দেশীয় স্বাস্থ্য সেবায় আস্থা ফিরিয়ে আনতে কাঠামোগত সংস্কারের কোনো বিকল্প নেই বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি তাসকীন আহমেদ। তিনি বলেন, ‘মানসম্মত ও রোগীবান্ধব স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিতে এখনও দেশে নানামুখী কাঠামোগত দুর্বলতা রয়ে গেছে, যা জনস্বাস্থ্য নিরাপত্তা ও আস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।’
আজ শনিবার (১৩ ডিসেম্বর) ডিসিসিআই আয়োজিত এক সেমিনারে স্বাগত বক্তব্যে তাসকীন আহমেদ এসব কথা বলেন।
বিজ্ঞাপন
অনুষ্ঠানের স্বাগত বক্তব্যে তাসকীন আহমেদ বলেন, ‘সরকারি ও বেসরকারি খাতে স্বাস্থ্য সেবার মানের বৈষম্য, প্রশিক্ষিত জনবলের অভাব, অনুমোদনহীন ক্লিনিক ও ফার্মেসির বিস্তার, ভুল ডায়াগনস্টিক রিপোর্ট, ভুয়া ওষুধ, দুর্বল তদারকি এবং বিদ্যমান আইনের কার্যকর প্রয়োগে ঘাটতি দেশের স্বাস্থ্য খাতকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে।’
তিনি জানান, স্বাস্থ্য বিমা ব্যবস্থার কার্যকর প্রয়োগ না থাকায় মোট স্বাস্থ্য ব্যয়ের প্রায় ৭৪ শতাংশই জনগণের নিজ খরচে বহন করতে হচ্ছে, যা নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষের জন্য বড় আর্থিক ঝুঁকি।
তিনি আরও বলেন, ‘একটি টেকসই স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তুলতে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব জোরদার, আধুনিক চিকিৎসা প্রযুক্তির ব্যবহার, নার্সিং ও ল্যাব সায়েন্সসহ স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি এবং শক্তিশালী হেলথ রেগুলেটরি ফ্রেমওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য।’
ঢাকা চেম্বার আয়োজিত ‘বাংলাদেশের স্বাস্থ্য সেবা খাতে আস্থা বৃদ্ধি; মান নিয়ন্ত্রণে কৌশলগত কাঠামো নিশ্চিতকরণ’ শীর্ষক সেমিনারে বক্তারা বলেন, স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির মাত্র ১ শতাংশ বরাদ্দ, অপ্রতুল অবকাঠামো, আধুনিক প্রযুক্তির সীমিত ব্যবহার, দক্ষ মানবসম্পদের ঘাটতি, সেবা গ্রহণে উচ্চ ব্যয় এবং নীতিমালার দুর্বল তদারকির কারণে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন অর্জিত হয়নি। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকারি-বেসরকারি খাতের সমন্বয় ও জনগণের সম্পৃক্ততা বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়।
বিজ্ঞাপন
প্রধান অতিথির বক্তব্যে জাতীয় অধ্যাপক এ কে আজাদ খান বলেন, ‘বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি থাকলেও কাঙ্ক্ষিত মান এখনও অর্জিত হয়নি।’
তিনি আরও বলেন, ‘উন্নত দেশ তো দূরের কথা, অনেক ক্ষেত্রে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর তুলনায়ও বাংলাদেশ পিছিয়ে রয়েছে। ইউনিভার্সাল হেলথ কেয়ার নিশ্চিত করা কঠিন হলেও প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবার ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। পাশাপাশি ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন ও বিকেন্দ্রীকরণের কোনো বিকল্প নেই।’
এই জাতীয় অধ্যাপক বলেন, ‘ডিজিটাল হেলথ কেয়ার সম্প্রসারণের মাধ্যমে গ্রামীণ পর্যায়ে স্বাস্থ্য সেবা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব। একই সঙ্গে চিকিৎসা শিক্ষাক্রম আধুনিকায়ন ও গবেষণা কার্যক্রম জোরদারের জন্য সহায়ক পরিবেশ তৈরি করতে হবে।’
সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ইউনাইটেড হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ডিসিসিআই-এর প্রাক্তন ঊর্ধ্বতন সহ-সভাপতি মালিক তালহা ইসমাইল বারী। তিনি জানান, বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতে সরকারের জনপ্রতি বার্ষিক ব্যয় মাত্র ১০৭০ টাকা এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী প্রায় ৪৯ শতাংশ মানুষ মানসম্মত স্বাস্থ্য সেবা থেকে বঞ্চিত। যদিও বর্তমানে দেশের স্বাস্থ্য খাতের বাজার প্রায় ১৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ২০৩৩ সালে ২৩ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
তিনি বলেন, ‘স্বল্প বাজেট, অদক্ষ ব্যবস্থাপনা, শহর-গ্রামের বৈষম্য, দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মীর সংকট, বাড়তি চিকিৎসা ব্যয়, অপ্রতুল অবকাঠামো ও দুর্বল নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থা এ খাতের প্রধান প্রতিবন্ধকতা। উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রতিবছর প্রায় ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিদেশে ব্যয় হচ্ছে।’
সেমিনারের আলোচনায় বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ স্বাস্থ্য খাতে সরকারি হাসপাতালের মানোন্নয়ন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ, পিপিপি মডেলের কার্যকর ব্যবহার, দীর্ঘমেয়াদি টেকসই নীতিমালা প্রণয়ন এবং স্বাস্থ্য খাতের অর্থায়ন কৌশল নির্ধারণের ওপর জোর দেন।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন গ্রিন লাইফ সেন্টারের চিফ কনসালটেন্ট অধ্যাপক সৈয়দ আতিকুল হক, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ডা. দীপক কুমার মিত্র, ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের চেয়ারম্যান প্রীতি চক্রবর্তী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডা. শাফিউন নাহিন শিমুল, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজের সেক্রেটারি জেনারেল ডা. মো. জাকির হোসেন, আইসিডিডিআরবি, ইউনিসেফ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিনিধিরা।
সেমিনারের মুক্ত আলোচনায় ডিসিসিআই নেতৃবৃন্দ, শিক্ষাবিদ ও বেসরকারি খাতের প্রতিনিধিরা অংশ নেন।
এমআর/এফএ

