মঙ্গলবার, ২৪ জুন, ২০২৫, ঢাকা

শ্রমজীবী মানুষের দুঃসহ বাস্তবতা

মহিউদ্দিন রাব্বানি
প্রকাশিত: ০১ মে ২০২৫, ১০:২৯ এএম

শেয়ার করুন:

শ্রমজীবী মানুষের দুঃসহ বাস্তবতা

আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস আজ। ‘শ্রমিক-মালিক এক হয়ে, গড়বো এ দেশ নতুন করে’- এই প্রতিপাদ্যে দিনটি পালিত হবে। কিন্তু এ দিবসকে ঘিরে যত আয়োজন, বাস্তবে শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ও মৌলিক চাহিদা পূরণের প্রশ্নে দেখা যায় এক গভীর বৈষম্য ও উপেক্ষার চিত্র। শ্রমিকদের ঘামে গড়ে উঠছে দেশের অর্থনীতি, কিন্তু সেই শ্রমিকের জীবন মানোন্নয়নে নেই যথাযথ মনোযোগ।

শ্রমবিশেষজ্ঞ ও শ্রমিক নেতারা বলছেন, সভ্যতা নির্মাণ হয় শ্রমিকের প্রতি ঘামের ফোঁটায়। আমাদের অর্থনীতির ভিত শ্রমিকের ঘামের ওপর টিকে আছে। অথচ সমাজের সবচেয়ে অবহেলিত-নিগৃহীত লোকটিই হচ্ছেন শ্রমিক বা শ্রমজীবী মানুষ। তারা মানুষ হিসেবে ন্যূনতম অধিকারটুকুও গ্রহণ করার সুযোগ পান না। চাকরি ক্ষেত্রে নেই নিশ্চয়তা, নেই নিরাপদ কর্মক্ষেত্র, সাধারণ ও মাতৃত্বকালীন ছুটিতে চরম বৈষম্য এখানে। মজুরির বিষয় তো ‘দূর কি বাত’। 


বিজ্ঞাপন


ন্যুনতম মজুরি, সংখ্যার বাইরে বাস্তবতা: 

শ্রমিকরা সময়মতো বেতন পান না এমন অভিযোগ প্রায়ই পাওয়া যায়। ওভারটাইমের যথাযথ মূল্য দেওয়া হয় না এবং অনিরাপদ কর্মপরিবেশে কাজ করতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে শ্রম আইন বাস্তবায়নে দুর্বলতা ও মালিকপক্ষের প্রভাব শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিতকরণে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

63ede48f20d2a_labour

বর্তমানে তৈরি পোশাক খাতে শ্রমিকদের ন্যুনতম মজুরি নির্ধারিত হয়েছে ১২ হাজার ৫০০ টাকা। চা শ্রমিকের মজুরি দৈনিক হিসেবে ১৭২ টাকা। নির্মাণ খাতের শ্রমিকরা দৈনিক মজুরি ৫০০-৭০০ টাকা, কিন্তু কোনো স্থায়ী নিশ্চয়তা নেই। কৃষি খাতে মৌসুমি ও অনিয়মিত আয় থাকে শ্রমিকদের। এছাড়া চামড়া ও ট্যানারি খাতে কর্মপরিবেশ অস্বাস্থ্যকর, মজুরি কম।


বিজ্ঞাপন


শ্রমিক সংগঠনগুলো বলছে, এই মজুরি দিয়ে একজন শ্রমিক ও তার পরিবারের চলা প্রায় অসম্ভব। ঢাকায় খাদ্য, যাতায়াত, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খরচ মিলিয়ে ন্যূনতম একটি পরিবার চালাতে মাসিক ব্যয় গড়ে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকার বেশি। শুধুমাত্র ঘর ভাড়াই ৫,০০০-১০,০০০ টাকা। ফলে বেশিরভাগ শ্রমিকই দেনায় জর্জরিত, পুষ্টিকর খাবার ও শিক্ষা থেকে বঞ্চিত।

আরও পড়ুন-

পোশাক খাত ছাড়াও অন্যান্য শ্রমনির্ভর খাত- নির্মাণ, কৃষি, চামড়া, পরিবহন- এই খাতগুলোর শ্রমিকদের অনেকের জন্য ন্যূনতম মজুরির কোনো নির্দিষ্ট কাঠামোই নেই। কাজের অনিশ্চয়তা, অপ্রতুল মজুরি ও দুর্ঘটনার ঝুঁকিতে কাজ করে যেতে হয় প্রতিদিন।

সাভারের একটি পোশাক কারখানার কর্মী মোহসেনা বেগম ঢাকা মেইলকে বলেন, ১২ হাজার ৫০০ টাকা বেতন নির্ধারণ করেছে সরকার। কিন্তু এখন আর এই টাকায় চলে না। বাচ্চার স্কুল, বাজার, ভাড়া—সব কিছুই বাড়ছে, শুধু মজুরি বাড়ে না।

ওভারটাইম ও ছুটি পাওয়া যায় না:

অনেক শ্রমিক অভিযোগ করেছেন, ওভারটাইমের সঠিক মজুরি পাওয়া যায় না। অনেক সময় মাসের বেতনও আটকে রাখা হয়। পর্যাপ্ত ছুটি, মাতৃত্বকালীন সুবিধা কিংবা কর্মস্থলে নিরাপত্তা- এসব অধিকার কাগজে থাকলেও বাস্তবে বাস্তবায়ন দুর্বল।

নারী শ্রমিকরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে: 

নারী শ্রমিকরা একইসঙ্গে কর্মক্ষেত্র ও সংসারের কাজ সামলান। কিন্তু তারা প্রায়ই হয়রানি, স্বাস্থ্যঝুঁকি এবং মাতৃত্বকালীন ছুটির ক্ষেত্রে বঞ্চনার শিকার হন। অনেক কারখানায় এখনো ডে-কেয়ার কিংবা প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা নেই।

1714500994-14a584a8fe797978734979112508a9d4
কয়লাশ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন নারীরা।

সরকারি চাকরি ক্ষেত্রে স্ববেতনে মাতৃত্বকালীন ছয় মাসের ছুটি পান। কিন্তু গার্মেন্টস সহ অন্যান্য শিল্পকারখানায় মাতৃত্বকালীন ছুটি পান না। একই দেশে দুই নিয়ম যা সম্পূর্ণ অন্যায্য বলছেন শ্রমিক অধিকার কর্মীরা। 

আইন আছে, বাস্তবায়ন নেই:

বাংলাদেশে ‘শ্রম আইন ২০০৬’ এবং সংশোধিত ‘২০১৮’ রয়েছে। তবে বাস্তবে বেশিরভাগ শ্রমিকই জানেন না তাদের অধিকার কী। শ্রম অধিদপ্তরের তদারকি সীমিত, আর মালিকপক্ষ অনেক ক্ষেত্রেই প্রভাবশালী। এছাড়াও শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করেছে। তবে শ্রমিকের অধিকার বাস্তবায়ন দুর্বল। বেসরকারি খাতে কিছু কারখানায় ‘লিভিং ওয়েজ’ প্রদান ও শ্রমিক বান্ধব পরিবেশ তৈরি করা হলেও তা সামগ্রিক খাতে পৌঁছেনি।

সমাধানের পথ ও প্রস্তাবনা-

১. ন্যূনতম মজুরি পুনর্নির্ধারণ:

বছরে অন্তত একবার মূল্যস্ফীতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে মজুরি সমন্বয় করতে হবে।

২. সামাজিক নিরাপত্তা কাভারেজ:

স্বাস্থ্য বীমা, অবসরভাতা ও মাতৃত্বকালীন ছুটি সকল খাতে বাধ্যতামূলক করতে হবে।

৩. ট্রেড ইউনিয়ন স্বাধীনতা:

সংগঠন করার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে—তাতে মালিক-শ্রমিক সংলাপ বাড়বে।

৪. কর্মপরিবেশ উন্নয়ন:

কাজের পরিবেশকে নিরাপদ, স্বাস্থ্যকর ও মানবিক করতে হবে।

সমন্বিত উদ্যোগের পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের: 

বিশেষজ্ঞ ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর মতে, শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম মজুরি পুনঃনির্ধারণ, ট্রেড ইউনিয়ন স্বাধীনতা, স্বাস্থ্যসেবা ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সময়ের দাবি। তারা বলছেন, কেবল দিবস উদযাপন নয়, বাস্তবিক কর্মপরিকল্পনা নিয়েই সরকার ও মালিকপক্ষকে এগোতে হবে।

ন্যূনতম মজুরি পুনর্বিবেচনা করে প্রতি বছর মূল্যস্ফীতি অনুযায়ী সমন্বয় করা উচিত। শ্রমিকদের জন্য আবাসন, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। ট্রেড ইউনিয়নের স্বাধীনতা ও কার্যকর ভূমিকা নিশ্চিত করতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি খাতের সমন্বয়ে শ্রম অধিকার বাস্তবায়নের জন্য জোরালো নজরদারি ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা জরুরি।

কতিপয় ব্যবসায়ী শ্রমিককে তার অধিকার আদায়ে সংগঠিত হতে দিচ্ছে না বলে মন্তব্য করেন জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সম্পাদক এবং বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের সভাপতি ফয়জুল হাকিম লালা। ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, যেখানে শ্রমিকরা অধিকার আদায়ে সংগঠিত হতে চান, সেখানে অনেক সময়ই মালিকপক্ষ ও প্রশাসনের বাধা দেখা যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় শ্রমিকদেরকে ইউনয়িন করতে দিচ্ছে না মালিকরা। কেউ করতে চাইলে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়। বেশির ভাগ কারখানায় চাকরির নিশ্চয়তা নেই।

acf6a1e441692d3b0f4d501e12ceb90408077115d155c71f

তিনি আরও বলেন, কর্মক্ষেত্রে প্রবেশে নিয়োগপত্র দেওয়া হচ্ছে না। তাদেরকে ছুটির ক্ষেত্রেও বৈষম্য করা হয়। সরকারি কর্মচারীরা দুই দিন সাপ্তাহিক ছুটি পেলেও বেসরকারি খাতের শ্রমজীবীরা সে অধিকার থেকে বঞ্চিত। মাতৃত্বকালীন ছুটির ক্ষেত্রেও অন্যায্য আচরণ করেন মালিকরা। এক দেশে দুই আইন চলতে পারে না। এটা চরম বৈষম্য। 

তিনি বলেন, বাংলাদেশে শ্রমিকবান্ধব সরকার না হলে অধিকার বাস্তবায়ন হবে না। তিনি শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ হতে বলেন। শ্রমজীবী মানুষের যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা ও কর্মস্থলের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সরকারের কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। 

এমআর/ইএ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর