তারা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন। আলোচনা শেষে শাটডাউন কর্মসূচি প্রত্যাহার করার কথা জানান তিনি।
প্রকৌশলী অধিকার আন্দোলনের সভাপতি ওয়ালি উল্লাহ বলেন, সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আমরা কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নিচ্ছি। তবে নিয়মতান্ত্রিক কর্মসূচি চলবে।
এএসএল/জেবি

