বর্তমান বাজার দরে আলু বিক্রি করে ভাড়ার টাকা পরিশোধ না হওয়ায় হিমাগারে আলু নিতে আসছেন না চাষি ও ব্যবসায়ীরা। বারবার নোটিশ করার পরও চাষি ও ব্যবসায়ীরা হিমাগারে আলু নিতে না আশায় আলু বের করতে সময় বেধে দিয়ে মাইকিং করেছে কর্তৃপক্ষ। হিমাগারে আলু ঠান্ডা হওয়ার মেশিন বন্ধ করা হয়েছে মর্মে নির্ধারিত সময়ে আলু নিতে না আসলে পরবর্তীতে ওই আলুর দায় নেবে না কর্তৃপক্ষ। এছাড়া ভাড়ার টাকা আদায়ও করা হবে। তবে আলু বিক্রির টাকায় ভাড়া পরিশোধ না হওয়ায় হিমাগারে আসছেনা চাষি ও ব্যবসায়ীরা। বারবার নোটিশ করেও তাদেরকে হিমাগারে নিয়ে আসতে পারেনি কর্তৃপক্ষ।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যমতে, গত মৌসুমে জয়পুরহাটে ৪৩ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে আলু চাষ হয়েছে। উৎপাদন হয়েছে ৯ লাখ ৪৩ হাজার মেট্রিক টন। অতিরিক্ত জোগান এবং রফতানি কম হওয়ায় এবার নিম্ন দরে আলু বিক্রি হচ্ছে। পাইকারি বাজারে গত পাঁচ বছরের তুলনায় এবার বিভিন্ন জাতের আলু বছর শেষে প্রতি বস্তা (৬৫ কেজি) ৩৭০ থেকে ৩৮০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এই দাম মৌসুমের দামের চেয়ে অনেক কম।
বিজ্ঞাপন
ধারণ ক্ষমতা অনুযায়ী জেলার ১৯টি হিমাগারেই আলু সংরক্ষণ ছিল পরিপূর্ণ। মৌসুমে আলুর দাম কম বলে চাষি-ব্যবসায়ীরা হিমাগারে সংরক্ষণ করেন। প্রায় আড়াই লাখ মেট্রিক টন আলু সংরক্ষণ করেছে। খাবার আলুর প্রয়োজন ছিল জেলায় ৪০ হাজার মেট্রিক টন। সিংহভাগ আলু বিভিন্ন জেলায় বিক্রি হয়। বছর জুড়ে বাজারে দাম কম হওয়ায় হিমাগারে সংরক্ষণের ২০ শতাংশেরও বেশি আলু এখনও মজুত আছে। অথচ বাজারে নতুন আলুর আমদানি হয়েছে। আগের আলু থাকায় নতুন আলু কম দামে বিক্রি হচ্ছে। হিমাগার গেটে পুরাতন আলু ৫ থেকে ৬ টাকা কেজি আর নতুন আলু ২০ থেকে ২১ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। আগের আলু থাকায় আগাম জাতের আলু চাষিরাও লোকসান গুনছেন।
আলু চাষিরা জানান, গত মৌসুমে এক কেজি আলুর উৎপাদন খরচ পড়েছে ১৭ থেকে ১৮ টাকা। হিমাগারে সংরক্ষণ করতে গিয়ে ভাড়া ৬.৭৫ টাকা এবং লেবার, সুতলি, পরিবহন ও লোড-আনলোড মিলে আরও ২ টাকা পড়েছে। সবমিলে প্রতি কেজিতে খরচ পড়েছে ২৭ টাকা। বর্তমানে দাম মিলছে হিমাগার ভাড়াসহ কেজিতে ৫ থেকে ৬ টাকা। আলু সংরক্ষণ করে লাভ তো নয়ই, মুলধনও হারাতে হয়েছে। আলু নিতে হলে হিমাগার ভাড়া দিতে হবে, তাও আবার বস্তাপ্রতি পকেট থেকে ২০ টাকা গুনতে হবে। সে কারণে আলু নিতে হিমাগারে আসছেন না চাষি ও ব্যবসায়ীরা।
![]()
কালাই উপজেলার বেগুনগ্রামের আলু চাষি রেজাউল ইসলাম বলেন, মৌসুমে দাম কম হওয়ায় ২৫০ বস্তা আলু হিমাগারে রেখেছি। মাঝে একটু দাম উঠেছিল, তখন বিক্রি করলেও কয়েক টাকা পেতাম, এখন আলু বিক্রি করলে বাড়ি থেকে আরও বস্তাপ্রতি ২০ টাকা করে দিয়ে হিমাগার ভাড়া পরিশোধ করতে হবে। সে কারণে আলু নিতে যাইনি।
বিজ্ঞাপন
ক্ষেতলাল উপজেলার নিশ্চিন্তা এলাকার কৃষক মোজাফ্ফর হোসেন বলেন, কয়েকদিন ধরে আলু ওঠানোর জন্য হিমাগারের পক্ষ থেকে মাইকিং করছে আলু না ওঠালে তারা আর আলুর দায় নিবে না। আবার দাম কম হলে ভাড়ার টাকাও নিবে। কি করব ভেবে পাচ্ছি না। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, পুরাতন আলুই শেষ হয়নি, তার ওপর নতুন আলু হাজির। যেও দাম হতো, নতুন আলু আসাতেই পুরাতন আলু আর কেউ নিচ্ছে না। কথা বলে ‘পুরাতন পাগলের ভাতই নেই, নতুন পাগলের ছড়াছড়ি’।
পুনট বাজারের আলু ব্যবসায়ী মিঠু ফকির বলেন, এবার ১৭ হাজার বস্তা বিভিন্ন জাতের আলু কয়েকটি হিমাগারে রেখেছিলাম। কম দামেই প্রায় ১১ হাজার বস্তা আলু বিক্রি করেছি। আর ৬ হাজার বস্তা আলু হিমাগারে আছে। হিমাগার থেকে বারবার বলছে ভাড়া পরিশোধ করে ৭ দিনের মধ্যে আলু ওঠাতে। তিনি আরও বলেন, ইতোমধ্যে প্রায় ১ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। আবার যদি ৬ হাজার বস্তার ভাড়া দিতে হয়, তাহলে বর্তমান দামে আলু বিক্রি করে আরও ৪৪ লাখ টাকা লোকসান হবে। সে কারণে হিমাগারে যাতায়াত ছেড়ে দিয়েছি।

কালাইয়ের পুনট কোল্ডস্টোরেজের সহকারী ব্যবস্থাপক এনামুল হক বলেন, হিমাগারগুলোতে গড়ে এখনও সংরক্ষণের ২০ শতাংশ আলু এখন মজুত আছে। নতুন আলু বাজারে আসায় পুরাতন আলুর দাম ও চাহিদা কমে গেছে। আবার হিমাগারও পরিষ্কার করতে হবে। সবমিলে মালিকদের নির্দেশে আলু নিয়ে যেতে এলাকায় মাইকিং করা হয়েছে। সাথে ভাড়া পরিশোধের তাগিদও দেওয়া হয়েছে। তারপরও চাষি ও ব্যবসায়ীরা হিমাগারে আসছেন না। যদি না আসে তাহলে মেশিন বন্ধ করে আলু বাহিরে বের করে রাখা ছাড়া কোনো উপায় নেই।
জয়পুরহাট জেলা প্রশাসক আল মামুন মিয়া বলেন, বিষয়টি শুনেছি, সরকারের পক্ষ থেকে আগামী ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত হিমাগারে আলু সংরক্ষণ করতে বলা হয়েছে। তারপরও আলু বের করতে বাধ্য করা হলে হিমাগারগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
প্রতিনিধি/এসএস

