শনিবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

লক্ষ্য থেকে দূরে সরে গেছে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়!

রাকিব রিফাত, ইবি
প্রকাশিত: ৩১ জানুয়ারি ২০২৫, ০৫:৪৪ পিএম

শেয়ার করুন:

লক্ষ্য থেকে দূরে সরে গেছে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়!
ইসলামের সব ছাপ মুছে ফেলে আওয়ামী লীগ। ছবি: সংগৃহীত

কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৭৯ সালে। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ইসলামিক ও আধুনিক শিক্ষার সংমিশ্রণ ঘটানোর লক্ষ্যে এটি প্রতিষ্ঠা করেন। শুরুতে এটা ওআইসি নিয়ন্ত্রিত আন্তর্জাতিক ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার কথা থাকলেও নানা প্রতিকূলতায় সেটা হয়ে ওঠেনি। প্রতিষ্ঠার ৪৫ বছর পেরিয়েও মূল লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয়টি।

দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্পূর্ণ আলাদা আদলে গঠিত ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু একাডেমিক ত্রুটির কারণে সে লক্ষ্য থেকে দূরে সরে এসেছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। মুসলিম বিশ্বের সব ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কারিকুলাম ইসলামিক কনসেপ্টের ওপর লক্ষ্য করে তৈরি করা হয়। কিন্তু ইবির ধর্মতত্ত্ব অনুষদের বিভাগগুলো ছাড়া অন্য কোনো বিভাগে এই বিষয়টি আমলে নেওয়া হয় না। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ব্যাকগ্রাউন্ড  ইসলামিক স্টাডিজ কোর্স আছে। এই বিষয়ে  দক্ষ শিক্ষক ছাড়াই ইচ্ছে মতো পড়ানো হয়। এমনকি হিন্দু শিক্ষক দিয়েও ইসলামিক স্টাডিজ পড়ানোর ইতিহাস রয়েছে। যার ফলে ইসলাম সম্পর্কে না জানা গ্র্যাজুয়েট বের হয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ ইসলামিক স্কলারদের।


বিজ্ঞাপন


ইবির নতুন ভিসি প্রফেসর ড. নকীব মোহাম্মদ নসরুল্লাহ ঢাকা মেইলকে বলেন, শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান আন্তর্জাতিক পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ইসলামিক ও আধুনিক শিক্ষার সংমিশ্রণ ঘটানোর লক্ষ্যেই এই বিশ্ববিদ্যালয়টি স্থাপন করেছিলেন। আমরা সে লক্ষ্য বাস্তবায়নে কাজ করছি। কখনো মনে করি না আমি ভিসি, আমি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সেবক। আল্লাহর পক্ষের সিলেকশনে আমি এই বিশ্ববিদ্যালয়টিতে এসেছি।

আরও পড়ুন

৪৬ বছরে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়: শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি

সূত্র জানায়, যে লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা লাভ করে প্রথম ভিসি ড. মমতাজ উদ্দিন সে লক্ষ্যেই কাজ করেন। পরবর্তী সময়ে তাকে অপসারণের পর ১৯৮৮ সালে প্রফেসর ড. সিরাজুল ইসলামকে ভিসি নিযুক্ত করা হয়। এসময় তিনি সেক্যুলার ঘরানার প্রফেসর ড. হায়াৎ মাহমুদকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেন। এরপর তিনি একসাথে পাঁচটি নতুন বিভাগ খোলেন (আরবি, বাংলা, ইংরেজি, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি, রাষ্টনীতি ও লোকপ্রশাসন) যেখানে ইসলামিক কোনো বিভাগ ছিল না। ১৯৯২ সালে সাবেক ভিসি প্রফেসর ড. হামিদুর রহমান ইবিতে যখন ইসলামাইজেশনের জন্য ব্যাকগ্রাউন্ড ইসলামিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করেন তখন নানামুখী বিরোধিতার ফলে এটি আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি।

EB2


বিজ্ঞাপন


জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়টিকে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত করতে টানা প্রায় সাড়ে ১৫ বছর ক্ষমতা ধরে রাখা আওয়ামী লীগ বিরামহীনভাবে কাজ করেছে। ফ্যাসিবাদী কায়দায় ধর্মনিরপেক্ষতার ধাঁচে বিশ্ববিদ্যালয় চালাতে একচেটিয়া দলীয় লোক নিয়োগ দেওয়া হয়। আওয়ামী শক্তি ইবি ক্যাম্পাসে নিয়োগ বাণিজ্য, দুর্নীতি, সংঘাত, সংঘর্ষ, বন্দুকযুদ্ধ, টেন্ডারবাজি, ছিনতাই, অশ্লীলতা, শ্লীলতাহানি, হরতাল অবরোধ, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, পুলিশি রাজত্ব, চুরি ও লুটপাটের স্বর্গরাজ্যে পরিণত করে বলে অভিযোগ রয়েছে। অবশিষ্ট ইসলামি ঐতিহ্যটুকুও নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে ক্যাম্পাসে জাতীয়তাবাদী ও ইসলামপন্থীদের ওপর বিভিন্ন ধরনের হয়রানি ও নির্যাতন চালানো হয় বলে অভিযোগ করেছেন বিরোধীরা।

সূত্র জানিয়েছে, থিওলজি অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের অধীনে ছিল 'ল অ্যান্ড শরিয়াহ'। পরবর্তী সময়ে ‘শরিয়াহ’ শব্দটি ফেলে দিয়ে শুধু 'ল' করা হয়। এদিকে বিভিন্ন সময়ে ধাপে ধাপে আটটি অনুষদ এবং মোট ৩৬টি বিভাগ খোলা হয়েছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল চেতনা একটিও ইসলামিক কোনো বিভাগ খোলা হয়নি। যদিও প্রথম দিন থেকেই  বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্গানোগ্রামে থাকা ‘তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব’ নামের অনুষদ বাস্তবায়ন করেননি বিগত ভিসিরা।

তবে দীর্ঘ ৪৫ বছরের অপেক্ষার অবসান ঘটাতে গত ২৯ জানুয়ারি একাডেমিক কাউন্সিলে বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন প্রশাসন এই অনুষদ খোলার উদ্যোগ নিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছেন। যেখানে ডিন হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন ভিসি প্রফেসর ড. নকীব মোহাম্মদ নসরুল্লাহ।

আরও পড়ুন

জাহাঙ্গীরনগর মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘মুসলিম’ শব্দ বাদ গেল যেভাবে

জানা গেছে, সবার দাবির মুখে প্রফেসর ড. রফিকুল ইসলাম আল-ফিকহ বিভাগ খোলেন। প্রফেসর আলাউদ্দিন সেটিকে আল-ফিকহ অ্যান্ড জাস্টিস করেন। সেখানে ধর্মতত্ত্ব অনুষদের বিভাগগুলোতে, আরবি ও আল-ফিকহ বিভাগে মাদরাসা ছাত্রদের জন্য বাধ্যতামূলক ছিল। পরে সাবেক ভিসি প্রফেসর ড. রাশিদ আসকারী আরবি ভাষা ও সাহিত্য ও আল-ফিকহ বিভাগ থেকে এটি উঠিয়ে দেন। পরবর্তী সময়ে সাবেক ভিসি আব্দুস সালামের সময় আরবি বিভাগ ধর্মতত্ত্ব অনুষদের অধীনে ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণ শুরু করে।

