উপকূলীয় বরগুনা জেলার বরগুনা সদর ও পাথরঘাটা এই দুই উপজেলার মধ্য স্থানে অবস্থিত চতুর্দিকে নদীবেষ্টিত দ্বীপ, যা সবার কাছে 'মাঝেরচর' নামে পরিচিত। প্রকৃতি যতটা সুন্দর, এখানকার মানুষের জীবন ততটাই অবহেলিত। প্রায় সব অধিকার থেকেই তারা বঞ্চিত। পরিবার চালাতে অধিকাংশ মানুষই নির্ভর করে নদীর মাছ আর সামান্য কৃষিকাজের ওপর। স্বপ্ন আছে, ইচ্ছাশক্তিও আছে কিন্তু আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে সেই স্বপ্নগুলো অধিকাংশ সময়ই ধূলিসাৎ হয়ে যায়।
সরেজমিনে দেখা যায়, অবহেলিত নারী সমাজকে এগিয়ে নিতে, তাদের সংসারের সচ্ছলতা ফেরাতে উদ্যোক্তা তৈরির কারিগর মো. আরিফুর রহমান পুরুষের পাশাপাশি নারীদের আয়মুখী নানা কাজে যুক্ত করেছেন। এতে পরিবারে ফিরছে সচ্ছলতা, বদলে যাচ্ছে মাঝের চরের অর্থনীতি। চরবাসীর জীবনমান উন্নয়নে সামাজিক সংস্থা 'ইউনাইটেড সোসাইটি ফর সোশ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিস (উসসাস)' ও 'জল তরুণী' যৌথভাবে শুরু করেছে নারীদের হাতে-কলমে কাজ শেখানোর এমন নানা সামাজিক উদ্যোগ।
বিজ্ঞাপন

স্থানীয় নারীদের সূত্রে জানা যায়, এখানে নারীরা এখন তৈরি করছেন হরেক রং ও ডিজাইনের কাঁথা। হোগলা পাতা, কচুটিপানা, তাইত, ঝুটসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক উপকরণ দিয়ে ম্যাট, টুপি, ব্যাগ, ঝুড়ি, ওয়ালমেট। কেউ বা সুপারির খোল দিয়ে নানান শো-পিস, নামের অক্ষর ও কুটিরশিল্পের বহু সামগ্রী তৈরি করছেন। আবার কেউ কেউ তৈরি করার চেষ্টা করছেন, কেউ কেউ দেখে দেখে তৈরি করার আগ্রহী হচ্ছেন।
মোসা. মরিয়ম বলেন, টাকার অভাবে পড়াশোনা ছাড়ছি। পরে এইকাজ খালার কাছ থেইক্যা দেইখা দেইখাই শিখছি। এখন হাতের কাজ পারতেছি। যদি আরেকটু ভালো করে ট্রেনিং দিত, তাহলে আরও সুন্দর কইরা কাজ কইর্যা মায়ের সাথে ঘর-সংসারে আয় করতে পারতাম।
মোসা. সুখী বলেন, উসসাস এবং জল তরুণীর ভাই-বোনেরা না আইলে আমাদের তো এসব কাজের প্রতি ইচ্ছেই জাগত না। তবুও সাধ্য অনুযায়ী তাদের অনুপ্রেরণায় আমরা যেভাবে পারি করছি। যদি ভালো ট্রেনিং পাই, বাজারে পণ্য বেচা-কেনা করা যাইতো তাহলে সংসারটা ভালোই চলব। স্বামী যখন খেতে থাকে, আমরা অবসর টাইমে এই কাজগুলো করি। প্রতি দিন যদি করতে পারি তাইলে আমরা পোলাপান পড়ালেখা করাইয়া সংসারডাও ভালো করে চালাইতে পারুমু।

শারমিন, আমেনা, লাখি বেগমসহ একাধিক নারী বলেন, আমরা মাঝের চরে থাকি দেইখাই মানুষ আমাদের কথা কমই ভাবে। নারী বলেও কেউ খোঁজ নেয় না। কিন্তু আমরাও পারি। শুধু দিকনির্দেশনা আর একটু ট্রেনিং দরকার। যদি কেউ পাশে দাঁড়ায়, আমরা পরিবারের চাওয়ার চাইতেও বেশি কিছু করতে পারমু।
'উসসাস' এর প্রধান সমন্বয়ক রায়হানুল ইসলাম ইয়াকুব বলেন, অসহায় বা পিছিয়ে পড়া নারী-পুরুষকে দক্ষতা ও কাজের সুযোগ করে দেওয়া আমাদের মূল লক্ষ্য। উসসাস ও জল তরুণী নিজেদের উদ্যোগে কাজ করছে, কিন্তু সরকারি- বেসরকারি ভাবে সমর্থন বা সহযোগিতা পেলে বদলে যাবে মাঝেরচর। তখন এ উদ্যোগ আরও ব্যাপকভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে।
![]()
জল তরুণীর প্রতিষ্ঠাতা মো. আরিফুর রহমান বলেন, মাঝেরচরে কয়েক শতাধিক পরিবার বসবাস করছে। সবাই কৃষি ও মাছ ধরার ওপর নির্ভরশীল। এখন নদীতে আগের মতো মাছ নেই। তাই ভাবলাম নারীদের যদি হাতে-কলমে কিছু শেখানো যায়, তাহলে পরিবারে বাড়তি আয় আসবে। আমরা চেষ্টা করছি তাদের আগ্রহ বাড়াতে, প্রোডাক্ট দেখাতে। কিছু পণ্য আছে যেগুলো ব্রান্ডিং করতে পারলে আন্তর্জাতিক মানেও নিয়ে যাওয়া যাবে।

স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান মো. মতিউর রহমান রাজা বলেন, এ উদ্যোগ খুবই সময়োপযোগী। নারীদের সম্পৃক্ততা বাড়লে মাঝেরচরের সামগ্রিক উন্নয়ন আরও দ্রুত এগিয়ে যাবে।
তিনি আরও বলেন, মাঝেরচরের নারীরা নিজেদের সক্ষমতা প্রমাণ করলেও বৃহৎ স্বপ্নপূরণে প্রয়োজন মানসম্মত ট্রেনিং, বাজারজাতকরণ সহায়তা ও কারিগরি সহযোগিতা। 'উসসাস' ও 'জল তরুণী'র এই উদ্যোগে গতি আসতে পারে যদি সরকার, এনজিও ও বিভিন্ন ডোনার সংস্থা একসঙ্গে এগিয়ে আসে।

বরগুনা বিসিকের উপ-ব্যবস্থাপক কাজী তোফাজ্জেল হক বলেন, মাঝেরচরের প্রতিভাবান নারীদের একটি নামের তালিকা করে ঢাকায় প্রস্তাবনা পাঠাব। যাতে করে মাঝেরচরে তাদের জন্য একটি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যায় এবং তাদের হস্তশিল্প তৈরির জন্য মেশিনের ব্যবস্থা করার চেষ্টা করব।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) অনিমেষ বিশ্বাস বলেন, তাদের এই প্রতিভা ধরে রাখতে সরকারের পক্ষ বিভিন্ন অধিদফতরের আওতায় ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থার জন্য চেষ্টা করা হবে। যাতে করে তারা ভালো উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেদেরকে পৃথিবীর কাছে তুলে ধরতে পারে।
প্রতিনিধি/এসএস

