মেধার দিক বিবেচনা না করে চাকরিতে যোগদানের সময়কালকে গুরুত্ব দিয়ে পদোন্নতি নীতিমালা প্রস্তুত করছে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক। ব্যাংকটির এই প্রস্তাবিত পদোন্নতি নীতিমালায় অসন্তোষ তৈরি হয়েছে ব্যাংকের কর্মকর্তাদের একাংশের মধ্যে। বিশেষ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীনে ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির মাধ্যমে ২০১৯ সাল ও পরবর্তী সময়ে সরাসরি সিনিয়র অফিসার পদে যোগদানকারী কর্মকর্তারা এ নীতিমালার কড়া সমালোচনা করেছেন।
তাদের অভিযোগ, এই নীতিমালা বাস্তবায়িত হলে মেধা, দক্ষতা ও প্রতিযোগিতামূলক নিয়োগ পদ্ধতির কোনো মূল্য থাকবে না। বরং সুপারনিউমারারিতে পদোন্নতিপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা দীর্ঘদিন থেকে কর্মরত থাকায় পদোন্নতিতে বাড়তি সুবিধা পাবেন।
বিজ্ঞাপন
নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা বলছেন, দীর্ঘমেয়াদি অভিজ্ঞতা অবশ্যই মূল্যবান, তবে প্রমোশন নীতিমালায় সেটি একমাত্র মানদণ্ড হতে পারে না। একজন কর্মকর্তা যদি কম সময়ের মধ্যে দক্ষতা ও যোগ্যতা প্রমাণ করতে সক্ষম হন, তাহলে তাকেও অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। শুধু চাকরিতে প্রবেশের সময় ধরে নম্বর দিলে, সেটি প্রমোশন ব্যবস্থাকে পক্ষপাতমূলক করে তুলবে। এতে করে প্রতিভাবান, দক্ষ ও প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ কর্মকর্তারা হতাশ হবেন এবং প্রতিষ্ঠান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকবে।
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্রস্তাবিত নীতিমালায় বলা হয়েছে, সমগ্র চাকরির মেয়াদকে বিবেচনায় রেখে ২৫ বছরে সর্বোচ্চ ৭ নম্বর দেওয়া হবে। অর্থাৎ প্রতি বছর চাকরির জন্য ০.২৮ করে নম্বর বরাদ্দ থাকবে। এই নিয়মে ২০১১ সালে অফিসার (১০ম গ্রেড) হিসেবে যোগদানকারী এবং ২০১৯ সালে সুপারনিউমারারি পদোন্নতিপ্রাপ্ত একজন কর্মকর্তা ২০২৪ সালের শেষে পাবেন প্রায় ৩.৬৪ নম্বর।
অন্যদিকে ২০১৯ সালে সরাসরি সিনিয়র অফিসার (৯ম গ্রেড) হিসেবে যোগদানকারী কর্মকর্তা একই সময়ে পাবেন মাত্র ১.৪০ নম্বর। অথচ সরাসরি সিনিয়র অফিসার হিসেবে যোগদানকারী এই কর্মকর্তারও পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল—যেমন ব্যাংকে অফিসার হিসেবে ৫.৫ বছর কাজ করেছেন। কিন্তু সেই সময়কে কোনোভাবে বিবেচনায় আনা হচ্ছে না।
বিজ্ঞাপন
একজন কর্মকর্তা উদাহরণ টেনে বলেন, ২০১৫ সালে অফিসার হিসেবে যোগদানকারী আর ২০২০ সালে সিনিয়র অফিসারে প্রমোশন পাওয়া কর্মকর্তার ব্যাংকে চাকরির সময় হবে ৯ বছর, যার ভিত্তিতে তিনি পাবেন ২.৫২ নম্বর। কিন্তু ২০১৯ সালে সরাসরি নিয়োগপ্রাপ্ত সিনিয়র অফিসারের নম্বর থাকবে ১.৪০-তেই সীমাবদ্ধ। অথচ এই কর্মকর্তার বাস্তব অভিজ্ঞতা ৫ বছরের বেশি।
পদোন্নতির ক্ষেত্রে এজিএম ও ডিজিএম পর্যায়ের জন্য মৌখিক পরীক্ষায় ১০ নম্বর বরাদ্দের প্রস্তাবও রয়েছে, যার মধ্যে ৫ নম্বর দেওয়া হবে পূর্বে পাওয়া ৯০ নম্বরের আনুপাতিক হারে। অভিযোগ রয়েছে, যারা চাকরির সময়ের ভিত্তিতে বেশি নম্বর পাচ্ছেন, তারা এই মৌখিক পরীক্ষায়ও বাড়তি সুবিধা পাচ্ছেন। ফলে তুলনামূলকভাবে দক্ষ অথচ কম চাকরির মেয়াদসম্পন্ন কর্মকর্তারা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মজিবুর রহমান বলেন, ‘ব্যাংকের পদোন্নতি নীতিমালা নিয়ে কাজ চলছে। এটি এখনো চূড়ান্তভাবে প্রজ্ঞাপন আকারে প্রকাশ হয়নি। তাই এ বিষয়ে মন্তব্য করতে চাচ্ছি না। যেকোনো প্রশ্ন থাকলে অফিস সময়ে যোগাযোগ করতে হবে।’
এদিকে ব্যাংকের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ অন্যান্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে ফিডার পদে কর্মকালই প্রধান বিবেচ্য। সেখানে ‘চাকরিতে মোট মেয়াদ’ নির্ধারণ করে প্রমোশন দেয় না। জনতা ব্যাংকের নতুন নীতিমালা এই প্রথার ব্যত্যয় ঘটিয়ে কর্মকর্তাদের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি করছে।
তথ্য বলছে, ২০২৪ সালের ১৬ অক্টোবর অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ হতে জারি করা প্রজ্ঞাপনেও স্পষ্ট বলা হয়েছে—ব্যবস্থাপনা পরিচালক, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ও মহাব্যবস্থাপক পদে নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে শুধুমাত্র ফিডার পদের কর্মকাল বিবেচনায় নেওয়া হবে। যদি জনতা ব্যাংকে ভিন্ন পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়, তবে এটি অন্য ব্যাংকেও একই রকম বৈষম্য তৈরির সম্ভাবনা সৃষ্টি করবে।
প্রস্তাবিত নীতিমালার এ ধারাগুলো পুনর্বিবেচনা না করা হলে জনতা ব্যাংকে শৃঙ্খলা, ন্যায্যতা এবং মেধাভিত্তিক অগ্রগতির পরিবেশ বিনষ্ট হতে পারে। এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে ব্যাংকের কর্মদক্ষতা ও সুনামের ওপর। তাই তারা দ্রুত নীতিমালাটি সংশোধনের দাবি জানিয়েছেন এবং আগের মতোই ফিডার পদে চাকরির অভিজ্ঞতাকে পদোন্নতির মূল ভিত্তি হিসেবে পুনর্বহাল করার আহ্বান জানিয়েছেন।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও গবেষণা সংস্থা চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের রিসার্চ ফেলো এম হেলাল আহমেদ জনি ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘সরকারি বা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে পেশাগত অগ্রগতির ক্ষেত্রে ন্যায্যতা ও স্বচ্ছতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জনতা ব্যাংকের প্রস্তাবিত পদোন্নতি নীতিমালায় ‘সমগ্র চাকরির সময়কাল’ বিবেচনায় ৭ নম্বর বরাদ্দ দেওয়ার সিদ্ধান্ত এক ধরনের নীতিগত বৈষম্য তৈরি করতে পারে। এতে সরাসরি সিনিয়র অফিসার হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত যোগ্য কর্মকর্তারা বাস্তবে প্রমোশনে পিছিয়ে পড়বেন, যদিও তাদের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা মোটেই কম নয়।’
এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘ব্যাংকিং খাতে নিয়মতান্ত্রিক প্রমোশন কাঠামো নিশ্চিত করতে হলে ‘ফিডার পদে’ বাস্তব কাজের অভিজ্ঞতা ও কর্মকালকে অগ্রাধিকার দিতে হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক ও অন্যান্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকও সেই ধারা অনুসরণ করে। ফলে জনতা ব্যাংক যদি এর ব্যতিক্রম করে, তবে এতে প্রতিষ্ঠানিক ভারসাম্য হারানোর ঝুঁকি আছে। দীর্ঘমেয়াদি অসন্তোষ জন্ম নিতে পারে, যা দক্ষ জনবল ধরে রাখার জন্য হুমকি হয়ে উঠবে।’
টিএই/জেবি

