• কলমানিতে ধার বেড়েছে ৬৩ হাজার কোটি
• ওভার নাইট ধার বৃদ্ধি ৫০ হাজার কোটি টাকা
• রেপোতে ধার বেড়েছে ৫৮ হাজার ৭৫৩ কোটি
• এসএলএফ সুবিধা কমেছে ৫২ হাজার ৬১৯ কোটি
• ব্যবস্থাপনা সংকটেই কলমানিতে ঝোঁক: বিশেষজ্ঞ
বিজ্ঞাপন
দেশে দীর্ঘদিন ধরেই চরম তারল্য সংকটে ভুগছে ব্যাংক খাত। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ব্যাংক খাতে নগ্ন হস্তক্ষেপে ব্যাংকের বিপুল পরিমাণ অর্থ লুটপাট হয়েছে। যার কারণেই প্রকট হয় তারল্য সংকট। সেই তারল্য ঘাটতি মেটাতে ব্যাংকগুলো নিরুপায় হয়ে স্বল্পকালীন (কলমানি) ঋণে অতিরিক্ত ঝুঁকে পড়েছে। আর চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত সেই বৃদ্ধির হার অনেকটা উদ্বেগজনক পর্যায়ে গিয়ে ঠেক খেয়েছে। মাত্র এক বছরের (অক্টোবর টু অক্টোবর) ব্যবধানে কলমানি ঋণ বেড়েছে প্রায় ৬৩ হাজার ২৪৮ কোটি টাকা। তার মধ্যে একই সময়ে শুধু ওভার নাইট ধার বেড়েছে ৪৯ হাজার ৯৩২ কোটি টাকা। পাশাপাশি আন্তঃব্যাংক রেপোতে ধার বেড়েছে ৫৮ হাজার ৭৫৩ কোটি টাকা। মূলত নগদ টাকার চাহিদা মেটাতে চড়া সুদে স্বল্পকালীন ঋণ করায় অধিকাংশ ব্যাংক অস্বস্তিকর সময় পার করছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
বিজ্ঞাপন
কলমানি মার্কেট হলো এমন একটি আর্থিক বাজার যেখানে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো একে অপরের কাছ থেকে স্বল্প সময়ের জন্য (সাধারণত এক দিন বা রাতারাতি) টাকা ধার বা ঋণ নেয়। এটি ব্যাংকগুলোর দৈনন্দিন নগদ অর্থের চাহিদা মেটানোর জন্য ব্যবহৃত হয়, যেখানে কোনো ব্যাংকের নগদ টাকা কম থাকলে অন্য ব্যাংকের কাছ থেকে অতিরিক্ত তারল্য ধার নেওয়া হয় এবং এর বিপরীতে একটি নির্দিষ্ট হারে সুদ দিতে হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে অনুযায়ী, চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের গত অক্টোবর মাসে কলমানিতে একদিন থেকে এক বছর পর্যন্ত সময়ের জন্য ধার করেছে ১ লাখ ৪৩ হাজার ২৭১ কোটি টাকা। যা গত অর্থবছরের একই মাসে ছিল ৮০ হাজার ২৩ কোটি টাকা। সেই হিসাবে মাসের ভিত্তিতে এক বছরের ব্যবধানে কলমানিতে ধার বেড়েছে ৬৩ হাজার ২৪৮ কোটি টাকা। তার মধ্যে একদিনের জন্য ওভার নাইটে ধার গত অক্টোবরে ছিল ১ লাখ ২১ হাজার ৯৮৮ কোটি টাকা। যা তার আগের বছর অক্টোবরে ছিল ৭২ হাজার ৫৬ কোটি টাকা। সেই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে ওভার নাইট ধার বেড়েছে ৪৯ হাজার ৯৩২ কোটি টাকা। গত অক্টোবরে কলমানির সুদহার ছিল ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি দুর্বল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ঢাকা মেইল বলেন, ‘এখন কিছু ব্যাংকের কাছেই অতিরিক্ত তারল্য রয়েছে। তবে অন্য ব্যাংকগুলো ব্যাংক দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে, তারাই ধার নিচ্ছে। এখন যেসব ব্যাংকের ধার প্রয়োজন, তাদের বেশির ভাগেরই পর্যাপ্ত জামানত নেই। তারা কলমানির ধারের টাকায় ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে।’
তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের অক্টোবর মাসে ২ থেকে ১৪ দিনে জন্য শর্ট নোটিশে ধারের পরিমাণ ছিল ১৯ হাজার ৪৬৩ কোটি টাকা। যা গত অর্থ বছরের একই মাসে ছিল ৬ হাজার ৫৪১ কোটি টাক। সেই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে (মাস থেকে মাসে) ১২ হাজার ৯২২ কোটি টাকা। একইভাবে ১৫ দিন থেকে এক বছরের কম সময়ের জন্য টার্ম কল ঋণ গত অক্টোবরে ছিল ১ হাজার ৮২০ কোটি টাকা। যা ২০২৪ সালের অক্টোবরে ছিল ১ হাজার ৪২৬ কোটি টাকা। সেই হিসাবে অক্টোবর টু অক্টোবর সময়ে এক বছরের ব্যবধানে ঋণ বেড়েছে ৩৯৪ কোটি টাকা। এই সময় সুদ হার ছিল ১০ দশমিক ১৩ শতাংশ।
গত অক্টোবরে কলামানির মধ্যে ওভার নাইটের গড় সুদ হার (ডব্লিইএআর) ছিল ৯ দশমিক ৮১ শতাংশ, শর্টনোটিশের গড় সুদের হার ছিল ১০ দশমিক ১৩ শতাংশ এবং টার্ম কলে সুদের হার ছিল ১০ দশমিক ৭০ শতাংশ। আর আন্তঃব্যাংক রেপোতে সুদের গড় হার ছিল ৯ দশমিক ৮৮ শতাংশ। আর চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের অক্টোবর মাসে আন্তঃব্যাংক লেনদেনের পরিমাণ ছিল ৭১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। যা আগের অর্থবছরের একই মাসে ছিল ১৩ হাজার ৩২ কোটি টাকা। সেই হিসাবে গত বছরের অক্টোবর থেকে চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত এক বছরের ব্যবধানে ৫৮ হাজার ৭৫৩ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও সৈয়দ মাহবুবুর রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘পলিসি রেট বাড়ার প্রভাব কলমানি মার্কেটে পড়েছে। এখন ঋণের খরচ বেড়েছে। অনেক ব্যাংক নগদ টাকার চাপ সামলাতে চড়া সুদে ঋণ করে ব্যাংকিং কার্যক্রম স্বাভাবিক রেখে সুনাম ধরে রার রাখার পেরেছে। যার ফলে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বিনিয়োগ কমায় ঋণের চাহিদা কমেছে। যদিও একেবারে দুর্বল ব্যাংকগুলো নতুন তারল্য সহায়তা পাওয়ায় তারা কলমানিতে ধার কম নিচ্ছে।’
ব্যাংক খাতে নগদ টাকার ব্যবস্থাপনায় বড় সংকটের কারণেই কলমানির প্রবণতা বড়ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরি ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘বর্তমানে ব্যাংক খাতে নগদ টাকার ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের সংকট রয়েছে। ডলারের দাম বাড়ায় ব্যাংকে তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে। এই সংকটের মোকাবিলা করতে এক ব্যাংক অন্য ব্যাংক থেকে চড়া সুদেও টাকা ধার নিচ্ছে। কারণ বাজারে খুব বেশি তারল্য নেই। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকও রেপোর নিলাম কমিয়ে দিয়েছে। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলো খুব বেশি টাকা ধার করতে পারছে সব মিলে কলমানি বাজারে চড়া সুদে যেসব ব্যাংক টাকা ধার নিয়ে ধার পরিশোধে হিমশিম খাচ্ছে। কিন্তু কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখতে কলমানিতে সুদহার বেশি হলেও নিরুপায় হয়ে কলামানিতে লেনদেন করে অস্বস্তিতে পড়েছে ব্যাংকগুলো।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, সরকারের পালাবদলের পর নতুন নীতিমালায় নেওয়ায় বিশেষ তারল্য সহায়তা (এসএলএফ) সুবিধা চলতি অর্থবছরের অক্টোবরে ছিল মাত্র ১৮ হাজার ১৮৬ কোটি টাকা। যা গত অর্থবছরের একই মাসে ছিল ৭০ হাজার ৮০৫ কোটি টাকা। সেই হিসাবে অক্টোবর থেকে অক্টোবর এক বছরের ব্যবধানে এসএলএফ সুবিধা কমেছে ৫২ হাজার ৬১৯ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘ডলারের দর বেড়েছে। এতে টাকার মূল্য হ্রাস পেয়েছে। এতে কিছু ব্যাংক তারল্য সংকটে পড়েছে। বিশেষ করে দুর্বল ব্যাংকগুলো তারল্য সুবিধা নিচ্ছে। স্বাভাবিক চাহিদা পূরণকরতে কলমানিতে ধার করছে। যার পুরোটা বাজারের ওপর নির্ভর করে। চাহিদা বাড়লে ধার বাড়ে আবার চাহিদা কমলে ধার কমে।’
টিএই/জেবি