আরও জানা গেছে, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়কে ফ্যাসিবাদী আদলে পরিচালন এবং এটি ধ্বংসের নীলনকশা করেন সাবেক ভিসি প্রফেসর ড. আসকারী। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল অর্গানোগ্রামে না থাকলেও ফাইন আর্টসসহ বেশ কিছু বিভাগ দ্রুততার সঙ্গে খুলে দেন। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্গানোগ্রামে থাকা পূর্ব অনুমোদিত বিভাগগুলোকে পাশ কাটিয়ে বিশেষ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের পথে হাঁটেন তিনি। এই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন প্রকল্পে দুর্নীতি, শিক্ষক নিয়োগ বাণিজ্যসহ নানা অপকর্মে তিনি জড়িয়ে পড়েন। সদ্যবিদায়ী ভিসি আব্দুস সালামও দুটি বিভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্গানোগ্রামের বাইরে গিয়ে খোলেন। কিন্তু অর্গানোগ্রামে থাকা ইসলামিক কোনো বিভাগ খোলা হয়নি।

EB3

বিগত আওয়ামী শাসনামলে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক কর্মকর্তা কর্মচারী নিয়োগে ইসলামিক কোনো বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া হতো না। যে কারণে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এই বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সেই উদ্দেশ্য অধরাই রয়ে গেছে। ইসলামি আদর্শ চিন্তা চেতনার বিরুদ্ধে গিয়েও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েছেন, অধ্যাপনা করছেন, এমনকি অবসরেও গিয়েছেন। ছাত্রদের ইসলামিক দিকনির্দেশনা দেওয়ার প্রশ্নই ছিল না।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুতে আন্তর্জাতিক ইসলামিক সংস্থা ওআইসি এই বিশ্ববিদ্যালয়কে নানা সহযোগিতা করলেও পরবর্তী সময়ে তাদের শর্ত পূরণ না করায় আর্থিক সহযোগিতা বন্ধ করে দেয়।

সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, বর্ষবরণ, একুশে বইমেলা, বৈশাখী উৎসব, ভ্যালেন্টাইনস ডে ইত্যাদি উদযাপনে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষকের অতিআগ্রহী ও সানন্দে উপস্থিতি পরিলক্ষিত হলেও ঈদে মিলাদুন্নবীসহ বিভিন্ন ইসলামি উৎসব বা অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে বিগত কর্তাব্যক্তিদের অবজ্ঞা, অবহেলা ও দায়সারা মনোভাব ছিল চোখে পড়ার মতো। এছাড়াও ক্যাম্পাসের ইসলামপন্থী শিক্ষকদের প্রশাসনিক দায়িত্ব, প্রমোশন ও বিভিন্ন সুযোগ সুবিধার ক্ষেত্রে নিগৃহীত হন বলে এসব অভিযোগ করেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।

আরও পড়ুন

ইবির কেন্দ্রীয় মসজিদের নির্মাণ: ২৮ বছর পরেও ৫০ শতাংশ কাজ বাকি!

১৯৮০ সালের ২০ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদ কর্তৃক ১৯৮০ সালের ৩১নং আইন পাসের পর ইসলামি শিক্ষা ও গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। ইনস্টিটিউট অব ইসলামিক এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার ১৯৮২ সালের অধ্যাদেশ নং-৪৩ জারি করে বিলুপ্ত করা হয়। পরবর্তী সময়ে এটি ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ন্যস্ত করা হয়। দীর্ঘ আওয়ামী দুঃশাসন এটিকে একেবারে ভিন্ন খাতের দিকে পরিচালনা করে। এর অধীনে বর্তমান কয়েকটি কোর্স চালু আছে৷ আগে কিছু গবেষণা জার্নাল প্রকাশ হলেও বর্তমানে সেটিও বন্ধ রয়েছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী এই ইনস্টিটিউট সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

শিক্ষার্থীদের দাবি, ইসলামি শিক্ষার সাথে অন্যান্য আধুনিক শিক্ষার সমন্বয়ের যে লক্ষ্যে ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা থেকে লক্ষ্যচ্যুত হয়েছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী নতুন বাংলাদেশ ইবি তার মূল লক্ষ্যে এগিয়ে যাক, এমনটাই  প্রত্যাশা করেন তারা।

প্রতিনিধি/জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর