রোববার, ৭ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

ফড়িয়ার বেড়াজালে ভোগ্যপণ্য, চিড়ে চ্যাপ্টা কৃষক-ভোক্তা

ইব্রাহিম খলিল, চট্টগ্রাম
প্রকাশিত: ০১ মে ২০২৫, ০৭:২৫ এএম

শেয়ার করুন:

ফড়িয়ার বেড়াজালে ভোগ্যপণ্য, চিড়ে চ্যাপ্টা কৃষক-ভোক্তা

শুধু ব্যবসা নয়, শস্যভাণ্ডার হিসেবেও খ্যাত বন্দরনগরী চট্টগ্রাম। জেলার ১৫ উপজেলার প্রতিটিতে আবাদ হয় প্রচুর ধান-চাল, ডাল, সবজি ও ফল-ফলাদি। লবণ ও মাছ উৎপাদনের প্রাকৃতিক উৎসও চট্টগ্রাম। আবার ভোজ্যতেল, পেঁয়াজ, গমসহ নানা ভোগ্যপণ্যের আমদানি আসে এই চট্টগ্রামে।

কিন্তু চট্টগ্রামে এসব ভোগ্যপণ্যের দাম মোটেও স্বাভাাবিক নয়। এমনকি দেশের কোনো কোনো এলাকার চেয়ে এসব ভোগ্যপণের দাম অনেক বেশি চট্টগ্রামে। এর মূলে সরবরাহে কারসাজি। যার কারিগর মধ্যস্বত্বভোগীরা। যাদের বেড়াজালে এসব ভোগ্যপণ্য উৎপাদনকারী কৃষক যেমন প্রতিনিয়ত ছিড়ে চ্যাপ্টা হচ্ছে, তেমনি চ্যাপ্টা হচ্ছে ভোক্তাও।


বিজ্ঞাপন


এমন অভিযোগ শুধু উৎপাদনকারী কৃষক, আমদানিকারক বা ভোক্তা নয়, খোদ বাজার মনিটরিংয়ের দায়িত্বে থাকা বেসরকারি সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) নেতারাও করেছেন। বাজারের সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে মধ্যস্বত্বভোগী অসাধু ফড়িয়া ব্যবসায়ীদের কারসাজির প্রমাণও সামনে নিয়ে এসেছেন ক্যাব নেতারা।

ক্যাব চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সভাপতি জেসমিন সুলতানা পারু বলেন, চট্টগ্রামে আমদানি করা ভোগ্যপণ্য পাইকারি দরে বিক্রি হয় চাক্তাই-খাতুনগঞ্জে। পাইকারি চাল বিক্রি হয় পাহাড়তলী বাজারে। সবজি বিক্রি হয় রিয়াজুদ্দিন বাজারে। দেখা যায়, এসব বাজারে হাজার হাজার বেপারির অবস্থান। যাদের সঙ্গে ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ দেশের সবকটি জেলায় ২০ থেকে ২৫ জন আড়তদারের চুক্তি থাকে।

আবার এসব বেপারি চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের কৃষকদের কাছে অগ্রিম টাকা দিয়ে ফসলি জমি কিনে রাখেন। পরে ওই জমিতে উৎপাদিত ফসল আড়তদারদের কাছে পৌঁছে দেন। এই আড়তদাররাই জমি কেনার টাকা দেন ফড়িয়া ব্যবসাায়ীদের। আর বিনিময়ে আড়তদাররা সব ধরনের সবজিতে কেজিপ্রতি ৬ টাকা ৪ আনা কমিশন পান। আড়তদারদের কাছ থেকে খুচরা ব্যবসায়ীরা কিনে নেন। সেখান থেকে ভোক্তাপর্যায়ে পৌঁছায়। এভাবে হাতবদলের কারণে সবজির দাম কয়েকগুণ বেড়ে যায়।

বিষয়টি স্বীকার করেছেন রিয়াজুদ্দিন বাজারের আড়তদার কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফারুক শিবলীও। তিনি বলেন, কৃষকরা সরাসরি আমাদের কাছে সবজি বিক্রি করতে পারেন না। বেপারির মাধ্যমে বিক্রি করতে হয়। বেপারিরা চট্টগ্রামের সবজি ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে নিয়ে যায়। এতে সংকটও সৃষ্টি হয়। গ্রীষ্মকাল এলে যখন ফলন কমে যায় বা গরমে নষ্ট হয় তখন সবজির দাম অত্যধিক বেড়ে যায়।

তিনি বলেন, বর্তমানে চট্টগ্রামে সবজির বাজার একেবারে অস্থির। কাঁকরোল, ঝিঙা কেজিপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকার ওপরে। কচুরলতি ৯০ টাকা এবং পটল, করলা, ঢেড়শ, বরবটি ও চিচিঙ্গা কিনতে গুনতে হচ্ছে কেজিতে ৭০ টাকার বেশি। অথচ ফড়িয়া ব্যবসায়ীরা উৎপাদনকারী কৃষক থেকে ৩০-৩৫ টাকার নিচে কিনেছে সব সবজি।

চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড উপজেলার কৃষক আবু হানিফ বলেন, আমি ২০ শতক জমিতে কাকরোল চাষ করেছি। ফলনও হয়েছে ভালো। কিন্তু দাম পাচ্ছি না। বাজারে ১২০ টাকা কেজিতে কাকরোল বিক্রি হলেও আমরা পাই কেজিপ্রতি ৩০ টাকা। বেপারিদের কাছ থেকে নেওয়া অগ্রিম টাকায় চাষ করায় তাদের ইচ্ছার ওপর কোনো রকম কথা বলা সম্ভব হয় না বলে জানান তিনি।

একই অবস্থা পেঁয়াজের ক্ষেত্রেও। দেশীয় পেঁয়াজ এখন খুচরায় বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ৫০ থেকে ৫৪ টাকায়। যা কৃষক পর্যায়ে দাম মিলছে ১৪ থেকে ১৫ টাকায়। চট্টগ্রামে আবার তেমন পেঁয়াজ উৎপাদন হয় না। মেহেরপুর, রাজবাড়ী, পাবনাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মধ্যস্বত্বভোগীরা কৃষকের কাছ থেকে কম দামে পেঁয়াজ কিনে মজুত করে রেখেছেন। এখন তা বেশি দামে বাজারে ছাড়ছেন। এর প্রভাব পড়ছে ভোক্তাপর্যায়ে। অন্যদিকে ভারতীয় পেঁয়াজ খুচরায় বিক্রি হচ্ছে ৫৫-৫৮ টাকায়। যা ক্রয় পর্যায়ে ২৪-২৫ টাকায় কিনছে আমদানিকারকরা।

হামিদুল্লাহ মিয়া মার্কেট ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. ইদ্রিস বলেন, মধ্যস্বত্বভোগীর অস্তিত্ব নতুন কিছু নয়। সেই পাকিস্তান আমল থেকে এর চর্চা হয়ে আসছে। একসময় মধ্যস্বত্বভোগীর ভূমিকা কম ছিল, এখন বেড়েছে। আর তাদের ছাড়া কৃষকের কোনো পণ্যই বিক্রি করার সুযোগ নেই। গাড়ি ভাড়া বৃদ্ধিও পণ্যের দাম বাড়ার জন্য কিছুটা দায়ী।

এদিকে মাসের ব্যবধানে প্রতি কেজি জিরাশাইল চালের দাম ১৪ টাকা বেড়ে ৮৪ টাকা, নাজিরশাইল ১২ টাকা বেড়ে ৮৮ টাকা, কাটারি সেদ্ধ চাল ১৪ টাকা বেড়ে ৮৬ টাকা, মিনিকেট আতপ চাল ১০ টাকা বেড়ে ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে মোটা চাল, গুটি স্বর্ণা, ভারতীয় সেদ্ধ চাল, পাইজাম ও বেতি চাল বিক্রি হচ্ছে আগের দরে। প্রতি কেজি মোটা চাল ৪৬ টাকা, গুটি স্বর্ণা ৫০, ভারতীয় সেদ্ধ চাল ৫৫, পাইজাম ৫৬ ও বেতি চাল ৫৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

পাহাড়তলী বণিক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক এস এম নিজামউদ্দিন ঢাকা মেইলকে বলেন, মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে চালের দাম বেড়ে যায়। ভরা মৌসুমে ধান মজুত করে পরে চড়া দামে বিক্রি করেন তারা। বাজারেও এর প্রভাব পড়ে। বোরো ধান মাত্র উঠতে শুরু করেছে। আশা করা যায়, ১৫ থেকে ২০ দিনের মধ্যে চালের দাম কমে আসবে।

এদিকে কয়েক মাস আগেও খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি ১৭০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। বর্তমানে ১৮০ থেকে ১৮৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। খুচরায় মুরগির ডিম (বাদামি) ডজনপ্রতি ১০ টাকা বেড়ে ১৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

আরও পড়ুন-

খাদ্যে কমলেও কিছুটা বেড়েছে সার্বিক মূল্যস্ফীতি

বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদার ঢাকা মেইলকে জানান, বর্তমানে একটি ডিম উৎপাদন করতে ১০ টাকার ওপর খরচ পড়ে। কিন্তু বিক্রি করতে হচ্ছে ৮ টাকায়। কারণ ডিম উৎপাদন করলেও কোনো খামারি ডিমের দাম নির্ধারণ করতে পারেন না। মধ্যস্বত্বভোগীরাই দাম নির্ধারণ করে কিনে নেন। তারাই পরে তা পাইকারের কাছে বিক্রি করেন। সেখান থেকে খুচরা পর্যায়ে যায়। এটা একটা সিস্টেমে পরিণত হয়েছে। এর ওপর বড় ফার্মগুলো মুরগির বাচ্চা বাড়তি দরে বিক্রি করছে। এ কারণে মুরগির বাজারদরটাও বাড়তি।

ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ার পেছনে পাইকারি ব্যবসায়ীরাও দায়ী। এ কারণে কৃষক লবণের ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না। চাক্তাই, মাঝিরঘাট ও বাংলাবাজার এলাকার পাইকারি লবণ বিক্রেতারা প্রতি কেজি লবণে ২ টাকা বাড়িয়ে ৯ টাকায় বিক্রি করছেন। বস্তাপ্রতি (৭৪ কেজি) ১৪০ টাকা দাম বাড়িয়ে ৬৫০ টাকায় বিক্রি করছেন। দাম বাড়ানোর পেছনে দেখিয়েছেন সরবরাহ সংকটের অজুহাত।

বিশ্ববাজারে গমের দাম কমে এসেছে। কিন্তু পাইকারি ব্যবসায়ীরা সরবরাহ সংকটের অজুহাতে প্রতি কেজি গমে ৩ টাকা বাড়িয়ে ৩৪ টাকায় বিক্রি করছেন। বস্তা ১১০ টাকা বাড়িয়ে বিক্রি করা হচ্ছে ১ হাজার ৪০০ টাকায়।

এদিকে দুই সপ্তাহের ব্যবধানে খাতুনগঞ্জে প্রতি লিটার পাম অয়েলে ১২ টাকা ৬ পয়সা বেড়ে ১৩৯ টাকা ৮৭ পয়সা এবং লিটারপ্রতি ৭ টাকা ২৩ পয়সা বেড়ে সয়াবিন তেল ১৫১ টাকা ৯২ পয়সায় বিক্রি হচ্ছে। মণপ্রতি হিসাবে, দুই সপ্তাহের ব্যবধানে পাম অয়েলে ৫০০ টাকা ও সয়াবিনে ৩০০ টাকা বেড়েছে। অথচ সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী খুচরা পর্যায়ে প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৮৯ টাকায়, খোলা সয়াবিন তেল ১৬৯ টাকায় বিক্রি করার কথা। কিন্তু বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৯০ থেকে ১৯৫ টাকা ও খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে প্রতি লিটার ১৮০ টাকারও বেশি দামে।

খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের আইনবিষয়ক সম্পাদক এবং চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ আড়তদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. মহিউদ্দিন দাবি করেন, খাতুনগঞ্জে অধিকাংশ ভোগ্যপণ্যের দাম নিম্নমুখী। তবে বিশ্ববাজারে দাম বাড়লে এখানে বেড়ে যায়। বিশ্ববাজারে কমে গেলে এখানেও কমে। এখানে মধ্যস্বত্বভোগীর হাত নেই বলে দাবি করেন তিনি।

কিন্তু তার এই দাবির সঙ্গে একমত নন ক্যাবের কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন। তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়, মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণেই বাজারে ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ছে। বিশ্ববাজারে কোনো একটা পণ্যের দাম কমলে আমাদের ব্যবসায়ীরা আর সে পণ্যের দাম কমান না। এখন খুচরা ব্যবসায়ীরাও অতি মুনাফালোভী হয়ে উঠেছেন। এসব ব্যাপারে সরকারকে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কঠোরভাবে বাজার তদারকি করতে হবে। ব্যবসায়ীদেরও দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ের উপপরিচালক ফয়েজ উল্যাহ ঢাকা মেইলকে বলেন, আমাদের জনবল সীমিত। তবু আমরা বিভিন্ন বাজার তদারকি করছি। কারসাজি পেলেই জরিমানা ও সতর্ক করছি। বিভিন্ন বাজারের ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করছি। আমরা আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছি।

আইকে/জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর