-
- চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিলে মানা হয়নি সরকারি সিদ্ধান্ত
- নিয়ম নেই তবু কনসালটেন্টের তিনবার পুনঃনিয়োগ
- আইনকে বৃদ্ধাঙ্গলি দেখিয়ে করছেন রুটিন কাজ
- হাসিনার ঘনিষ্ঠ এমডির কল্যাণে কপাল খুলে ইসমাইলের
- বোর্ডের সিদ্ধান্তে সব হয়েছে: কনসালটেন্ট ইসমাইল মিয়া
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতন হলেও ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্প থেকে বিশেষায়িত পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ পদে এখনো বহাল আওয়ামীপন্থীরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মনীতি ও নির্দেশনাকে তোয়াক্কা না করে ব্যাংকটিতে কনসালটেন্ট পদে বারবার একই ব্যক্তিকে পুনঃনিয়োগ দেওয়ার ঘটনা ঘটছে। ২০১৮ সালে ব্যাংকটিতে কনসালটেন্ট পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া কৃষি ব্যাংকের সাবেক সহকারী মহাব্যবস্থাপক (এজিএম) মো. ইসমাইল মিয়াকে এ পর্যন্ত পুনঃনিয়োগ দেয়া হয়েছে তিনবার। বারবার নিয়োগ দিয়ে পাঁচ বছর গুরুত্বপূর্ণ এই পদে রাখা হলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী এই সুযোগই নেই। শুধু তাই নয়, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে সুযোগ নেই, তবু এই কর্মকর্তা বাৎসরিক ইনসেনটিভ বোনাস তুলছেন বলে তথ্য পাওয়া গেছে।
বিজ্ঞাপন
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করলেও এই কনসালটেন্টের বেলায় তা প্রয়োগ হয়নি। এখনো আগের পদে বহাল আছেন ইসমাইল মিয়া। অথচ শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসেবে পরিচিত ব্যাংকটির চেয়ারম্যান আকরাম-আল হোসেন ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ মো. জামিনুর রহমানের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল হয়েছে গত বছরের ২০ আগস্ট।
যদিও এমন সব সুযোগ দেওয়ার জন্য বোর্ডের ওপর দায় দিয়েছেন কনসালটেন্ট মো. ইসমাইল মিয়া। ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, 'আমি আবেদন করে তো পুনঃনিয়োগ নিইনি। বোর্ড সিদ্ধান্ত দিয়েছে।'
ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্প পরিচালক থেকে পরবর্তী সময়ে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) দায়িত্বে আসা আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত আকবর হোসেনের সময় প্রথম নিয়োগ পান মো. ইসমাইল মিয়া। এরপর থেকে আর তাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। প্রথমে দুই বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া ৬৬ বছর বয়সী কনসালটেন্ট মো. ইসমাইল মিয়ার জন্য আশীর্বাদ হয়ে আসেন সদ্য সাবেক এমডি শেখ মো. জামিনুর রহমান।
পালিয়ে যাওয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রক্ষা করে চলা জামিনুর রহমান ২০২২ সাল থেকে বিদায়ের আগ পর্যন্ত (২০ আগস্ট নিয়োগ বাতিল করা হয়) খেয়াল-খুশি মতো ব্যাংক পরিচালনা করেছেন। অভিযোগ আছে, বিদায়ী এমডির ছত্রছায়ায় কনসালটেন্ট মো. ইসমাইল মিয়া পুনঃনিয়োগ পাওয়া থেকে শুরু করে চুক্তিভিত্তিক কর্মকর্তা হয়েও ব্যাংকের দৈনন্দিন কাজের সঙ্গে জড়িত একাধিক বাড়তি দায়িত্ব পালন করেন। যার বেশির ভাগই আর্থিক সংশ্লিষ্ট।
অভিযোগ আছে, বিগত আমলের চেয়ারম্যান ও এমডির আর্থিক বিভিন্ন খাত থেকে সুবিধা নেওয়ার মাধ্যম হিসেবে কাজ করতেন কনসালটেন্ট মো. ইসমাইল মিয়া। যে কারণে বারবার তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়। যদিও এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিরীক্ষায় বারবার গুরুতর আপত্তিও ছিল। একইসঙ্গে তার বেলায় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং রেগুলেশন অ্যান্ড পলিসি ডিভিশনের (বিআরপিডি) দেওয়া নিয়মও মানা হয়নি।
নিয়ম নেই, তবু কনসালটেন্ট পদে তিনবার পুনঃনিয়োগ
জানা গেছে, যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও ২০১৮ সালের ৮ এপ্রিল দুই বছরের জন্য সাময়িকভাবে কনসালটেন্ট পদে নিয়োগ পান মো. ইসমাইল মিয়া। বিআরপিডির নির্দেশনা অনুযায়ী এই ধরনের পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে ট্যাক্স, আইন, ইঞ্জিনিয়ারিং, টেকনিক্যাল কাজ, ইনফরমেশন টেকনোলজি (আইটি) এসব বিষয়ে দক্ষতা থাকলে তাকে কনসালটেন্ট নিয়োগ দেওয়া যাবে। কিন্তু তার এমন কোনো বিশেষায়িত জ্ঞান, শিক্ষাগত যোগ্যতা ছিল না।
অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের সাংগঠনিক কাঠামোতে চুক্তিভিত্তিক কনসাল্টেন্ট বা পরামর্শক নামে পদ না নেই। আবার ব্যাংকের সালে নতুন প্রবিধানমালা-২০২২ এ পরিচালনা বোর্ড চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ধারাটিও তুলে দেওয়া হয়। তারপরও এই পদে পুনঃনিয়োগকে রাজনৈতিক বিবেচনায় বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
তথ্য অনুযায়ী, কনসালটেন্ট নিয়োগে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিআরপিডির ২০১৩ সালের ২৭ অক্টোবর জারি করা বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, পরামর্শক পদে পুনঃনিয়োগযোগ্য হবে না। কিন্তু মো. ইসমাইল মিয়াকে ২০১৮ সালে সাময়িকভাবে দুই বছরের জন্য নিয়োগের পর মেয়াদ শেষে ২০২০ সালের ১ মে মাস থেকে এক বছরের জন্য পুনরায় নিয়োগ দেওয়া হয়। এবারও মেয়াদ শেষ হলে ২০২১ সালে একাধিক বোর্ড সভা করে দুইবার তাকে পুনঃনিয়োগ দেওয়া হয়। প্রথম দফায় ওই বছরের ১ মে থেকে এক বছর, পরের বার ২০২৪ সালের ৩০ এপ্রিল তারিখ পর্যন্ত অর্থাৎ তিন বছরের জন্য চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হয়। এখানেই শেষ নয়, ২০২৪ সালে মেয়াদ শেষ হলে আবারও তার চুক্তির মেয়াদ ২০২৫ সালের এপ্রিল পর্যন্ত বাড়ানো হয়।
চতুর্থবার পুনঃনিয়োগের চেষ্টায় ইসমাইল
ব্যাংকটির একাধিক মাঠ সহকারী ও কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চলতি মাসে চুক্তির মেয়াদ শেষ হচ্ছে মো. ইসমাইল মিয়ার। সময় শেষ হওয়ার আগে দ্রুত বোর্ড সভা করে আবারও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেতে জোর চেষ্টা করছেন তিনি। এই নিয়োগ নিশ্চিত করতে ব্যাংকে নিয়োগপ্রাপ্ত আওয়ামী সমর্থক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বড় একটি গ্রুপকে দিয়ে চাপ প্রয়োগের চেষ্টা করছেন। পাশাপাশি অন্যান্য রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং প্রধান কার্যালয়ের পঞ্চম গ্রেডের কর্মকর্তাদের সঙ্গেও দেন দরবার তদবির চালাচ্ছেন তিনি।
বাগিয়েছেন গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের ডজনখানেক দায়িত্ব
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায় যে, ইসমাইল মিয়াকে নিয়োগের সময় তার যে কার্যপরিধি দেওয়া হয়েছে সেখানেও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ উঠেছে। তার টার্মস অব রেফারেন্স যাচাই করে দেখা গেছে, বোর্ড সচিব, ব্যাংকের সিবিএস বাস্তবায়ন, এইচআরএম ইনভেন্টরি মডিউল বাস্তবায়ন, ভিপিএন লাইন সংযোজন বাস্তবায়নসহ কমপক্ষে ডজনখানেক দায়িত্ব তার কাছে রাখা হয়েছে। যার মধ্যে ব্যাংকের একাধিক বিভাগের প্রধানের রুটিন দায়িত্বও তিনি পালন করছেন। অথচ চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তির ব্যাংকের দৈনন্দিন কাজ করার সুযোগ নেই।
আইন লঙ্ঘন করে তুলেছেন ইনসেনটিভ বোনাস
বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, কনসালটেন্ট পদটি স্থায়ী নয়। সেক্ষেত্রে তার নির্ধারিত সম্মানির বাইরে যাতায়াত ও টেলিফোন সুবিধা পাওয়ার কথা ইসমাইল মিয়ার। কিন্তু ব্যাংক হিসেবে যাত্রা শুরুর পর এ পর্যন্ত দুইবার বাৎসরিক ইনসেনটিভ বোনাস দেওয়া হয়েছে কর্মীদের। অথচ নিয়ম ভেঙে ২০২৪ সালের এপ্রিলে ইনসেনটিভ বোনাস হিসেবে এক লাখ ১৬ হাজার ৯৯০ টাকা উত্তোলন করেছেন এই কনসালটেন্ট। অবশ্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া অন্য কেউ এই টাকা পাননি। তবে অন্য কর্মকর্তাদের প্রতিবাদের মুখে দ্বিতীয়বার চাইলেও বোনাস নিতে পারেননি তিনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘নিয়মিত কর্মকর্তা-কর্মচারীগণের পাশাপাশি কনসালটেন্ট মো. ইসমাইল মিয়া বাৎসরিক ইনসেনটিভ বোনাস উত্তোলন করেছেন। অনেকটা জোর করে নিয়েছেন। কারণ নিয়ম না থাকায় অন্যরা এই টাকা পাননি।’
সার্বিক বিষয় নিয়ে জানতে চাইলে বুধবার (১৬ এপ্রিল) সকালে মো. ইসমাইল মিয়া ঢাকা মেইলকে বলেন, 'আমি বোর্ডের সিদ্ধান্তে একাধিকবার নিয়োগ পাইনি। আবেদন করে তো সময় বাড়াইনি।' নতুন করে আর যেন মেয়াদ বাড়িয়ে চাকরি করার ইচ্ছে নেই জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি তো বলে দিয়েছি আর যেন মেয়াদ না বাড়ায়। দেখি বোর্ড কী করে।'
ইনসেনটিভ বোনাস নেওয়ার কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, 'আমার তো টাকা নেওয়ার সুযোগ নেই। বোর্ড দিয়েছে বলেই তো নিতে পেরেছি।'
আওয়ামী লীগ আমলের চেয়ারম্যান-এমডির প্রভাবে এমনটা করার সুযোগ পেয়েছেন বলে অভিযোগ আছে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘তাদের সময়ে চাকরি করেছি ঠিক। কিন্তু প্রভাব দেখানোর সুযোগ কোথায়?'
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক নন-শিডিউল ব্যাংক। কাজেই এসব ব্যাংকের কার্যক্রম বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরাসরি তদারকি করা হয় না। তবে কেউ অনিয়ম করলে তাকে অবশ্যই জবাবদিহিতার আওতায় আনা উচিত।’
আর বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তফা কে মুজেরী ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘পরামর্শক নিয়োগের ক্ষেত্রে একটা কিওয়ার্ড বা টার্ম থাকে এবং সেই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তিনি তার সুপারিশমালা দিয়ে থাকেন। ব্যাংক সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এখন নীতিমালা না থাকা সত্ত্বেও যদি মেয়াদ বাড়ানো হয় তবে সেটা বেআইনি। আর পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক যে উদ্দেশ্য নিয়ে গঠন করা হয়েছিল সেটা তেমন একটা সফলতার মুখ দেখেনি। এই ব্যাংক যেভাবে অপারেট করানো হচ্ছে তা তার মুখ্য উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সংগতিপূর্ণ নয়। কাজেই এই ব্যাংক যেই ম্যান্ডেট নিয়ে গঠন করা হয়েছিল সেভাবেই পরিচালনা করা উচিত।’
বিইউ/জেবি