বুধবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২৫, ঢাকা

খেলাপি ঋণের অভিশাপ থেকে মুক্তির পথ খুঁজতে হবে

বিপ্লব চন্দ্র ঘোষ
প্রকাশিত: ১৫ এপ্রিল ২০২৫, ০৩:০৮ পিএম

শেয়ার করুন:

খেলাপি ঋণের অভিশাপ থেকে মুক্তির পথ খুঁজতে হবে

ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের (এনবিএফআই) মন্দ বা খেলাপি ঋণ (দীর্ঘ সময় ধরে আদায় না হওয়া ঋণ) থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার একটি কার্যকর পন্থা খুঁজে বের করা এখন সময়ের দাবি এবং অতীব গুরুত্বপূর্ণ। অন্যথায় আমাদের ব্যাংকিং কার্যক্রমের স্বাভাবিক গতিপথ রুদ্ধ হয়ে যাবে। অর্থাৎ  বিদেশি ব্যাংক এবং দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে দেশি ব্যাংকগুলোর Creditworthiness বা বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ডিসেম্বর ২০২৪-এ খেলাপি ঋণের (নন পারফর্মিং ঋণ) পরিমাণ তিন লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা ছিল যা মোট ঋণের ২০ দশমিক ২০ শতাংশ। আমাদের মতো ছোট অর্থনীতিতে এত বিশাল পরিমাণ খেলাপি ঋণের বোঝা নিয়ে কোনো ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান দিনের পর দিন বেঁচে থাকতে বা Survive করতে পারে না।


বিজ্ঞাপন


ব্যাংকের ঋণ প্রক্রিয়া একটি মসৃণ চক্র। অর্থাৎ নিয়ম অনুযায়ী কোনো প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়ার পর সেই প্রতিষ্ঠান সেই ঋণ নিয়মিত পরিশোধ করবে। এবং ব্যাংক সেই ঋণের আদায়কৃত অর্থ অন্য প্রতিষ্ঠানকে তার চাহিদা অনুযায়ী আবার ঋণ দেবে। অর্থাৎ এক প্রতিষ্ঠান থেকে আদায়কৃত ঋণের অর্থ অন্য প্রতিষ্ঠানকে ঋণ হিসেবে বিতরণ করা। এইভাবে চলতে থাকে ঋণ চক্রের মসৃণ প্রক্রিয়া।

এখন বাস্তবতা হলো, বিভিন্ন কারণে (ইচ্ছাকৃত এবং অনিচ্ছাকৃত) আমাদের দেশে ঋণ চক্র মসৃণ থাকে না। অর্থাৎ কিছু কিছু ঋণ এক, দুই, তিন বছরের মধ্যেই শ্রেণিকৃত হয়ে পড়ে।

আমাদের অর্থনীতিতে শ্রেণিকৃত ঋণের তাৎপর্য প্রধানত পাঁচ ধরনের। যথা:

১. ঋণ আদায় না হওয়ার কারণে নতুন ঋণ দেওয়া সম্ভব হয় না বা ঋণদান কর্মসূচি সংকুচিত হয়ে পড়ে;


বিজ্ঞাপন


২. শ্রেণিকৃত ঋণের জন্য ব্যাংকের মুনাফা থেকে সঞ্চিতি (Provision) রাখতে হয় বিধায় ব্যাংকের লাভ কমে যায়;

৩. ব্যাসেল ৩ (ব্যাংকের বাধ্যতামূলক মূলধন সংরক্ষণ কাঠামো) এর নিয়ম অনুযায়ী শ্রেণিকৃত ঋণের জন্য অতিরিক্ত মূলধন সংরক্ষণের বাধ্যবাদকতা রয়েছে;

৪. অতিরিক্ত শ্রেণিকৃত ঋণের জন্য ব্যাংকের ক্যামেলস রেটিং এবং ক্রেডিট রেটিংয়ের মান খারাপ হয় এবং বাজারে ব্যাংকের সুনাম ক্ষুণ্ন হয়। ফলে, বাজার থেকে আমানত সংগ্রহ করা কষ্টকর হয় বা বেশি সুদের হারে আমানত সংগ্রহ করতে হয়; এবং

৫. ঋণ প্রবাহ বিঘ্ন হলে, ঋণ না পাওয়ার কারণে নতুন নতুন উদ্দোক্তা সৃষ্টি হয় না, নতুন শিল্প গড়ে উঠে না, কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় না এবং দেশে অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পায়।

একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ভোটে নির্বাচিত হওয়ার জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টির কোনো বিকল্প নেই এবং কোনো বিকল্প নেই।

আমাদের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর এই বিশাল শ্রেণিকৃত ঋণের অভিশাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার পথ আমাদেরকেই খুঁজে বের করতে হবে।

আমি মনে করি, সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক যৌথভাবে একটি নিয়ন্ত্রিত এবং বিশেষ উদ্দেশ্যমূলক প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করা। যে প্রতিষ্ঠান উক্ত মন্দ ঋণের বিপরীতে জামানতকৃত সম্পত্তিগুলো একত্রিত করে শেয়ার আকারে বিনিয়োগকারীদের নিকট বিক্রি করবে। অথবা খেলাপি ঋণের ঋণ গ্রহীতা প্রতিষ্ঠানকে ক্রয়পূর্বক তা আগ্রহী বিনিয়োগকারীর কাছে সরাসরি বিক্রি করবে। পরবর্তী সময়ে ঋণের টাকা আদায় করে অথবা/এবং সম্পত্তি বিক্রির মাধ্যমে উক্ত প্রতিষ্ঠান তার নগদ প্রবাহ সচল রাখবে।

প্রাথমিকভাবে উক্ত প্রতিষ্ঠানের ৫,০০০.০০ থেকে  ২০,০০০.০০ কোটি টাকা মূলধন নিয়ে ব্যবসা শুরু করতে পারে। এই প্রতিষ্ঠান উক্ত অর্থ দিয়ে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মন্দ ঋণ কিনে নেবে। এই প্রতিষ্ঠান একজন ম্যানেজার নিয়োগ করবে; যিনি মন্দ ঋণের অন্তর্নিহিত সম্পদ থেকে সঠিক বাজার মূল্য পুনরুদ্ধারের দায়িত্ব পালন করবেন। এই ম্যানেজাররা অবশ্যই মূল ঋণদাতাদের কাছ থেকে স্বাধীন এবং নিরপেক্ষ হতে হবে।

এই পদক্ষেপের মাধ্যমে আমাদের অর্থনীতি অর্থাৎ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর তিনটি মূল লক্ষ্য পূরণ হবে:

১. দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের বাজার সম্প্রসারণ করা সম্ভব হবে এবং ব্যাংকগুলো পুনরায় যৌবন ফিরে পাবে;

২. বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্ভরতা হ্রাস পাবে; এবং

৩. মন্দ ঋণের অভিশাপ থেকে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো মুক্তি পাবে।

লেখক: ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক পিএলসি, ঢাকা

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর