সোমবার, ১৭ মার্চ, ২০২৫, ঢাকা

পলিটেকনিকের ইনস্ট্রাক্টর হুমায়ুনের সম্পদের পাহাড়

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৯ মার্চ ২০২৫, ০৪:৩৩ পিএম

শেয়ার করুন:

পলিটেকনিকের ইনস্ট্রাক্টর হুমায়ুনের সম্পদের পাহাড়
হুমায়ুন কবীরের বিরুদ্ধে দুদকের দুই মামলা। ছবি: সংগৃহীত
  • শতকোটি টাকার সম্পদের মালিক হুমায়ুন দম্পতি
  • স্বামীর সঙ্গে সম্পদশালী হয়েছেন স্ত্রী বেবী আলিয়াও
  • ঢাকা-ময়মনসিংহ-গাজীপুরে শতকোটি টাকার জমি
  • হুমায়ুন দম্পতির বিরুদ্ধে দুদকের দুই মামলা

বাবা কাঠমিস্ত্রি, স্ত্রী গৃহিণী। আর নিজে ময়মনসিংহ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ইনস্ট্রাকটর (নন-টেক) হিসেবে চাকরি করছেন। হুমায়ুন কবীর নামের এই পলিটেকনিকের শিক্ষক শতকোটি টাকারও বেশি সম্পদের মালিক। শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হলেও দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্তে হুমায়ুন কবীর ও তার স্ত্রী বেবী আলেয়া হাসনাতের এই সম্পদের খোঁজ মিলেছে। নগদ টাকার বাইরেও ঢাকা, ময়মনসিংহ ও গাজীপুরের টঙ্গীতে বিপুল পরিমাণ জমিও কিনেছেন এই দম্পতি। এতদিন নির্বিঘ্নে চললেও এবার ধরা পড়েছেন দুদকের জালে। ইতোমধ্যে দুটি মামলা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। মামলায় আসামি হয়েছেন হুমায়ুনের বাবাও।


বিজ্ঞাপন


জানা গেছে, গত ৫ মার্চ দুদকের ময়মনসিংহ সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে দুদকের উপসহকারী পরিচালক মো. শাহাদত হোসেন বাদী হয়ে পৃথক দুটি মামলা দায়ের করেন তাদের বিরুদ্ধে। যদিও দুদকের মামলায় তাদের সম্পদের প্রকৃত মূল্যের তথ্য উঠে আসেনি।

দুদক সূত্রে জানা যায়, মামলায় ময়মনসিংহ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ইনস্ট্রাক্টর (নন-টেক) মো. হুমায়ুন কবীর, তার স্ত্রী বেবী আলিয়া হাসনাত ও বাবা কাঠমিস্ত্রি মো. আলী হোসেনকে আসামি করা হয়েছে।

অবশ্য পলিটেকনিক ইনস্ট্রাক্টর হুমায়ুন কবীরের দাবি, তার কোনো অবৈধ সম্পদ নেই। তিনি বলেন, আমি যতটুকু জানি তদন্ত চলমান ছিল। মামলা হয়েছে কি না জানা নেই। আমার যা সম্পদ তার হিসাব জমা দিয়েছি। এর বাইরে সম্পদ নেই। অর্জিত সব সম্পদের বৈধ উৎস রয়েছে। আমার কোনো অবৈধ সম্পদ নেই।

যা আছে মামলার এজাহারে


বিজ্ঞাপন


মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, হুমায়ুন কবীরের বিরুদ্ধে সম্পদ স্থানান্তর, হস্তান্তর ও রূপান্তরসহ দুদকে দাখিলকৃত সম্পদ বিবরণীতে ১৩ কোটি ৬ লাখ ১২ হাজার ১৪০ টাকার সম্পদের তথ্য গোপন করে মিথ্যা তথ্য প্রদানের অভিযোগ পেয়েছে দুদক।

এছাড়াও ১৫ কোটি ৭১ লাখ ৫০ হাজার ৮২৯ টাকার জ্ঞাত আয়ের উৎসের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ সম্পদ অর্জনের প্রমাণ পেয়েছে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটি।

এজাহার সূত্রে জানা গেছে, তাদের বিরুদ্ধে দুদক আইন, ২০০৪ এর ধারা ২৬(২) ও ধারা ২৭(১) এবং মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর ধারা ৪(২), ও ধারা ৪(৩) এবং দণ্ডবিধি'র ১০৯ ধারায় মামলাটি দায়ের করা হয়েছে।

জানা গেছে, দুদক থেকে হুমায়ুন কবীরের বিরুদ্ধে সম্পদের হিসাব চেয়ে নোটিশ দিলে ২০২৩ সালের ১০ ডিসেম্বর সম্পদের হিসাব দাখিল করেন। যেখানে মো. হুমায়ুন কবীর ৪ কোটি ৩১ লাখ ৮০ হাজার ৫৫০ টাকার স্থাবর ও ৩ লাখ ৪৩ হাজার ৪৪৭ টাকার অস্থাবর সম্পদসহ মোট ৪ কোটি ৩৫ লাখ ২৩ হাজার ৯৯৭ টাকার সম্পদের ঘোষণা করেছেন। কিন্তু যাচাইকালে তার নামে ১৭ কোটি ৩৭ লাখ ৯২ হাজার ৬৯০ টাকার স্থাবর ও ৩ লাখ ৪৩ হাজার ৪৪৭ টাকার অস্থাবর সম্পদসহ মোট ১৭ কোটি ৪১ লাখ ৩৬ হাজার ১৩৭ টাকার সম্পদের তথ্য পাওয়া যায়।

অর্থাৎ হুমায়ুন কবীরের নামে ১৩ কোটি ৬ লাখ ১২ হাজার ১৪০ টাকার সম্পদের কোনো বৈধ উৎস পাওয়া যায়নি, যা তিনি গোপন করেছেন।

অন্যদিকে দুদকের অনুসন্ধানে ১৫ কোটি ৭১ লাখ ৫০ হাজার ৮২৯ টাকার জ্ঞাত আয়ের উৎসের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ সম্পদ থাকার দালিলিক প্রমাণ পাওয়া গেছে।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, হুমায়ুন কবীর তার ক্রয়কৃত জমির অধিকাংশ তার স্ত্রী বেবী আলিয়া হাসনাত ও তার বাবা আলী হোসেনের নামে ক্রয়ের কিছুদিন পর নিজ নামে হেবা করে নিয়েছেন। নিজের অবৈধভাবে অর্জিত টাকা স্থানান্তর, হস্তান্তর ও রূপান্তর করতেই এমন কৌশল গ্রহণ করেছেন বলে প্রমাণ মিলেছে।

এছাড়া তার নামে স্কাবো মেডিকেল টেকনোলজি (প্রাইভেট) লিমিটেড নামের প্রতিষ্ঠানের ১ হাজার ৩৫০টি শেয়ার থাকার তথ্য মিলেছে, অন্যদিকে তাদের সিঙ্গাপুর ও ভারতসহ বিভিন্ন দেশে গমনাগমনের তথ্যও মিলেছে দুদকের অনুসন্ধানে।

আরও পড়ুন

৭৮১ কোটির অবৈধ সম্পদ, নজরুল মজুমদারের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা

স্বরাষ্ট্রের বহু ‘অপকর্মের হোতা’ সেই ধনঞ্জয় বরখাস্ত

দুদকের দায়ের করা আরেকটি মামলা বেবী আলিয়া হাসনাত, মো. হুমায়ুন কবীর ও হুমায়ুনের বাবা আলী হোসেনকে আসামি করা হয়েছে। ওই মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে ৩ কোটি ৫০ লাখ ৬৬ হাজার ৩৪৬ টাকার সম্পদের তথ্য গোপন ও ৪ কোটি ৪৬ লাখ ৭৮ হাজার ১৩৫ টাকার জ্ঞাত আয়ের উৎসের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে।

তথ্য অনুযায়ী, পেশায় গৃহিণী বেবী আলিয়া হাসনাত ২০২৩ সালের ১০ ডিসেম্বর দুদকে সম্পদ বিবরণী দাখিল করেন। সেখানে তিনি ১ কোটি ১৪ লাখ ৩৬ হাজার ৮৯ টাকার সম্পদের ঘোষণা দেন। কিন্তু যাচাইকালে স্থাবর-অস্থাবর মিলিয়ে ৪ কোটি ৬৫ লাখ ২ হাজার ৪৩৫ টাকার সম্পদের তথ্য পাওয়া যায়। অর্থাৎ ৩ কোটি ৫০ লাখ ৬৬ হাজার ৩৪৬ টাকার সম্পদের তথ্য গোপন করেছেন তিনি। তার বিরুদ্ধে দুদক আইন ২০০৪ এর ২৬ (২) ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে। যেখানে তার স্বামী ও শ্বশুরকে সহযোগিতার জন্য আসামি করা হয়েছে।

১১ বছরে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন হুমায়ুন দম্পতি

মো. হুমায়ুন কবীর ও তার স্ত্রীর বেবী আলিয়া হাসনাতের নামে মোট ৫১৫ দশমিক ৪৯ শতাংশ জমির দালিলিক প্রমাণ পাওয়া গেছে। যার বাজার মূল্য ১৪০ থেকে ১৫০ কোটি টাকা হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যদিও মৌজা মূল্য অনেক কম।

জানা গেছে, দুদকের মামলায় এই পরিমাণ জমির দাম কম থাকার কারণ সংস্থাটি দালিলিক মূল্য আমলে নিয়ে মামলায় অভিযোগ নিয়েছে। কিন্তু বাস্তবে ওই সম্পদের প্রকৃত মূল্য অনেক বেশি।

দুদকের অনুসন্ধানের তথ্য বলছে, মো. হুমায়ুন কবীরের নামে ময়মনসিংহ ও গাজীপুরে মোট ৪৪৫ দশমিক ৪৯ শতাংশ জমির দালিলিক প্রমাণ মিলেছে। যার মধ্যে গাজীপুরের টঙ্গী পৌরসভায় ৩ দশমিক ০৪ শতাংশ জমি বাদে সবই ময়মনসিংহ সদরের আওতাধীন বিভিন্ন এলাকার জমি। এই জমিগুলো ২০১২ সাল থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে বিভিন্ন কৌশলে মালিকানা অর্জন করেছেন বলে দুদকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে।

সম্পদ বিবরণীতে প্রদর্শিত মূল্য ধরা হয়েছে ৪ কোটি ৩১ লাখ ৮০ হাজার ৫৫০ টাকা। আর মৌজা হিসাবে দালিলিক মূল্য পাওয়া গেছে ১৭ কোটি ৩৭ লাখ ৯২ হাজার ৬৯০ টাকা। বাস্তবে যার মূল্য ১১৫ থেকে ১২০ কোটি টাকা বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।

অন্যদিকে তার স্ত্রীর বেবী আলিয়া হাসনাতের নামে ৭০ শতাংশ জমির মালিকানা পাওয়া গেছে। এর মধ্যে রাজধানীর শ্যামলীতে সাড়ে ৬ শতাংশ জমি রয়েছে, বাকিগুলো ময়মনসিংহে। যার মৌজা মূল্য ১ কোটি ৭৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা হলেও বাস্তবে তার মূল্য ১৫ থেকে ১৮ কোটি টাকা হবে বলে জানা গেছে।

বিইউ/জেবি

 

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর