মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০২৪, ঢাকা

বিদ্যুৎ-গ্যাস বিলে ধুঁকছে মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্তের চোখে সরষে ফুল!

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০৯:৫২ এএম

শেয়ার করুন:

বিদ্যুৎ-গ্যাস বিলে ধুঁকছে মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্তের চোখে সরষে ফুল!

ক্রমেই বাড়ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম। এর মধ্যে গ্যাস ও বিদ্যুতের অতিরিক্ত দাম যেন ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’। সব মিলে সংসারের হিসাব সমন্বয় করতেই গলদঘর্ম হচ্ছেন মধ্য ও নিম্ন আয়ের মানুষ। গেল ১ বছরের বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি পর্যালোচনায় দেখা যায়, শুধু বিদ্যুৎ ও গ্যাস বিল বাবদ ২০-২৫ শতাংশ পর্যন্ত খরচ বেড়েছে অনেক পরিবারের। ফলে বিপাকে পড়তে হচ্ছে সীমিত আয়ের মানুষদের। 

গ্রাম কিংবা শহর, সব জায়গায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের অতিরিক্ত মূল্য দুর্বিষহ করে তুলেছে এসব মানুষের জীবনযাপন। সীমিত আয়ের মানুষের অভিযোগ— এমনিতেই কিছুদিন পরপর মূল্যবৃদ্ধি পাচ্ছে সব কিছুর। তার ওপর খুচরা পর্যায়ে বিক্রেতাদের কাছ থেকে নির্ধারিত মূল্যের অতিরিক্ত দিয়ে কিনতে হচ্ছে। সবমিলে জীবনযাপন কঠিন করে তুলেছে। 


বিজ্ঞাপন


পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে ফের বাড়ল বিদ্যুতের দাম

গ্যাস-বিদ্যুতের বিল যেন ‘শিশুর কাঁধে হাতির পা’
জানুয়ারি মাসে এক দফা বাড়ানোর পর ফেব্রুয়ারির এক তারিখ থেকেই আরেক দফা বাড়ছে বিদ্যুতের দাম। ফলে শুধু আবাসিক বিদ্যুৎ বাবদ মাসিক খরচ ১০ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যাচ্ছে।

শাহনাজ চৌধুরী। রাজধানীর এই বাসিন্দা বলেন, হিসাব করে বিদ্যুৎ ব্যবহার করি, তাও মাসে বিল আসে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা। টিভি, ফ্রিজ তো বন্ধ করেও রাখতে পারি না। এখন সরকার বিল আরও বাড়িয়েছি, কারেন্টের বিল তো আমার বাজেট ছাড়িয়ে যাবে।

আরও পড়ুন:- এক ধাক্কায় ২৬৬ টাকা বাড়ল এলপিজির দাম


বিজ্ঞাপন


গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি
ঢাকার কলাবাগান এলাকায় বসবাসকারী এই নারী বলেন, নানারকম কাটছাঁট করার পরেও গত এক বছরে তার সাংসারিক খরচ দেড়গুণ বেড়েছে। কারণ বাজারের প্রতিটা জিনিসের দাম বেড়েছে। এক বছর আগেও যে দামে আটা-চিনি কিনতাম, এখন তার দ্বিগুণ হয়ে গেছে। চাল, ডাল, তেল- প্রতিটা জিনিসের দাম বেড়েছে। আমাদের আয় তো সেই হিসাবে বাড়েনি। সংসারে আর কোন আইটেমটা বাদ দেবো? 

শাহনাজ যোগ করে বলেন, ছেলে-মেয়ের স্কুলের পড়ার খরচ বেড়েছে, যাতায়াত খরচ বেড়েছে।  স্থির নেই বাড়িভাড়াও।

নগরীর এই বাসিন্দার মতো অনেকের আশঙ্কা— বিদ্যুৎ চার্জ বাড়ার কারণে হয়তো এখন পানিসহ অন্যান্য খরচও বেড়ে যাবে।

অন্যদিকে সরকার ইঙ্গিত দিয়েছে, ভর্তুকি কমাতে এখন থেকে প্রতি মাসেই বিদ্যুৎ খরচ সমন্বয় করা হতে পারে। 

gass

রাতারাতি বেড়েছে গ্যাসের দাম
বরগুনার লায়লা আঞ্জুমান চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে গ্যাসের সিলিন্ডার। এই তো সপ্তাহখানেক আগে ১২ কেজির এলপিজি সিলিন্ডার কিনেছেন ১ হাজার ৩০০ টাকায়। সেই সিলিন্ডারই দুদিন আগে কিনতে হয়েছে ১ হাজার ৭০০ টাকায়। তিনি বলেন, বুঝতে পারছি না। সরকারের নির্ধারিত দাম আছে ১৩শ’র নিচে, তাও সেটা দিতাম। এখন দোকানদাররা বলছে, ১৭০০ টাকার নিচে সিলিন্ডার নেই।

লিকুইড পেট্রোলিয়াম গ্যাস বা এলপি গ্যাসের দাম সরকার নির্ধারণ করে দিলেও বরাবরই অভিযোগ ওঠে— বাজারে এর চেয়ে অনেক বেশি দাম নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এখন এলপিজি গ্যাসের দাম যেন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে শুরু করেছে।

কিছুটা রসিকতার সুরে লায়লা আঞ্জুমান বলেন, সব জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। গ্যাসেরও দাম এমন বেড়েছে যে, এখন চাইলেই যে আলু সিদ্ধ করে খাবো, তারও উপায় নেই।

পড়ুন: সরকারি দামের তোয়াক্কা নেই চিনির বাজারে

মায়ের দোয়া এন্টারপ্রাইজ। একটি এলপিজি সিলিন্ডার বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান। আবু জাফর সেই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার। তিনি বলেন, মার্কেটে সিলিন্ডারের সাপ্লাই কম আছে। কোম্পানি থেকে মাল আসছে না। আমাদের বেশি দামে কিনতে হচ্ছে বলেই বিক্রিও করতে হয় বেশি।

প্রতিবেদনের উপরিভাগে উল্লেখ করা শাহনাজ চৌধুরী ব্যবহার করেন এলপিজি সিলিন্ডার গ্যাস। ১২ কেজির সিলিন্ডারে ২০ থেকে ২২ দিন চলে তার। সেই হিসাবে প্রতি দেড় মাস পরপর সিলিন্ডার কিনতে হয় তাকে। তিনি বলেন, মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে সিলিন্ডারের দাম ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা বেড়ে গেছে। দেখার কেউ নেই। না কিনেও উপায় নেই, তাহলে রান্না-বান্না বন্ধ হয়ে যাবে। এখন সংসারের আরেক খরচের কাটছাঁট করতে হবে।

তিনি জানান, দ্রব্যমূল্য ও পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধির কারণে এর আগেই সংসারের বেশ কিছু খরচ বাদ দিয়েছেন তিনি। গত কয়েকমাসে শখের কোন জিনিসপত্র কিনিনি, তাহলেই বোঝেন কীভাবে সংসার চালাচ্ছি। 

বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের সচিব ব্যারিস্টার মো. খলিলুর রহমান খান এক স্বাক্ষাৎকারে গণমাধ্যমকে বলেন, আমাদের কাছে গ্যাস সঙ্কটের কোনো তথ্য নেই। দেশে যথেষ্ট পরিমাণে এলপিজি মজুত আছে।

ফের বাড়ল রফতানি উন্নয়ন তহবিলের সুদহার

যেভাবে বেড়েছে তেলের দাম
এলপিজি ব্যবসায়ীরা বলছেন— ডলার সঙ্কটের কারণে আরও অনেক খাতের মতো ঋণপত্র খোলা নিয়ে জটিলতায় পড়েছেন এলপিজি অপারেটরগুলো। বিশেষ করে ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো বেশি সঙ্কটে পড়েছে। এই কারণে সরবরাহে কিছুটা ঘাটতি দেখা গিয়েছে। এই কারণে আগেভাগেই দাম বাড়াতে শুরু করেছেন ব্যবসায়ীরা।

‘মানুষের কষ্ট বাড়ে’
গেল বছর রেকর্ড পরিমাণে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পর খাদ্যদ্রব্য, পরিবহন থেকে শুরু করে সব জিনিসপত্রের দাম একদফা বেড়েছে। তার ওপর ডলারের বিনিময় মূল্য বেড়ে যাওয়ার কারণে আমদানি নির্ভর অর্থনীতির প্রায় সব জিনিসের দাম বেড়েছে, যার ভুক্তভোগী হচ্ছেন সীমিত বা নিম্ন আয়ের আয়ের সাধারণ মানুষ।

আরও পড়ুন: কত বাড়ল বিদ্যুতের দাম?

রাজধানীর তিনটি বাসায় গৃহ পরিচারিকার কাজ করেন মনোয়ারা বেগম। এক বছর আগেও তার আয়েই চলতো সংসারের খরচ। কিন্তু এখন আর কোনোভাবে সংসার চালানো সম্ভব হচ্ছে না তার। তিনি বলেন, ডেইলি জিনিসের দাম বাড়ে, আমাদের বেতন তো ডেইলি বাড়ে না। মাছ, মাংস বাদ দিলাম, সবজি খাওয়াও তো কঠিন এখন। এই যে গ্যাসের দাম বাড়াইছে, বিদ্যুতের দাম বাড়াইছে, এখন তো আমাগো বাড়িওয়ালা ভাড়াও বাড়াবে। কয়দিন শহরে থাকতে পারবো জানি না।

কাজের ফাঁকে এখন তিনি টিসিবির গাড়ি থেকে পণ্য কেনার জন্য আলাদা সময় বরাদ্দ রাখতে হয় তাকে। বিকল্প হিসাবে ভাবছেন গ্রামের বাড়িতে ফিরে যাওয়ার কথাও।

কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, এমনিতেই জিনিসপত্রের দাম বেশি। তার সাথে সাথে যদি বিদ্যুতের, গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়, তাহলে মানুষের কষ্ট বাড়ে এবং তাদের জীবনমানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

তিনি বলেন, বিশেষ করে জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সাথে অনেক কিছুর সম্পর্ক আছে। ফলে এসব জিনিসের যখন দাম বাড়ে, তখন অন্যান্য পণ্যের দামও বেড়ে যায়।

গোলাম রহমান বলেন, গত বছরের মূল্যস্ফীতির যে রিপোর্ট, তাতে একটা জিনিস স্পষ্ট হয়েছে, গত বছর যখন জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হলো, তখন থেকেই দেশে মূল্যস্ফীতি বাড়তে শুরু করেছে। জিনিসপত্রের দাম এমনভাবে বাড়ছে, মানুষ পাল্লা দিয়েও খাপ খাইয়ে নিতে পারছে না।

এইউ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর