> বড় ধরনের ঝুঁকিতে পড়তে পারে শিল্প-কারখানা
> আরোপিত কর কার্যকরের ডেটলাইন ১ আগস্ট
> সরকারের অভিজ্ঞতা ও পলিসিকে দুষছেন ব্যবসায়ীরা
> যুক্তরাষ্ট্রকে বাংলাদেশের ‘অবস্থানপত্র’ দেওয়া হবে আজ
দেশের অর্থনীতিতে ইতোমধ্যে তৈরি হওয়া গুমোট পরিস্থিতির মধ্যে নতুন করে যুক্ত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যনীতির চাপ। সম্প্রতি মার্কিন প্রশাসনের ঘোষিত বাড়তি শুল্কনীতি দেশের রফতানি খাতে গভীর উদ্বেগ তৈরি করেছে। এতে করে তৈরি পোশাক, চামড়া, হিমায়িত পণ্যসহ বেশ কিছু প্রধান পণ্য রফতানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিজ্ঞাপন
১ আগস্ট থেকে ট্রাম্প প্রশাসনের এই শুল্কনীতি কার্যকরের কথা রয়েছে। এর মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার এই সংকট সমাধানে কাজ করছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক আরোপের বিষয়ে সরকারের নেওয়া পদক্ষেপে হতাশার কথা জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, আমরা যুক্তরাষ্ট্রের যেসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করি তারা জানিয়েছেন ভালো ফলাফলের সম্ভাবনা কম। ফলে আমাদের ব্যবসা চরম হুমকির মধ্যে পড়তে যাচ্ছে। সরকার আমাদের সমাধানের আশ্বাস দিয়েও দিন যত ঘনিয়ে আসছে সম্ভাবনা তত ক্ষীণ হচ্ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ট্রাম্পের এই পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের বাণিজ্য অংশীদারদের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটাতে পারে এবং বৈশ্বিক বাণিজ্যযুদ্ধে নতুন উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে।
বাংলাদেশের রফতানি আয় দীর্ঘদিন ধরে মার্কিন বাজারনির্ভর। কিন্তু চীনের পাশাপাশি উন্নয়নশীল দেশগুলোর ওপর যুক্তরাষ্ট্রের বাড়তি শুল্ক আরোপের ঘোষণা বাংলাদেশকেও আঘাত করতে যাচ্ছে। যদিও বাংলাদেশ এখনো এলডিসিভুক্ত দেশ হিসেবে কিছু সুবিধা পাচ্ছে, তবে ২০২৬ সালের মধ্যে সেগুলো প্রত্যাহার হবে। ফলে এই শুল্কনীতির প্রভাব তখন আরও প্রকট হতে পারে।
বৈশ্বিক বাজারে চাহিদা কমে যাওয়ায় রফতানি আয় এমনিতেই কিছুটা স্থবির। তার মধ্যে নতুন করে মার্কিন শুল্কনীতির প্রভাব পড়লে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার আয় আরও কমে যেতে পারে, যা ডলারের সরবরাহে ঘাটতি তৈরি করবে। এর ফলে টাকার মান আরও কমে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে, যা আমদানি ব্যয় এবং মূল্যস্ফীতিকে বাড়াবে।
সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে ৩.৩৮ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রফতানি করেছে, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ২১ শতাংশ বেশি। এই প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও ওয়ালমার্ট, লেভিস ও এইচঅ্যান্ডএমের মতো কোম্পানিগুলো অর্ডার স্থগিত বা সীমিত করছে, মূলত শুল্কসংক্রান্ত অনিশ্চয়তার কারণে। বিশেষ করে ওয়ালমার্টের কিছু সরবরাহকারী ইতোমধ্যে আগাম কার্যাদেশ বাতিল করেছে, নয়ত স্থগিত রেখেছে। এমনকি লেভিস তাদের ২০২৫ সালের প্রয়োজনীয় পোশাকের ৬০ শতাংশ আগেভাগেই মজুত করে রেখেছে, ভবিষ্যতের ঝুঁকি এড়াতে।
বাণিজ্য বিশ্লেষকরা বলছেন, বৈশ্বিক বাজারে চাহিদা কমে যাওয়ায় রফতানি আয় এমনিতেই কিছুটা স্থবির। তার মধ্যে নতুন করে মার্কিন শুল্কনীতির প্রভাব পড়লে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার আয় আরও কমে যেতে পারে, যা ডলারের সরবরাহে ঘাটতি তৈরি করবে। এর ফলে টাকার মান আরও কমে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে, যা আমদানি ব্যয় এবং মূল্যস্ফীতিকে বাড়াবে।
>> আরও পড়তে পারেন
যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক নিয়ে সরকারের পদক্ষেপে হতাশ ব্যবসায়ীরা
এদিকে শিল্প মালিকরা বলছেন, সরকারকে এখনই কূটনৈতিকভাবে সক্রিয় হতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে রফতানিযোগ্য পণ্যে শুল্কছাড় অব্যাহত রাখার উদ্যোগ নেওয়া দরকার। পাশাপাশি রফতানির বাজার বহুমুখীকরণ, নতুন নতুন পণ্য অন্তর্ভুক্তকরণ এবং নীতিগত সহায়তা দরকার বলে মত তাদের।
অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করছেন, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বড় পরিবর্তন এলে তার প্রভাব দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে সরাসরি পড়ে। তাই সময় থাকতে বিকল্প প্রস্তুতি না নিলে ভবিষ্যতে অর্থনীতির সংকট আরও ঘনীভূত হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রকে বাংলাদেশের ‘অবস্থানপত্র’ দেওয়া হবে আজ
আরোপিত শুল্কহারের বিষয়ে সক্ষমতা ও পদক্ষেপের কথা জানিয়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানপত্র দিতে যাচ্ছে সরকার। আজ সোমবার (২১ জুলাই) ই-মেইলে সেটা পাঠানো হতে পারে।
তবে তৃতীয় দফায় সম্ভাব্য আলোচনার সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ এখনো জানায়নি মার্কিন বাণিজ্য দফতর (ইউএসটিআর)। এ নিয়ে তৃতীয় ও চূড়ান্ত দফা আলোচনার সময়সূচি চেয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পাঠানো ই-মেইলের জবাবে আরও অপেক্ষা করতে বলা হয়েছে বলে জানা গেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সূত্রে।
এদিকে ব্যবসায়ীরা হতাশা ব্যক্ত করে বলেন, সরকার যদি সমাধানে ব্যর্থ হয় তাহলে বড় ঝুঁকিতে পড়তে পারে শিল্প-কারখানা। ব্যবসায়ী নেতা ও এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ রোববার (২০ জুলাই) এক সভায় বলেন, ‘আমরা যাদের কাছে রফতানি করি, এমন বড় বড় ব্র্যান্ড যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সঙ্গে চলমান ট্যারিফ নেগোসিয়েশনের বিষয়ে খোঁজখবর রাখছে এবং লবিং করছে। তারা আমাদের জানিয়েছে, তোমরা (বাংলাদেশ) ভালো রেজাল্ট পাবে বলে মনে হচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্র থেকে হতাশার কথা আসছে।’
>> আরও পড়তে পারেন
‘যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কারোপের সমাধান না হলে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে’
এ কে আজাদ আরও বলেন, ‘আমরা যখন সরকারের সঙ্গে কথা বললাম, লবিস্ট নিয়োগের জন্য বললাম, প্রধান উপদেষ্টার অফিসে মেসেজ পাঠালাম, আমাদের এক পর্যায়ে বলা হলো ৯৫ শতাংশ সমাধান হয়ে গেছে। কিন্তু আমাকে একটা ব্র্যান্ডের পক্ষ থেকে মেইল পাঠানো হয়েছে। আমাকে বলা হয়েছে, আগামী ১ তারিখ থেকে যে প্রোডাক্ট তৈরি করা হবে, সেখানে নতুন ট্যারিফ থাকলে আমি (সরবরাহকারী) কত শতাংশ শেয়ার করব, সেটি তাকে জানানোর জন্য।’
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, ‘বাংলাদেশের দর কষাকষির অভিজ্ঞতা নেই। পাল্টা শুল্ক বিষয়ে অন্য দেশের তুলনায় আমাদের দর কষাকষি হতাশ করেছে। নন-ডিসক্লোজার এগ্রিমেন্ট (এনডিএ) থাকা সত্ত্বেও মালয়েশিয়া জটিল ইস্যুগুলো নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশীজনের সঙ্গে বৈঠক করছে।’
দীর্ঘ সময় পাওয়ার পরও কোনো সমাধানে আসতে না পারায় সরকারের সমালোচনা করে বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, সরকার কী করছে বা হালনাগাদে কী অগ্রগতি আছে, তা ব্যবসায়ীরা জানতে পারেনি। ওই সময় (এপ্রিল মাসে) সরকার থেকে বলা হলো তারা (সরকার) চেষ্টা করছে। কিন্তু সরকার কী করছে বা হালনাগাদে কী অগ্রগতি আছে, সেগুলো আমরা জানতে পারিনি।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আসলে কী হচ্ছে এখনই তা বলা যাচ্ছে না। এখানে অনেক বিষয় জড়িত। ট্রাম্প প্রশাসন এই সিদ্ধান্ত থেকে সরেও আসতে পারে। সম্প্রতি ১০ থেকে ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে ১৫০টি দেশকে চিঠি ইস্যু করার কথা শোনা যাচ্ছে। এর মধ্যে যদি বাংলাদেশও পড়ে যায় তাহলে তো আমরা বেঁচে গেলাম।’
এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘১ আগস্ট এই শুল্কনীতি কার্যকর হওয়ার কথা থাকলেও যতটুকু বোঝা যায় সময় আরও বাড়ানো হবে। ভারত, পাকিস্তানসহ অনেক দেশেও সময় নির্দিষ্ট করেও পরে সময় বাড়ানো হয়েছে।’
>> আরও পড়তে পারেন
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিতীয় ধাপের আলোচনা আশাব্যঞ্জক: বাণিজ্য উপদেষ্টা
ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘সরকার শুরুতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে দৌড়ঝাঁপ করেছে। পরে ৯০ দিন সময় বাড়ানোয় মনে হচ্ছে সেই তৎপরতায় কিছুটা কমে গেছে। তৃতীয় ধাপে আলোচনা করার কথা। দেখা যাক, ভাগ্যে কী রাখছে। তবে এতটুকু বলা যায়, যদি ৩৫ শতাংশ শুল্কারোপ কার্যকর হয়েই যায় তাহলে বিপদ আছে।’
প্রসঙ্গত, ২ এপ্রিল হোয়াইট হাউজের রোজ গার্ডেনে দেওয়া এক ভাষণে ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, দশকের পর দশক ধরে আমাদের দেশ লুটপাট, শোষণ এবং নিপীড়নের শিকার হয়েছে, তা বন্ধ করার সময় এসেছে। তার ঘোষণা অনুযায়ী, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পণ্যের ওপর সর্বনিম্ন ১০ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক বসানো হয়েছে। সেক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের পণ্য আমদানির ওপর ৩৪ শতাংশ, বাংলাদেশের ওপর ৩৭ শতাংশ, ভারতের ওপর ২৬ শতাংশ, জাপানের ওপর ২৪ শতাংশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে।
এমআর/জেবি

