পেশায় শিক্ষক হলেও রাজনীতি নিয়েই যেন বেশি সক্রিয় ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা আদর্শ কলেজের উপাধ্যক্ষ কামাল আতাউর রহমান ওরফে সাইক্লোন। স্থানীয় সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুর রহমানের আস্থাভাজন হওয়ায় নিজের মতো করেই চলছেন আলফাডাঙ্গা উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদে সক্রিয় রাজনীতি করা সাইক্লোন। প্রতিষ্ঠানের কোনো নিয়মের তোয়াক্কা করতেন না কখনোই। যোগ্যতা না থাকার পরও জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে হয়েছেন সহকারী অধ্যাপক। আবার উপাধ্যক্ষ পদে নিয়োগ পাওয়ার পর বেতন তুলেছেন প্রভাষক পদ থেকেও। শুধু তাই নয়, তার বিরুদ্ধে সহকর্মীদের শারীরিকভাবে লাঞ্ছনা, সরকারি অর্থ আত্মসাতের অভিযোগের প্রমাণ পেয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর (মাউশি)।
মাউশি সূত্রে জানা গেছে, গত ২২ আগস্ট ঢাকা অঞ্চলের পরিচালক অধ্যাপক মো. মনোয়ার হোসেনের দাখিল করা প্রতিবেদনে তার বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতসহ একাধিক অভিযোগের প্রমাণ পাওয়ার কথা তুলে ধরা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনে সাইক্লোনের অতিরিক্ত নেওয়া বেতনের টাকা ফেরতের সুপারিশ করা হয়েছে।
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন
অভিযোগ আছে, স্থানীয় সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুর রহমানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকায় গভর্নিং বডির ওপরও প্রভাব বিস্তার করতেন সাইক্লোন। একাধিকবার প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে তার বিরুদ্ধে রেজুলেশন করা হলেও এসবে পাত্তা দিতেন না তিনি।
মাউশির এক তদন্ত প্রতিবেদনে আতাউর রহমান সাইক্লোনের নানা অনিয়ম উঠে এসেছে। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কামাল আতাউর রহমান (ইনডেক্স নম্বর: ৪১১৩৫৯) কলেজ কর্তৃপক্ষের আবেদন ছাড়াই জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে ২০০৪ সালের জুলাই মাস থেকে বকেয়াসহ সহকারী অধ্যাপকের স্কেলে বেতন-ভাতা উত্তোলন করেন।
২০০৮ সালের ৪ মে মাউশি এক আদেশে তাকে সহকারী অধ্যাপকের পরিবর্তে প্রভাষক এবং বেতন কোড ৬-এর পরিবর্তে ৮ করা হয়। একইসঙ্গে ২০০৪ সাল থেকে ২০০৮ পর্যন্ত বেতন-ভাতায় নেওয়া অতিরিক্ত অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা দিতে কামাল আতাউর রহমান সাইক্লোনকে নির্দেশ দেওয়া হয়, যা এখন পর্যন্ত তিনি ফেরত দেননি।
মাউশি সূত্রে জানা গেছে, কামাল আতাউর রহমান ওরফে সাইক্লোন প্রভাষক পদ ছেড়ে ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর থেকে একই কলেজে উপাধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন এবং ২০১২ সালের জানুয়ারিতে এমপিওভুক্ত হন। কিন্তু ২০১১ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর তিন মাসের প্রভাষক স্কেলে অতিরিক্ত অর্থ উত্তোলন করেন।
তার বিরুদ্ধে সহকর্মীদের সঙ্গে বাজে আচরণ করার বিষয়ও উঠে এসেছে মাউশির প্রতিবেদনে। সেখানে বলা হয়, ২০১৭ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি কলেজের বার্ষিক ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান হয়। ওই অনুষ্ঠানে তৎকালীন অধ্যক্ষ মো. মোরশেদুর রহমানের সঙ্গে চরম ঔদ্ধত্যপূর্ণভাবে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন। কিন্তু কোথাও বিচার দিয়ে তার প্রতিকার মেলেনি। এছাড়া তুচ্ছ কারণে সহকারী অধ্যাপক অবনী মোহন বিশ্বাসকে (প্রয়াত) শারীরিক ও মানসিকভাবে লাঞ্ছিত করেন।
শুধু তাই নয়, কোনো বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রিধারী না হয়েও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অমান্য করে উপাধ্যক্ষ হয়েছেন তিনি।
তদন্ত প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, ২০২২ সালের ৬ মে এম এম মুজিবুর রহমান ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব নেন। এর পরদিন ৭ মে কলেজের স্টাফ কাউন্সিল সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভয় ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে অশ্রাব্য গালিগালাজ ও চরম অসৌজন্য আচরণ করেন কামাল আতাউর রহমান সাইক্লোন।
এসব বিষয়ে বক্তব্য জানতে চেয়ে চলতি বছরের জুনে দফায় দফায় সাইক্লোনকে নোটিশ দেন মাউশির তদন্ত কর্মকর্তা। তিনি জবাবসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ১০ জুনের মধ্যে পৌঁছে দেবেন বলে লিখিতভাবে জানান। ১০ জুন তদন্তকারী কর্মকর্তাকে লিখিতভাবে জানান, সংশ্লিষ্ট ডকুমেন্টসমূহ ৩০ জুন জমা দেবেন। এরপর তিনি কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে কিছু অংশ কম্পিউটার কম্পোজ করা এবং কিছু অংশ হাতে লেখা কাগজপত্র তদন্ত কর্মকর্তার কাছে পাঠান বলে মাউশি সূত্রে জানা গেছে।
কলেজ সূত্রে জানা গেছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিপত্র অনুযায়ী উপাধ্যক্ষ হওয়ার কোনো শর্তই পূরণ করতে পারেননি কামাল আতাউর রহমান। কিন্তু তৎকালীন আওয়ামী লীগের এমপি আব্দুর রহমানের প্রভাব খাটিয়ে ২০১১ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর আলফাডাঙ্গা আদর্শ কলেজের উপাধ্যক্ষ পদে বসেন তিনি।
মাউশির প্রাপ্ত তথ্যমত, কলেজের কোনো নিয়মনীতি মানেন না সাইক্লোন। প্রতিষ্ঠান ও চাকরিবিধি মেনে ক্লাস-পরীক্ষার কোনো দায়িত্বই সঠিকভাবে পালন করেন না। তিনি নিজের মতো অফিসে আসেন আর যান। প্রতিষ্ঠান প্রধানকে অবহিত না করে কলেজ ক্যাম্পাস ত্যাগ করেন। এমনকি সরকারের নির্দেশিত কলেজের কোনো কর্মকাণ্ডেও তিনি উপস্থিত থাকেন না।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, কলেজের চেয়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে বেশি সক্রিয় থাকা শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সাইক্লোনের নেতৃত্বে আলফাডাঙ্গায় লাঠি মিছিল হয়েছে।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে আলফাডাঙ্গা আদর্শ কলেজের উপাধ্যক্ষ কামাল আতাউর রহমান ওরফে সাইক্লোন ঢাকা মেইলকে বলেন, কলেজের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব আর রাজনৈতিক কারণে এমন কথাবার্তা বলা হচ্ছে। আমি কোনোদিন কাউকে মারধর করিনি। কারও সঙ্গে প্রভাবও দেখাইনি। পদোন্নতিও নিয়মমাফিক পেয়েছি। বাড়তি টাকাও নেয়া হয়নি। মাউশির তদন্ত কর্মকর্তাকে সব কাগজপত্র দিয়েছি। সেখানে যদি প্রমাণ হয় ভুলবশত বেশি টাকা নিয়েছি তাহলে তা ফেরত দেব।'
সাইক্লোন অভিযোগ করে বলেন, 'কলেজের বহু শিক্ষকের বিরুদ্ধে বাড়তি টাকা নেওয়ার প্রমাণ আছে। তা ফেরত দিতেও বলা হয়েছে বহু বছর আগে। কেউ দেয়নি। সেখানে আমারটা নিয়ে কেন এত কথা?'
উপাধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ এম এম মুজিবুর রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘মন্ত্রীর আস্থাভাজন হওয়ায় উপাধ্যক্ষকে কিছু বলার কেউ সাহস পেত না। তার মধ্যে সবসময় বিদ্রোহী ভাব থাকত। নিজে যা করত তাই নিয়ম মনে করতেন। প্রতিষ্ঠানের কোনো নিয়ম তিনি মানেন না। সহকর্মীদের তিনি প্রকাশ্যে গালিগালাজ, শারীরিকভাবে লাঞ্ছিতও করেছেন। মাউশি থেকে তার বিরুদ্ধে তদন্ত হয়েছে। সেখানে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। আমরা বিষয়টি নিয়ে বর্তমান সভাপতি ইউএনও মহোদয়ের সঙ্গে কথা বলব।’
বিইউ/এমআর