ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়া আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের নানা অপকর্মের চিত্র সামনে আসতে শুরু করেছে। চাঁদাবাজি ও ফ্রি খাওয়ার মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর ক্যান্টিন মালিকদের অতিষ্ঠ করে তুলেছিলেন তারা। এর মধ্যে বিজ্ঞান অনুষদের ছাত্রদের তিনটি আবাসিক হলে ছাত্রলীগের উপদ্রব ছিল সবচেয়ে বেশি। এতে ক্যান্টিন পরিচালক ও দোকান মালিকরা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ছাত্রলীগের অত্যাচারে তাদের অনেকের পথে বসার উপক্রম হয়েছে।
শনিবার (১৭ আগস্ট) ফজলুল হক মুসলিম হল, ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ হল এবং অমর একুশে হলে ঢাকা মেইলের এক অনুসন্ধানে এসব অভিযোগ উঠে আসে। ছাত্রলীগের বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীর নামে উঠে আসে এককালীন, মাসিক এবং ফ্রি খাওয়ার বিপুল অভিযোগ।
বিজ্ঞাপন
সবচেয়ে বেশি আর্থিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন শহিদুল্লাহ হলের ক্যান্টিন পরিচালক হাজী সাইদুল হোসেন ও হলের পুকুর সংলগ্ন দোকান মালিকরা।
শহীদুল্লাহ হল ক্যান্টিনের ষাটোর্ধ পরিচালক হাজী সাইদুল হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘দুই বছর আগে যখন আমরা ক্যান্টিন পরিচালনা শুরু করি তখন ছাত্রলীগের কমিটিকে এককালীন সাত লাখ টাকা দিতে হয়। এই দুই বছরে তালিকাভুক্ত বাকি রয়েছে ৫৪ হাজার টাকা। এছাড়া মাসিক আমাদের কাছ থেকে ১৫ হাজার টাকা চাঁদা তারা নিতো।’
বিজ্ঞাপন
সাইদুল হোসেন বলেন, ‘টাকা-পয়সা নিয়েছে, খেয়েছে-সেটা না হয় একটা বিষয়। কিন্তু আমি একজন ষাটোর্ধ মানুষ, কথার বেতাল হলে তারা আমার গায়ে হাতও দিতো। চড়-থাপ্পড় মারত, ভাঙচুরের হুমকি দিত। এখান থেকে সরিয়ে দেওয়ার হুমকিও আমরা পেতাম। এ বিষয়টি আমি মানতে পারছি না কোনোভাবেই।’ কথাগুলো বলতে গিয়ে এক পর্যায়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন এই ব্যবসায়ী।
এছাড়াও পুকুরপাড়ের ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, তাদের কাছেও বিরাট অংকের বাকি রেখেছেন ছাত্রলীগের বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীরা। খাবারের দোকানের জন্য মাসে পাঁচ হাজার এবং অন্যান্য দোকানের জন্য মাসে তিন হাজার টাকা চাঁদা দিতে হতো।
সামষ্টিকভাবে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুললেও ক্যান্টিন মালিক এবং দোকান ব্যবসায়ীদের কেউই আলাদা করে কারো নাম বলতে চাননি।
এরপরই আসে ফজলুল হক মুসলিম হলে ছাত্রলীগের ক্যান্ডিডেট ও সুফিয়া কামাল হলের ছাত্রলীগ নেত্রীদের চাঁদাবাজির ঘটনা। করোনাপরবর্তী সময়ে ফজলুল হক মুসলিম হলের ক্যান্টিন পরিচালক আব্দুল মজিদ এককালীন ছাত্রলীগের কাছে দিয়েছেন পাঁচ লাখ টাকা। ছাত্রলীগের আলোচিত নেত্রী তিলোত্তমা শিকদার ফজলুল হক মুসলিম হলের ক্যান্টিন মালিক থেকে চার লাখ টাকা চাঁদা চান বলে দাবি আব্দুল মজিদের।
হলের এই ক্যান্টিন মালিকের দাবি, চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে তিলোত্তমা শিকদার হুমকি দিয়ে বলতেন- ‘যদি আপনি টাকা না দেন তাহলে আপনার খাবারে তেলাপোকা, টিকটিকি, এমনকি ইঁদুরও ঢুকিয়ে দেব। তখন ভালোমতো ব্যবসা করবেন।’
এসব বাদেও মাসিক ১০ হাজার টাকা চাঁদা দেওয়া লাগতো হল ছাত্রলীগকে। ফ্রি খাওয়ার পরিমাণ অন্তত দুই লাখ টাকা বলে দাবি ফজলুল হক মুসলিম হলের ক্যান্টিন পরিচালকের৷ এসব পাওয়ার আর আশা তিনি করেন না। বাধ্য হয়েই তাকে মেনে নিতে হয় সব অন্যায়।
সবচেয়ে কম আর্থিক ক্ষতি সম্ভবত অমর একুশে হলের ক্যান্টিন মালিকের। তবে সেটাও মাসিক, এককালীন চাঁদা ও বাকি মিলিয়ে অনেক। এই হলের ক্যান্টিন মালিক মো. শামীম হোসাইন ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমি ক্যান্টিন পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়ার এক মাস পরেই করোনা শুরু হয়। আমার কাছ থেকে তৎকালীন অমর একুশে হলের সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক এককালীন এক লাখ টাকা নেন। পরে আবার কমিটি দিলে নতুন কমিটিও আমার কাছ থেকে টাকা নেয় এক লাখ। এছাড়া তাদের বাকি তথা ফ্রি খাওয়ার পরিমাণও চার লাখ টাকার মতো। মাসিক তারা নিতো ১০ হাজার টাকা করে।’
এককালীন, মাসিক এবং বাকি সব মিলিয়ে ফজলুল হক মুসলিম হলের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ নয় লাখ ৬০ হাজার টাকা। একইভাবে শহীদুল্লাহ হলে ১১ লাখ ১৪ হাজার, অমর একুশে হলে ১০ লাখ ৮০ হাজার টাকা। মোট আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৩১ লাখ ৫৪ হাজার টাকা। বিপুল পরিমাণ এই আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ে চোখে-মুখে হতাশা দেখছেন তিন হলের ক্যান্টিন এবং দোকান মালিক ব্যবসায়ীরা।
প্রতিনিধি/জেবি