শনিবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

অটোমেশনে ভর্তি: বেসরকারি মেডিকেলে পড়ায় আগ্রহ কমছে শিক্ষার্থীদের

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০৯ পিএম

শেয়ার করুন:

‘অটোমেশনে ভর্তি’তে বেসরকারি মেডিকেলে পড়ায় আগ্রহ কমছে শিক্ষার্থীদের
ফাইল ছবি

বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির ক্ষেত্রে অটোমেশন বা স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি চালু হয়েছিল ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে। ২০২১ সালে অটোমেশন চালুর উদ্যোগ নিলেও তাতে আপত্তি জানিয়েছিল বেসরকারি মেডিকেল কলেজের মালিকরা। এ নিয়ে মালিকদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠকে করে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টরা। তখন মালিকদের দাবির প্রেক্ষিতে এক বছর সময় বাড়িয়ে ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষ থেকে অটোমেশন পদ্ধতি চালু করে সরকার। সে অনুযায়ী সরকারির পাশাপাশি বেসরকারি মেডিকেল কলেজেও অটোমেশন পদ্ধতিতে শিক্ষার্থী ভর্তি শুরু হয়। কিন্তু ভর্তিতে এই পদ্ধতি অনুসরণ করার পর থেকে শিক্ষার্থী কমতে শুরু করেছে বেসরকারি মেডিকেলে। পছন্দের মেডিকেল কলেজ না পাওয়ায় শিক্ষার্থীরা এই পেশায় আসতে আগ্রহ কমছে, যা অশনিসংকেত। এ নিয়ে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা হতাশ।

বেসরকারি মেডিকেল কলেজ সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, অটোমেশন প্রক্রিয়ায় কাঙ্ক্ষিত কলেজ না পাওয়ায় শিক্ষার্থীরা ভর্তি হচ্ছেন না। তারা বলছেন, দেশকে ডিজিটালাইজেশন করতে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার ভর্তি প্রক্রিয়া অটোমেশন করলেও এ পদ্ধতি হিতে বিপরীত হয়েছে। কারণ বাংলাদেশের বাস্তবতায় এর পরিবর্তন ও পরিবর্ধন প্রয়োজন।


বিজ্ঞাপন


চলতি বছর কিরগিজস্তানের মেডিকেল কলেজে অধ্যয়নরত বেশ কিছু বাংলাদেশি শিক্ষার্থী ভোগান্তিতে পড়ার পর আলোচনায় আসে বিদেশে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর পড়াশোনা করার বিষয়টি। তবে দেশের মেডিকেল কলেজে আসন ফাঁকা রেখে কেন তারা বিদেশমুখী হচ্ছেন- এমন প্রশ্নের সরাসরি কোনো উত্তর না মিললেও জানা যায়, দেশটিতে বাংলাদেশের চেয়ে মেডিকেল পড়াশোনার খরচ কম।

বেসরকারি মেডিকেল কলেজ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অটোমেশন প্রক্রিয়ার শিক্ষার্থীরা নিজের পছন্দের কলেজ না পাওয়ায় ভর্তি হচ্ছেন না। এছাড়া অনেক দেশের তুলনায় দেশে ব্যয় বেশি। ফলে অনেক মেডিকেল কলেজে সিট ফাঁকা আছে। ফলে এই খাতে যারা বিনিয়োগ করেছেন তারা ক্ষতির মুখে পড়বেন।

অটোমেশনের নামে বেসরকারি মেডিকেল খাতকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র চলছে বলে দাবি করেছেন সচেতন অভিভাবক ও বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ অ্যাসোসিয়েশন। ফলে অটোমেশন পদ্ধতিতে ভর্তি প্রক্রিয়া বাতিল করার দাবি জানিয়েছেন তারা।

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষ থেকে মেডিকেল কলেজে এমবিবিএস ভর্তিতে অটোমেশন বা স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি চালু হয়। এ পদ্ধতিতে সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজে মেধাতালিকার ভিত্তিতে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। শিক্ষার্থীরা তাদের পছন্দের কলেজগুলো বেছে নিতে পারেন না। এতে প্রথমে শিক্ষার্থীদের পাঁচটি মেডিকেল কলেজে ভর্তির পছন্দের জন্য রাখা হয়েছিল। পরবর্তীতে এ নীতি পরিবর্তন করে ছেলেদের জন্য ৬০টি মেডিকেল কলেজ এবং মেয়েদের জন্য ৬৬টি চয়েস রাখা হয়েছে।


বিজ্ঞাপন


বেসরকারি মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ বলছে, বেসরকারি মেডিকেল সেক্টর ধ্বংস করার জন্য অটোমেশন চালু করা হয়েছে। বিগত সরকার বেসরকারি মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ ও চিকিৎসা শিক্ষা বিশেষজ্ঞদের মতামত উপেক্ষা করে এ অটোমেশন চালু করা হয়েছে। শিক্ষার মান রক্ষার নামে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) কর্মকর্তারা নিজেদের দোষ অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছে। সরকারই বেসরকারি মেডিকেল কলেজের অনুমোদন দিয়েছে এবং নীতিমালাও করে দিয়েছে। সেই নীতিমালা ও গাইডলাইন কেউ না মানলে ব্যবস্থা নেওয়ার এখতিয়ার রয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতরের। সরকারের পাশাপাশি অনেক নামিদামি বেসরকারি হাসপাতাল আন্তর্জাতিক মানের চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছে। মধ্যবিত্ত কিংবা বেশিরভাগ বিত্তশালী এখন দেশেই চিকিৎসাসেবা নিচ্ছেন। প্রাইভেট মেডিকেল সেক্টর ধ্বংস করে সবার স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়। মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের তৎকালীন অদক্ষ, অযোগ্য ও ঘুসখোর কর্মকর্তারা তাদের আয়ের উৎস বাড়াতে অটোমেশন পদ্ধতি চালু করেছে। নিজেদের অযোগ্যতা ঢাকতে তারা নতুন এ আইন চাপিয়ে দিয়েছে। এ পদ্ধতি চালু হওয়ার পরে প্রতি শিক্ষাবর্ষে অধিকাংশ বেসরকারি মেডিকেল কলেজের সকল আসন পূরণ হয়নি বরং সিংহভাগ আসনে শিক্ষার্থী শূন্য রয়েছে। এতে প্রতিষ্ঠানগুলো সংকটে পড়ছে এবং এর প্রভাব পড়ছে চিকিৎসা শিক্ষা কার্যক্রমেও।

অটোমেশনে ভর্তির পদ্ধতি করায় শিক্ষার্থীরা পছন্দমতো মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়ে হতাশ ও সংক্ষুব্ধ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তৈরি ভর্তি-ইচ্ছুক তালিকায় দেখা গেছে, রাজধানী ঢাকায় বেড়ে ওঠা শিক্ষার্থীরা ঢাকার বাইরে গ্রামে-গঞ্জের কোনো মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন। এ ক্ষেত্রে অনেক শিক্ষার্থীর ফ্যামিলি সেখানে ভর্তি করতে চাচ্ছে না, যেখানে মানিয়ে নেয়া তাদের সন্তানের পক্ষে কষ্টসাধ্য। আবার মফস্বলের অনেকে রাজধানীতে পড়ার সুযোগ পেয়েছেন। কিন্তু এখানকার ব্যয় বহন তাদের পক্ষে কঠিন। এভাবে অটোমেশন পদ্ধতি একাধিক শিক্ষার্থীর ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছা নিমিষেই শেষ করে দিচ্ছে।

অটোমেশন পদ্ধতিতে অনলাইনে বেসরকারি মেডিকেল ভর্তির জন্য ফরম পূরণের সময় কলেজের তালিকা যুক্ত করতে হয়। এ প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থী আবেদনের পর একটি নির্দিষ্ট মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পাওয়ার বিষয়টি খুদে বার্তার (এসএমএস) মাধ্যমে জানানো হয়। ফলে তাদের পছন্দের বিষয়টি থাকছে না। পছন্দের মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ না পাওয়ার শিক্ষার্থীরা ডাক্তারি পড়ালেখা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন।

অটোমেশন পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীরা তাদের পছন্দমতো কলেজ না পাওয়ায় ভর্তি হচ্ছে না। ফলে বছরের শেষভাগেও অধিকাংশ বেসরকারি মেডিকেল কলেজে আসন শূন্য থাকছে। আসন শূন্য থাকায় ২০২২-২৩ ও ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে অটোমেশনে তিনবার মেধা তালিকা প্রেরণ করা হলেও অনেকে তাদের পছন্দের কলেজ না পেয়ে ভর্তি হয়নি। এমনকি বিনা খরচে দরিদ্রও মেধাবী কোটাতেও পছন্দ মতো কলেজ না পাওয়ায় আসন পূরণ হচ্ছে না কোথাও কোথাও।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষ এমবিবিএস প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী এক লাখ দুই হাজার ৩৬৯ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে উত্তীর্ণ হয় ৪৯ হাজার ৯২৩ জন ভর্তিচ্ছু। তাদের মধ্যে ৩৭টি সরকারি মেডিকেলে পাঁচ হাজার ৩৮০ সিট পূর্ণ হলেও ৬৭টি অনুমোদিত বেসরকারি মেডিকেল কলেজের ছয় হাজার ২৯৫টি আসন পূরণ হয়নি। চলতি বছর বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে এক হাজার ২০০ সিট খালি রয়েছে। এ ছাড়া ভর্তি প্রক্রিয়া এখনও চলমান, যা শিক্ষার্থীদের জীবন অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

অটোমেশনে ভর্তি প্রক্রিয়া অনেক সময়সাপেক্ষ। কয়েকবার মেধা তালিকা প্রকাশের পরেও আসল ফাঁকা থাকায় বিলম্বে ক্লাস শুরু করতে হচ্ছে। এ ছাড়া প্রথমে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের ক্লাস শুরু হওয়ার পরেও অনেকে এখান থেকে চলে যাচ্ছে আবার অনেকে পরবর্তী তালিকা অনুযায়ী ভর্তি হচ্ছে। ফলে ক্লাস নিয়ে শিক্ষার্থীদের বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে। এছাড়া অনেক শিক্ষার্থী পছন্দের কলেজ না পেয়ে ভর্তি হচ্ছে না আবার অন্য কোথাও ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না।

অটোমেশন পদ্ধতির কারণে বিদেশি শিক্ষার্থীরাও বাংলাদেশে চিকিৎসা শিক্ষা গ্রহণে আগ্রহ হারাচ্ছেন। অটোমেশন চালু করার আগে ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কাসহ বিভিন্ন দেশ থেকে পর্যাপ্ত শিক্ষার্থীরা ডাক্তারি পড়তে আসতেন। অটোমেশন কাউকে তার ইচ্ছা মতো খুশি করতে পারছে না। ফলে বিদেশি শিক্ষার্থীরাও বাংলাদেশে মেডিকেলে ভর্তি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন।

সংশ্লিষ্টরা জানান, যে শিক্ষার্থী ঢাকায় বড় হয়েছে তিনি ঢাকার কোনো মেডিকেলে পড়তে চান। কিন্তু অটোমেশনে তিনি পেয়েছেন চট্টগ্রাম বা রাজশাহীর কোনো মেডিকেল কলেজ। ফলে সেখানে থর্তি হচ্ছে তিনি আগ্রহ দেখাচ্ছে না। এ কারণে অনেক আসন ফাঁকা থেকে যাচ্ছে।

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরিরত আরেক অভিভাবক বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সরকারি মেডিকেল কলেজের ক্ষেত্রে ভর্তিতে অটোমেশন পদ্ধতি চালু করতে পারে কিন্তু বেসরকারিতে অটোমেশন মানেই মানুষের অধিকার হরণ করা। যারা বেসরকারিতে পড়বে তারা টাকা দিয়েই পড়বে, যেখানে খুশি সেখানেই পড়বে। এটা নিয়ে সরকারের হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়।

বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ অ্যাসোসিয়েশনের কোষাধ্যক্ষ হাবিবুল হক বলেন, অটোমেশন পদ্ধতিটি ভারত থেকে আনা হয়েছে। এটি নিজেদের ক্ষেত্রে প্রয়োগের বিষয়ে অন্য দেশের পরিস্থিতি আর আমাদের পরিস্থিতি বিবেচনা করা হয়নি। সেখানে অটোমেশন প্রয়োজন। আমাদের দেশে তো সে রকম না।

অটোমেশন একটি বৈষম্যমূলক পদ্ধতি, এটি বাতিল করার দাবি জানিয়েছেন বেসরকারি মেডিকেল কলেজ মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ অ্যাসোসিয়েশন। চলতি বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর সংগঠনটির পক্ষ থেকে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা বরাবর চিঠি পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে তারা উল্লেখ করেছে, বেসরকারি মেডিকেলের মতো ব্যয়বহুল শিক্ষায় যারা পড়তে ইচ্ছুক, তারা নিজেদের অর্থ ব্যয় করে নিজেদের পছন্দের কলেজে পড়তে চান। অটোমেশনের কারণে অর্থ থাকলেও পছন্দের কলেজে অনেকেই ভর্তি হতে পারছেন না। অটোমেশন পদ্ধতি বাতিল করে আগের ব্যবস্থায় ফিরে গেলে শিক্ষার্থী ও কলেজ কর্তৃপক্ষের সুবিধা হবে।

এমআর

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর