ভোগ্যপণ্যের বৃহৎ পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে উপচে পড়ছে ভোগ্যপণ্য। এরপরও চলছে বিপুল পণ্যের আমদানি। লক্ষ্য রমজানের বাজার ধরার প্রস্তুতি। ব্যবসায়ীরা জানান, দুই-আড়াই মাস আগে থেকেই পণ্য আমদানি শুরু করেছেন খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা।
ব্যবসায়ীদের মতে, আগামী বছর ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে রমজান শুরু হচ্ছে। সেই হিসেবে পাইকারি ব্যবসায়ীদের হাতে সময় আছে জানুয়ারি পর্যন্ত। কারণ রমজানের দুই সপ্তাহ আগে পাইকারিতে পণ্য বেচা-বিক্রি হ্রাস পায়। কারণ তখন এসব পণ্য চলে যায় খুচরা ব্যবসায়ীদের হাতে।
বিজ্ঞাপন
আমদানিকারকরা বলছেন, পণ্য বুকিং থেকে শুরু করে গুদামে আসা পর্যন্ত দেড় থেকে দুই মাস সময় লাগে। অনেক সময় বন্দর থেকে পণ্য ছাড় করতেও সময়ের প্রয়োজন হয়। রমজানের বাকি আছে আর দুই মাস। রমজানকে কেন্দ্র করে ইতোমধ্যে প্রচুর পরিমাণ ছোলা, মটর, মসুর ডাল ও ফল আমদানি হয়েছে। এছাড়া গত বছরের অনেক পণ্য গুদামে অবিক্রীত থেকে গেছে।
শনিবার (৬ ডিসেম্বর) খাতুনগঞ্জ ট্রেড ও ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু বক্কর এসব তথ্য জানান। তিনি বলেন, রমজানকে কেন্দ্র করে প্রতি বছর ব্যবসায়ীরা পর্যাপ্ত পরিমাণ পণ্য আমদানি করেন। এ বছরও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। ইতোমধ্যে বাজারে বিপুল পরিমাণ ছোলা আমদানি হয়েছে। যার ফলে গত বছরের এই সময়ের তুলনায় প্রতি কেজিতে ২০ টাকা পর্যন্ত কমে গেছে। এছাড়া অন্যান্য পণ্যের অবস্থাও একই। আন্তর্জাতিক বাজারে ভোগ্যপণ্যের কমছে, বর্তমানে খাতুনগঞ্জের পণ্যের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে কম।
রমজানের নিত্যপণ্যের তুলনামূলক বাজার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বর্তমানে প্রতি মণ অস্ট্রেলিয়ান ছোলা বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ২০০ টাকায়। কেজি হিসেবে দাম পড়ছে ৮৫ টাকা। এছাড়া গত বছর এই ছোলা বিক্রি হয়েছে ৯৫ টাকায়। প্রতি কেজি ভারতীয় ছোলা বিক্রি হচ্ছে ৯০ টাকা, গত বছর বিক্রি হয়েছে ১০৫ টাকায়। মোটা মসুর ডাল বিক্রি হচ্ছে ৭২ টাকা, গত বছর বিক্রি হয়েছে ৮৫ টাকায়। চিকন মসুর ডাল বিক্রি হচ্ছে ১৫০ টাকায়, যা গত বছর বিক্রি হয়েছে ১৪০ টাকা।
বিজ্ঞাপন
প্রতি কেজি খেসারির ডাল বিক্রি হচ্ছে ৭০ টাকায়, যা গত বছর বিক্রি হয়েছে ৯০ টাকায়। মটর ডাল বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৪২ টাকা, গত বছর বিক্রি হয়েছিল ৫৫ টাকায়। এছাড়া সাদা মটর বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৪২ টাকা, গত বছর বিক্রি হয়েছিল ৫৪ টাকায়। প্রতি কেজি মুগ ডাল বিক্রি হচ্ছে ৮২ টাকা, গত বছর বিক্রি হয়েছিল ১২৫ টাকায়।

অন্যদিকে বর্তমানে প্রতি মণ (৩৭.৩২ কেজি) সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ৬ হাজার ৬০০ টাকায়, যা গত বছর বিক্রি হয়েছিল ৬ হাজার ২০০ টাকায়। প্রতি মণ পাম তেল বিক্রি হচ্ছে ৫ হাজার ৭৮০ হাজার টাকায়, গত বছর বিক্রি হয়েছিল ৪ হাজার ৭০০ টাকায়।
প্রতিমণ চিনি বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ৩৫০ টাকা, কেজি হিসেবে দাম পড়ছে ৯০ টাকা। গত বছর বিক্রি হয়েছিল ১২০ টাকায়। গত বছর সাধারণ মানের খেজুর (১০ কেজি) বিক্রি হয়েছিল ১ হাজার ৬০০ টাকায়, বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৭০০ টাকায়।
খাতুনগঞ্জের আড়তদাররা জানান, রমজানকে কেন্দ্র করে ভোগ্যপণ্যের আমদানি আগের চেয়ে বেড়েছে। ব্যবসায়ীদের দোকান ও গুদামে প্রচুর পরিমাণ পণ্য মজুদ রয়েছে। বলতে গেলে আড়ত উপচে পড়ছে। রমজানে সাধারণত শরবতের চাহিদা বেড়ে যায়। তাই চিনির ব্যবহারও বাড়ে কয়েক গুণ। বর্তমানে বাজারে চিনির কোনো ঘাটতি নেই।
এছাড়া সারা দেশে প্রায় ৮০ হাজার টন ছোলার চাহিদা থাকে। অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়া থেকে প্রচুর পরিমাণে ছোলা এসেছে। এছাড়া এর বাইরে রমজানে সাদা মটর ও মসুর ডালেরও চাহিদা বেড়ে যায়। ভোজ্যতেল, চিড়া এবং খেজুরের চাহিদাও বৃদ্ধি পায়। সাধারণত খেজুর আমদানি হয় আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া, দুবাই ও সৌদি আরব থেকে। তাই এবার দাম সহনশীল থাকবে বলে আশা করা যায়।
বিএসএম গ্রুপের কর্ণধার আবুল বশর চৌধুরী বলেন, এ বছর ভোগ্যপণ্যের বাজার নিম্নমুখী। রমজানকে কেন্দ্র করে ব্যবসায়ীরা ভোগ্যপণ্য আমদানিতে সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছেন। এ বছর পণ্যের সরবরাহেও কোনো ঘাটতি নেই। ইতোমধ্যে দাম কমছে। সামনেও দাম আরো কমার সম্ভাবনা রয়েছে।
চাক্তাই খাতুনগঞ্জ আড়তদার সাধারণ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. মহিউদ্দিন ঢাকা মেইলকে বলেন, রমজানের তিন চার মাস আগে থেকে পণ্য আমদানির জন্য ব্যবসায়ীরা এলসি (ঋণপত্র) খোলেন। ইতোমধ্যে অনেক পণ্যের চালান গুদামে এসে পৌঁছেছে। আমাদের দেশে প্রতি বছর ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বাড়ছে। আবার তার সাথে পাল্লা দিয়ে আমদানির পরিমাণও বাড়ছে। বাজারে রমজানের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বিশেষ করে ছোলা, মটর ডাল, মশুর ডাল, খেসারি ডাল এবং চিনির কোনো ঘাটতি নেই। প্রত্যেক ব্যবসায়ীর দোকান গুদামে পর্যাপ্ত পণ্য আছে।
এই ব্যবসায়ী বলেন, তবে আমাদের একমাত্র সমস্যা হচ্ছে ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কের ওজন নিয়ন্ত্রণ স্কেল। ওজন স্কেলের কারণে আমাদের খাতুনগঞ্জ থেকে এখন আর ব্যবসায়ীরা পণ্য নিতে আসেন না। কারণ এখান থেকে একটি ট্রাকে ১৩ টনের বেশি পণ্য পরিবহন করতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা। ফলে তা পণ্যের দামের ওপর প্রভাব পড়ছে।
চট্টগ্রাম বন্দর সূত্র জানায়, রমজানকে ঘিরে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ভোগ্যপণ্যের আমদানি বেড়েছে। ফল, ডাল, ভোজ্য তেল আর মসলাজাতীয় পণ্য আমদানির গতি গত বছরের তুলনায় ভালো। এখনো রমজানকে ঘিরে পণ্য আমদানির জন্য এলসি খুলছেন ব্যবসায়ীরা। বর্তমানে পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে ভোগ্যপণ্যের বাজার নিম্নমুখী। আরও তিন মাস ভোগ্যপণ্য আমদানি হবে।

চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর, অক্টোবর মাসে ভোগ্যপণ্য আমদানির চিত্র যাচাই করে দেখা গেছে, ফল, ডাল, ভোজ্য তেল আর মসলাজাতীয় অন্তত ২২ ধরনের পণ্য গত বছরের একই সময়ের তুলনায় বেশি আমদানি হয়েছে। বিশেষ করে আপেল, কমলা, নাশপাতি, খেজুর, ছোলা, সয়াবিন, এলাচ, জিরা, কিশমিশ, গোলমরিচ ও আদার আমদানি ভালোই দেখা গেছে। চলতি বছর রমজানকে ঘিরে সেপ্টেম্বর, অক্টোবর মাসে ৫ লাখ ৩০ হাজার ৫২১ টন ভোগ্যপণ্য আমদানি হয়েছে। যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৮ হাজার ৭৯৪ টন বেশি।
চলতি বছরের সেপ্টেম্বর, অক্টোবর মাসে ২৪ হাজার ৬৮৪ টন আপেল আমদানি হয়েছে। যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৭ হাজার ৮০৯ টন বেশি। বছরের ব্যবধানে ১৬ হাজার ৩৪১ টন বেড়ে কমলা আমদানি হয়েছে ৪৮ হাজার ২০৭ টন, ৯১৪ টন বেড়ে আঙ্গুর এসেছে ১২ হাজার ৫৩২ টন, ৪৬৬ টন বেড়ে নাশপাতি এসেছে ১ হাজার ২৪৮ টন। রমজানের অন্যতম উপাদান খেজুর ২ হাজার ৩৮৫ টন বেড়ে আমদানি হয়েছে ৪ হাজার ১৬৯ টন, ২ হাজার ৫৭৯ টন বেড়ে ছোলা এসেছে ৬ হাজার ৪৭ টন, ৪৩ হাজার ৯৭৫ টন বেড়ে সয়াবিন এসেছে ২ লাখ ৪১ হাজার ১৭২ টন। মসলা পণ্যের মধ্যে ১৫৩ টন বেড়ে এলাচ এসেছে ৩১২ টন, ৭০৯ টন বেড়ে দারুচিনি এসেছে ১ হাজার ৮৩৬ টন, ১৫২ টন বেড়ে জিরা এসেছে ৩১১ টন, ৩৫ টন বেড়ে জয়ত্রী এসেছে ৬৫ টন, ৪৪১ টন বেড়ে গোলমরিচ এসেছে ৪৮২ টন, ৫ হাজার ২৬৯ টন বেড়ে আদা এসেছে ১০ হাজার ১৬৫ টন।
তাছাড়া চলতি বছরের সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর এই দুই মাসে ১২৪ টন আলু বোখারা, ১৫ হাজার ৪৮১ টন মসুর ডাল, ৯৯০ হাজার ১৫১ টন মটর ডাল, ৫৫ হাজার ৭০৩ টন সরিষা, ৯১ টন লবঙ্গ, ১ হাজার ৮৫৩ টন কিশমিশ, ৬ হাজার ৭২৬ টন রসুন ও ১২০ টন হলুদ আমদানি হয়েছে।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ চট্টগ্রাম মহানগরের সভাপতি জেসমিন সুলতানা পারু ঢাকা মেইলকে বলেন, আমদানি ও মজুদ সন্তোষজনক। সরকারও অনেক পণ্যের আমদানি শুল্ক কমিয়েছে। বন্দরের বর্ধিত শুল্ক এক মাসের জন্য স্থগিত রয়েছে। সবদিক বিবেচনায় সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকার কথা। এখন এটা নির্ভর করবে রমজানের আগে বা শুরুতে ব্যবসায়ীরা পণ্যের সরবরাহ লাইনটা ঠিক রাখে কি না। যদি সরবরাহ লাইন ঠিক থাকে তাহলে ভোগ্যপণ্যের সরবরাহ সংকট বা দাম বাড়ার কোনো সুযোগ নেই। তাই রমজানের আগে সরকারকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দিকে গুরুত্ব দিতে হবে। স্থানীয় প্রশাসন নির্বাচনকে ঘিরে ব্যস্ত থাকবে। এর মাঝেও জেলা, উপজেলা প্রশাসন, ভোক্তা অধিকার, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ যদি বাজার তদারকি অব্যাহত রাখে তাহলে সাধারণ মানুষ রমজানকেন্দ্রিক পণ্য কিনতে স্বস্তি পাবে।
আইকে/জেবি

