- ব্যাংক খাতে সরকারের ঋণ লাখ কোটি ছুঁই ছুঁই
- লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৬০০ কোটির বেশি ঋণ গ্রহণ
- সরকার বেশি ঋণ নিলে সুযোগ কমে বেসরকারি খাতের
দেশে অর্থবছর শেষ হওয়ার আগেই সরকারের ব্যাংক খাত থেকে নেওয়া ঋণ লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ব্যাংক খাত থেকে ৯৯ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য থাকলেও ১৫ জুন পর্যন্ত নেওয়া ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৯ হাজার ৫৯১ কোটি টাকা। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৫৯১ কোটি টাকা বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
বিজ্ঞাপন
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকার ব্যাংক থেকে বেশি ঋণ নিলে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রাপ্তির সুযোগ কমে যায়। এতে বিনিয়োগে টান পড়ার শঙ্কা দেখা দেয়। সংশ্লিষ্টদের মতে, আশানুরূপ রাজস্ব আদায় না হওয়া, সঞ্চয়পত্র বিক্রি হ্রাস পাওয়া এবং বৈদেশিক উৎস থেকে কম ঋণ ছাড় হওয়ার কারণে অর্থবছরের শেষ দিকে ব্যাংক ঋণ বাড়ছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্বের শুরুতে ব্যাংক খাত থেকে ঋণ কম ছিল। জানুয়ারি পর্যন্ত সাত মাসে ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ ছিল মাত্র ১৩ হাজার ৫৭১ কোটি টাকা। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তা দ্রুতগতিতে বেড়ে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে।
এদিকে, আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ যে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করেছেন, তা চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের তুলনায় ৭ হাজার কোটি টাকা কম। এই বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহের পরিকল্পনা রয়েছে, যা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২ শতাংশ। এর মধ্যে ব্যাংক খাত থেকেই ১ লাখ ৪ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে, যা জিডিপির ১.৬৭ শতাংশ। বাকি অর্থ সঞ্চয়পত্র থেকে ১২ হাজার ৫০০ কোটি এবং নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ২১ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহের পরিকল্পনা রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানান, অর্থবছরের শেষ সময়ে সরকারের ঋণ সাধারণত বেড়ে যায়, কারণ তখন বিভিন্ন বিল পরিশোধে চাপ তৈরি হয়। তিনি বলেন, 'বাংলাদেশে ব্যাংকিং ব্যবস্থা এখনো অনেকাংশে আধুনিক পুঁজিবাজারের বিকল্প হিসেবে কাজ করে। ফলে সরকার যখন বেশি টাকা ব্যাংক থেকে ধার নেয়, তখন বেসরকারি খাতের জন্য বরাদ্দ কমে যায়।'
অন্যদিকে গত এপ্রিল মাসে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭.৫০ শতাংশ, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২.৪০ শতাংশ কম। ওই মাসে বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণ হয়েছে ১৭ লাখ ২১ হাজার ৮২২ কোটি টাকা, যা মার্চে ছিল ১৭ লাখ ১৯ হাজার ৫১২ কোটি টাকা।
মার্চে এই খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল ৭.৫৭ শতাংশ, যা জুলাই-আগস্টের নিম্নমুখী ধারার পর প্রথমবারের মতো কিছুটা বেড়েছিল। এর আগের মাস ফেব্রুয়ারিতে প্রবৃদ্ধি ছিল ৬.৮২ শতাংশ এবং জানুয়ারিতে ছিল ৭.১৫ শতাংশ।
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে এনবিআরের দক্ষতা বৃদ্ধি ও কর কাঠামোর সংস্কার, অনুৎপাদনশীল খাতে বাজেট ব্যয় হ্রাস, বেসরকারি বিনিয়োগে উৎসাহ দেওয়া, ব্যাংক নির্ভরতা কমিয়ে শেয়ার ও বন্ড বাজারকে বিকল্প উৎস হিসেবে গড়ে তোলার পরামর্শ দিয়েছেন বিশ্লেষকরা।
এ বিষয়ে ব্যাংক এশিয়ার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরফান আলী ঢাকা মেইলকে বলেন, 'বাজেট ঘাটতি পূরণে প্রতি বছরই সরকার ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নেয়। তবে মূল্যস্ফীতির সময় এ ধরনের ঋণ গ্রহণ মূল্যস্ফীতি আরও বাড়াতে পারে। কারণ ব্যাংক থেকে সরকার বেশি ঋণ নিলে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগে বাধা পড়ে।'
এই অর্থনীতিবিদ বলেন, 'বড় রাজস্ব ঘাটতির কারণেই সরকারকে ব্যাংক ঋণ নিতে হচ্ছে। তাই রাজস্ব আহরণ বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। আমাদের দেশে অনেক প্রভাবশালী ব্যবসায়ী আয়কর দেন না। তাদের করের আওতায় আনতে পারলে সরকারের ব্যাংক ঋণের প্রয়োজন কমে যাবে।'
টিএই/জেবি