রোববার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

খাদ্যের মজুত ও আমদানি বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতির চাপ মোকাবিলায় সরকার

মাহাবুল ইসলাম
প্রকাশিত: ০৫ মে ২০২৫, ০৪:৩৫ পিএম

শেয়ার করুন:

খাদ্যের মজুত ও আমদানি বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতির চাপ মোকাবিলায় সরকার
  • মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে সক্রিয় সরকার
  • মানুষের খাদ্যাভ্যাসে বৈচিত্র্য 
  • রমজানে স্বস্তি, তারপরেই দাম বাড়ার চাপ
  • জ্বালানির দামে স্বস্তি ও ডলার সংকট কাটছে
  • চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে, তবে আশার আলোও স্পষ্ট

বাংলাদেশে টানা তিন বছর ধরে চলা উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে দমবন্ধ অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে সাধারণ মানুষ। আয়ের তুলনায় ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের খরচ জোগাতে হিমশিম খাচ্ছে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি। এমন বাস্তবতায় মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে সরকার সক্রিয়ভাবে খাদ্যের মজুত ও আমদানি বৃদ্ধি করেছে বলে জানাচ্ছে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) সর্বশেষ বিশ্লেষণ।


বিজ্ঞাপন


ডব্লিউএফপির প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকার আট লাখ টন চাল এবং ৪২ লাখ ৫০ হাজার টন গম আমদানি করেছে —যা দেশের খাদ্যনিরাপত্তা জোরদার করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। অথচ গত অর্থবছরে (২০২৩-২৪) কোনো চাল আমদানি করেনি সরকার। এটি নিঃসন্দেহে বড় কৌশলগত পরিবর্তনের ইঙ্গিত বলছেন সংশ্লিষ্টরা।

প্রতিবেদনে বলা হয়, মার্চে সামান্য মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পেয়েছে —যা ৯.৩২ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯.৩৫ শতাংশে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খাদ্যবহির্ভূত খাতে ব্যয়বৃদ্ধির কারণেই এই ঊর্ধ্বগতি। তবে খাদ্যপণ্যে সরকারের নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপ সামগ্রিক মূল্যস্ফীতিকে তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল রেখেছে।

একটি খাদ্য ঝুড়ির মাসিক গড় খরচও বেড়েছে। মার্চে প্রতি ব্যক্তির খরচ ২৪ টাকা বাড়িয়ে দাঁড়িয়েছে ২৮৯০ টাকায়। তাজা সবজি, মুরগি, আলু এবং কাঁচামরিচের মতো মৌলিক খাদ্যের দাম বৃদ্ধি এই খরচ বৃদ্ধির জন্য দায়ী।

পরিবর্তনশীল খাদ্যাভ্যাস ও বৈচিত্র্য বাড়ছে


বিজ্ঞাপন


ডব্লিউএফপি বলছে, দেশের খাদ্যাভ্যাসেও এসেছে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। আগের মতো চালনির্ভর না থেকে জনগণ এখন গম ও অন্যান্য খাদ্যপণ্যের দিকে ঝুঁকছে। খাদ্যতালিকার এই বৈচিত্র্য ও পরিবর্তনশীল চাহিদার প্রতিফলন ঘটেছে গম আমদানির পরিসংখ্যানে। গত কয়েক বছর ধরে এই প্রবণতা দৃশ্যমান, যা খাদ্য নিরাপত্তার ধারণাকে আরও বিস্তৃত করছে।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, আগামী মাসগুলোতে অভ্যন্তরীণ বোরো ধান সংগ্রহ শুরু হলে সরকারি গুদামে চালের মজুত সন্তোষজনক পর্যায়ে পৌঁছাবে। বর্তমানে সরকারি গুদামে মজুত রয়েছে প্রায় ১৪ লাখ টন চাল। 

কৃষকের ন্যায্যতা ও দেশীয় উৎপাদনের ভবিষ্যৎ

বাংলাদেশ কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি নাজের হোসাইন ঢাকা মেইলকে বলেন, দেশীয় উৎপাদনের ওপর জোর দিতে হবে। কৃষকদের প্রণোদনা দিলে তারা আরও বেশি উৎপাদনে আগ্রহী হবেন। দেশে উৎপাদিত শস্যের সময় আমদানি নিরুৎসাহিত করতে শুল্ক বাড়ানো উচিত। সেইসঙ্গে প্রকৃত কৃষকদের সহজ শর্তে ঋণ ও অন্যান্য সহায়তা দেওয়া দরকার।

নাজের হোসাইনের মতে, বাজার ব্যবস্থাপনায় এখনো বড় ঘাটতি রয়েছে। ভোক্তা অধিদফতরের জনবল সীমিত। জেলা পর্যায়ে একজন কর্মকর্তা দিয়ে পুরো জেলার বাজার পর্যবেক্ষণ সম্ভব না। কৃষি ও বিপণন অধিদফতরকে সম্পৃক্ত করে সমন্বিত বাজার তদারকি গড়ে তুলতে হবে।

রমজানে স্বস্তি, তারপরেই দাম বাড়ার চাপ

প্রতিবেদন বলছে, রমজান মাসে তুলনামূলকভাবে বাজার স্থিতিশীল ছিল, যা গত বছরের বিপরীত। তবে রমজানের পর থেকে শীতের সবজি এবং অন্যান্য পণ্যের সরবরাহ ঘাটতির কারণে বাজারে আবারও চাপ তৈরি হয়েছে।

বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, মার্চ মাসে গম, ডাল, ডিম, ভোজ্যতেল, পেঁয়াজ, রসুন এবং চিনির দাম কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। তবে আলু, কাঁচামরিচ, তাজা সবজি ও মুরগির দাম বেড়েছে, আর চালের দাম প্রায় অপরিবর্তিত রয়েছে।

আবহাওয়ার প্রভাব ও ভবিষ্যতের ঝুঁকি

২০২৪ সালের মে মাস থেকে একাধিক আবহাওয়াজনিত দুর্যোগ ফসল উৎপাদনে বড় ধাক্কা দিয়েছে। ফলে ফসলের উৎপাদন কমে যাওয়ায় আগামী মাসগুলোতে মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে সরকার চাল আমদানির নিয়ম শিথিল করেছে এবং মজুত বাড়িয়ে বাজারে সরবরাহ স্থিতিশীল রাখার চেষ্টা করছে।

জ্বালানির দামে স্বস্তি ও ডলার সংকট কাটছে

ডব্লিউএফপি জানায়, মার্চ মাসে জ্বালানির দামও কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। এলপি গ্যাসের ১২ কেজি সিলিন্ডারের গড় দাম ২৮ টাকা কমে ১৪৫০ টাকায় নেমে এসেছে। এছাড়া অটোগ্যাসের দামও লিটারে ১.৩১ টাকা কমিয়ে ৬৬.৪৩ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।

একইসঙ্গে আমদানি খাতে ব্যবহৃত বৈদেশিক মুদ্রার সংকটও অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এটি আমদানি প্রক্রিয়াকে কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্য দিয়েছে, যার ফলে পণ্যের সরবরাহ বজায় রাখা সম্ভব হয়েছে।

চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে, তবে আশার আলোও স্পষ্ট

সরকারের অন্তর্বর্তী পর্যায়ের অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বাজার ব্যবস্থাপনা ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। যদিও সাম্প্রতিক কিছু পদক্ষেপ তা আংশিকভাবে নিয়ন্ত্রণে এনেছে, তবুও বাস্তবতা হলো— সংকট এখনো পুরোপুরি কাটেনি। তবে মজুত বাড়ানো, চাল-গম আমদানিতে তৎপরতা, মূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারি তদারকি বৃদ্ধি এবং কৃষকদের নিয়ে ভাবার উদ্যোগগুলো সাধারণ মানুষের মাঝে আশার আলো জাগাচ্ছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। বাজারব্যবস্থার দীর্ঘস্থায়ী সমাধান এবং ভোক্তা-সহনশীল মূল্যে নিত্যপণ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে এসব উদ্যোগ আরও প্রসারিত হওয়া প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেন ক্যাব সভাপতি।

এমএইচটি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর