# জড়িত বায়িং হাউস চক্রও।
# সংকটে মালিকরা, বন্ধ হচ্ছে কারখানা।
বিজ্ঞাপন
# প্রতারণা রোধে সরকার ও বিজিএমইএর হস্তক্ষেপ কামনা
দেশের তৈরি পোশাক রফতানি করে বিপুল আয় হলেও অনেক গার্মেন্টসের মালিকরা পাচ্ছেন না তাদের অর্থ। এই সেক্টরের অন্তত ৭ বিলিয়ন ডলার লোপাট করেছেন বিদেশি বায়ররা। তাদের সঙ্গে জড়িত দেশীয় বায়িং হাউস চক্রের কারণে এই সেক্টরে সৃষ্টি হয়েছে সংকট। শুধু যে কারখানার ব্যবসা ধুঁকছে তা নয়, অনেক প্রতিষ্ঠানই বন্ধ হয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছে। চট্টগ্রামের এক গার্মেন্টস মালিক এই প্রতারণার শিকার হওয়ার পর আবারও আলোচনার জন্ম দিয়েছে, যা গার্মেন্টস খাতের বিশ্বাসযোগ্যতার জন্য বড় হুমকি হিসেবে দেখা যাচ্ছে।
প্রতারণার শিকার পোশাক কারখানাটি হলো চট্টগ্রাম মহানগরীর সিরাজউদ্দৌলা রোডে তৈরি পোশাক রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান কে গার্মেন্টস লিমিটেড।
প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিজয় শেখর দাশ বলেন, বিদেশি বায়ার ও এদেশীয় বায়িং হাউসের মাধ্যমে তার প্রতিষ্ঠানের বিপুল আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। বিজিএমইএ বরাবর প্রেরিত চিঠিতে তিনি জরুরি হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
বিজ্ঞাপন
বিজয় শেখর দাশ জানান, চট্টগ্রাম মহানগরীর সিরাজউদ্দৌলা রোডের কে গার্মেন্টস কারখানায় উৎপাদিত তৈরি পোশাক বন্দরে জাহাজিকরণসহ সবকিছু ঠিকভাবে করা হয়। ২ লাখ ৩৬ হাজার ৪০৫ ডলার বা প্রায় ২ কোটি ৭৮ লাখ টাকা দামের দুই কন্টেইনার পণ্য আলজেরিয়ার মাজারিন গ্রুপ নামের একটি বায়িং হাউজের মাধ্যমে রফতানি করা হয়।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি ও জুন মাসে আলজেরিয়ার ওরান বন্দরের উদ্দেশ্যে দুই কন্টেইনার তৈরি পোশাক পাঠান। কার্গোগুলো যথাসময়ে গন্তব্য বন্দরে পৌঁছালেও এখনো পর্যন্ত কোনোটিই গ্রাহকপক্ষ গ্রহণ করেনি। আলজেরিয়ার মাজারিন গ্রুপ নামের একটি বায়িং হাউস নকল পেমেন্ট কাগজপত্র দেখিয়ে বন্দরে থাকা পণ্য ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। বিষয়টি আঁচ করতে পেরে রফতানিকারক চালান দুটির খালাস কার্যক্রম বন্ধ করে দিলে ওরান বন্দর কর্তৃপক্ষ কন্টেইনার দুটি আটকে দেয়।
একইসঙ্গে অভিযোগ উঠেছে, দুবাইভিত্তিক ক্রেতার কাছ থেকে ওই পণ্যের পূর্ণমূল্য ইতোমধ্যে গ্রহণ করেছে তারা। কিন্তু কে গার্মেন্টসকে এক টাকাও পরিশোধ করেনি।
বিজয় শেখর দাশ চিঠিতে উল্লেখ করেন, এটি কেবল আমার প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি নয়, বাংলাদেশের রফতানি খাতের সুনাম ও বিশ্বাসযোগ্যতার প্রতি চরম হুমকি। বিষয়টি দ্রুত সমাধানে বিজিএমইএর সদয় হস্তক্ষেপ জরুরি।
তিনি জানান, দুটি কন্টেইনারের বিপরীতে রফতানির পেমেন্টের সময়সীমা ইতোমধ্যে অতিক্রান্ত হয়েছে, যা ব্যাংকিং ও বৈদেশিক মুদ্রা ফেরত আনার নিয়মের ক্ষেত্রে একটি সংকট তৈরি করেছে। দেশ থেকে তৈরি পোশাক রফতানির প্রক্রিয়ায় শিপিং এজেন্ট ও ফ্রেইট ফরোয়ার্ডারসহ নানা প্রতিষ্ঠান জড়িত থাকে। অনেক সময় রফতানিকারকদের সঙ্গে ক্রেতাদের সরাসরি যোগাযোগ হয় না। মাঝখানে বায়িং এজেন্ট মধ্যস্থতা করে। রফতানি পণ্য বুঝে নিয়ে জাহাজ কোম্পানিগুলো গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দেয়। আর ডেলিভারি এজেন্ট হিসেবে ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার আমদানিকারকের হাতে সে পণ্য তুলে দেয়। সেক্ষেত্রে আমদানিকারককে পণ্য ডেলিভারি নেওয়ার আগে ব্যাংকে রফতানি পণ্যের মূল্য পরিশোধসহ সব প্রক্রিয়া শেষ করে শিপিং এজেন্টকে রফতানি বিলের কপি জমা দিতে হয়।
কে গার্মেন্টস লিমিটেডের ক্ষেত্রে মধ্যস্থতাকারী বায়িং হাউজ জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে প্রায় তিন কোটি টাকা আত্মসাৎ করতে চাচ্ছে। এ ধরনের অনেক ঘটনা দেশের পোশাক শিল্প খাতে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করেছে। ইতোমধ্যে অনেক গার্মেন্টস মালিক প্রতারিত হয়ে কারখানা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন।
কে গার্মেন্টসও সংকটে পড়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে কারখানা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বিদ্যমান পরিস্থিতির সুরাহা না হলে আগামী মাস থেকে কারখানা চালু রাখা তাদের পক্ষে সম্ভব হবে না।
এর আগে চট্টগ্রামের মেলো ফ্যাশন নামে আরেকটি গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৪ কোটি টাকার পণ্য আমেরিকার বায়ার ব্যাংক ডকুমেন্ট ছাড় না করে শিপিং কোম্পানি ও ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স কর্তৃক ব্যাংক ডকুমেন্ট ছাড়া বায়ারকে পণ্য সরবরাহ করে।
মেলো ফ্যাশন স্থানীয় আদালতে শিপিং কোম্পানি ও ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্সের বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলা করলে পিবিআই তদন্ত শেষে শিপিং কোম্পানি ও ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্সকে দায়ী করে যোগসাজসে পণ্য খালাস নেয় বলে প্রতিবেদন দিয়েছে।
মেলো ফ্যাশনের পরিচালক এবং বিজিএমইএর পোর্ট অ্যান্ড শিপিংয়ের ডিরেক্টর ইনচার্জ সাইফ উল্ল্যাহ মনসুর জানান, দেশের টাকা এভাবে বিদেশি প্রতারকরা লুটে নিয়ে বিপুল সংখ্যক গার্মেন্টস মালিককে পথে বসিয়েছে। তিনি এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর, বিজিএমইএ, কাস্টমস, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনকে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানান।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন চেম্বারের সহসভাপতি এবং গার্মেন্টস ব্যবসায়ী এ এম মাহবুব চৌধুরী নিজেও এমন দুটি প্রতারণার শিকার হয়েছেন বলে জানান।
তিনি জানান, তার চার লাখ ডলারের পণ্য নিয়ে গেলেও এক টাকা পরিশোধ করেনি। বিষয়টি নিয়ে নানাভাবে দেনদরবার এবং মামলা করেছেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত বিদেশে আটকে থাকা টাকা উদ্ধার করতে পারেননি।
মাহবুব চৌধুরী জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান বরাবরে লিখিত এক পত্রে রফতানির বিপরীতে বিদেশ থেকে টাকা ফেরত না আসার বিষয়ে উল্লেখ করেছেন। তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকসহ কাস্টমস, বিজিএমইএ, চেম্বার এবং জেলা প্রশাসনের করণীয় বিষয়গুলো উল্লেখ করেন।
মাহবুব চৌধুরী বলেন, ‘১৯৭৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৩০ হাজার রফতানি চালানের বিপরীতে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা দেশে আসেনি। দেশের বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইনের ১৮ (এ) ধারা রহস্যজনকভাবে বিলুপ্ত করে দেওয়ায় বিদেশিরা নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে গেছে। এসব ঘটনায় পোশাক রফতানি খাতের সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
তারা বলেন, গার্মেন্টস সেক্টরের অন্তত ৭ বিলিয়ন ডলার বিদেশিরা মেরে দিয়েছে। এ টাকা উদ্ধার করার জন্য সরকারের দ্রুত পদক্ষেপ জরুরি। এ ধরনের আন্তর্জাতিক প্রতারণা রোধে সরকার ও বিজিএমইএকে শক্তিশালী মনিটরিং ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী, পণ্য জাহাজিকরণের ছয় মাসের মধ্যে রফতানি মূল্য দেশে আসার কথা। ওই সময়ের মধ্যে পণ্যমূল্য ফেরত না এলে এবং কম এলে ব্যাংকে ওভারডিউজ হিসেবে পরিগণিত হবে। আবার অনেক সময় রফতানিমূল্যের ডিসকাউন্ট করা হলে কম মূল্য ফেরত আসে। সেক্ষেত্রে বায়ারকে দেওয়া ডিসকাউন্ট বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কমিটিকে অবহিত করে অনুমোদন নিতে হয়।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শিপিং লাইন্স ও ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স কর্তৃক যুক্তরাষ্ট্র কিংবা সংশ্লিষ্ট দেশের ব্যাংকের ডকুমেন্ট ছাড়াই বায়ারকে পণ্য ডেলিভারি দেওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বায়ার বাংলাদেশের রফতানিকারক কর্তৃক তার ব্যাংকে পাঠানো ডকুমেন্ট ছাড় না করে স্থানীয় ফরোয়ার্ডার্স ও শিপিং লাইনের সঙ্গে যোগসাজস করে পণ্য ডেলিভারি নিয়ে নেয়।
কারণ ব্যাংক থেকে ডকুমেন্ট ছাড় করতে পণ্যের সকল মূল্য পরিশোধ করতে হয়। এতে করে বিদেশি ব্যাংক থেকে বাংলাদেশের ব্যাংকে পণ্যের মূল্য আসে না। বিদেশি ব্যাংক নির্দিষ্ট সময়ে বায়ার ডকুমেন্ট ক্লিয়ার না করলে তা ফেরত পাঠিয়ে দেয়।
সংশ্লিষ্টদের মতে, বাংলাদেশ ব্যাংক রফতানি চালানের ক্ষেত্রে টাকা ফেরত না এলে সরাসরি ভূমিকা রাখলে এবং বিদেশি বায়ারদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বিদেশে দূতাবাসকে ব্যবহার করা এবং ক্ষেত্রবিশেষে মামলা করলে অসাধু বায়ার কিংবা রফতানিকারক শিপিং লাইন ও ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স অবৈধ কাজ করার ক্ষেত্রে নিরুৎসাহিত হবে।
এমআইকে/এমআর

