সোমবার, ২৮ এপ্রিল, ২০২৫, ঢাকা

বিপাকে রফতানিকারকরা, উদ্বিগ্ন ব্যবসায়ীরা

মহিউদ্দিন রাব্বানি
প্রকাশিত: ০৯ এপ্রিল ২০২৫, ১১:০৫ এএম

শেয়ার করুন:

বিপাকে রফতানিকারকরা, উদ্বিগ্ন ব্যবসায়ীরা

# কারখানা বন্ধের শঙ্কা, শ্রমজীবী মানুষরা জীবন-জীবিকায় অনিশ্চয়তার মুখে পড়তে যাচ্ছে
# বাংলাদেশের পোশাকে উচ্চ শুল্ক আরোপ উচিত হয়নি: পল ক্রুগম্যান
# ট্রাম্পের শুল্কঝড়ে বৈশ্বিক বাণিজ্যে ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে: অর্থনীতিবিদদের অভিমত
# বৈশ্বিক মুদ্রাস্ফীতির হার ০.৭ থেকে ১.৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে: গবেষণা
# ১০০ ডলারের টি-শার্ট রফতানিতে শুল্ক বাবদ গুনতে হবে প্রায় ৪৯ ডলার
#সক্রিয় ও কৌশলগত পদক্ষেপের মাধ্যমে সাহসের সঙ্গে পোশাক শিল্পের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে: ড. আইনুল ইসলাম

আজ বুধবার (৯ এপ্রিল) থেকে যুক্তরাষ্ট্রে কার্যকর হতে যাচ্ছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন শুল্ক আদেশ। তবে অতিরিক্ত শুল্ক কার্যকরের পর বিপাকে পড়ছেন বাংলাদেশের পোশাক রফতানিকারকরা। পাশাপাশি উদ্বেগের কথাও জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। নতুন করে বড় ধাক্কা শামাল দিতে হবে তাদেরকে। এদিকে রফতানিকারকরা কতটুকু শুল্কের চাপে পড়ছেন তা নির্দিষ্ট করে জানা যায়নি। এছাড়া দেশের বড় ব্যবসায়ী ও রফতানিকারকরা এখনো জানেন না, নতুন শুল্ক হার বর্তমান শুল্কের সঙ্গে যোগ করা হবে নাকি প্রতিস্থাপন করা হবে।


বিজ্ঞাপন


বাংলাদেশ থেকে রফতানি করা পণ্যে ৩৭ শতাংশ শুল্কের ঘোষণা দেওয়া হলেও পণ্যভিত্তিক কোনো দিকনির্দেশনা না থাকায় বিভ্রান্তিতে রয়েছেন অনেক ব্যবসায়ী।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ট্রাম্পের শুরু করা শুল্কঝড়ে বৈশ্বিক বাণিজ্যে ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে। সংকটে থাকা পোশাকশিল্প ও ২০২৬ সালে এলডিসি উত্তরণে ট্রাম্পের এই শুল্কঝড় সমূহ ক্ষতির কারণ হতে পারে। সবাই একবাক্যে বলছেন, এই সিদ্ধান্ত শুধু যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ শিল্পসুরক্ষার উদ্দেশ্যে বলা হলেও, আদতে এর মাধ্যমে চলমান বৈশ্বিক বাণিজ্যব্যবস্থার ভিত্তিকেই চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। এর প্রমাণ ট্রাম্পের ঘোষণার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ৩.১ ট্রিলিয়ন ডলারের মার্কেট ভ্যালু বিশ্ববাজার থেকে মুছে গেছে।

গবেষকেরা দেখেছেন, বড় অর্থনীতির দেশগুলোর বাণিজ্য উত্তেজনা ছোট-বড় সব দেশের প্রবৃদ্ধিতে আঘাত করে। নতুন উত্তেজনায় প্রবৃদ্ধির উল্লেখযোগ্য অংশ হ্রাসের আশঙ্কা রয়েছে, মাঝারি ও স্থায়ী মেয়াদে এর পরিমাণ যথাক্রমে ১ ও ২ শতাংশ হতে পারে। অতিরিক্ত শুল্কের কারণে আমদানি পণ্যের দাম বেড়ে ভোক্তাদের জন্য মূল্যবৃদ্ধি ঘটাবে, যা বৈশ্বিকভাবে মুদ্রাস্ফীতির চাপ সৃষ্টি করবে। এখন বৈশ্বিক মুদ্রাস্ফীতির হার ০.৭ থেকে ১.৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে।

অনেক বাংলাদেশি পোশাক রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান যুক্তরাষ্ট্রের বাজার থেকে সরে আসতে বাধ্য হতে পারে। ফলে এর সরাসরি প্রভাব পড়বে শ্রমিকদের ওপর। কিছু কারখানাও বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ইতোমধ্যে শ্রমিক ছাঁটাইয়ের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। ফলে শ্রমজীবী মানুষদের জীবন-জীবিকা চরম ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তার মুখে পড়বে।

এর আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত ২ এপ্রিল নির্বাহী আদেশে বাংলাদেশ থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন। যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান শুল্কের বাইরে যদি ৩৭ শতাংশ শুল্ক যোগ করা হয়, তাহলে অনেকেই আশঙ্কা করছেন, বাংলাদেশের পোশাকের ওপর কার্যকর শুল্ক বর্তমান গড় ১১ দশমিক ৫৬ শতাংশ থেকে বেড়ে ৪৮ দশমিক ৫৬ শতাংশে দাঁড়াবে। অর্থাৎ ঢাকা থেকে ১০০ ডলারের টি-শার্ট বা জিন্সের চালানে যুক্তরাষ্ট্রের বন্দরে আমদানি শুল্ক বাবদ প্রায় ৪৯ ডলার দিতে হবে, যা বর্তমানে মাত্র ১১ দশমিক ৫৬ ডলার।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ৩৭ শতাংশ পাল্টা শুল্কে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক পণ্যের রপ্তানির ওপর প্রভাব পড়বে, যা দেশের জন্য অত্যন্ত উদ্বেগজনক বলে মন্তব্য করেছে সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশন। সম্প্রতি এক বিজ্ঞপ্তিতে সংগঠনটি জানায়, পাল্টা শুল্ক আরোপের ফলে দেশের তৈরি পোশাকশিল্পের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমে যাবে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারা বিকল্প উৎসে পণ্য সংগ্রহ করতে উৎসাহিত হবে।

বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, অনেক বাংলাদেশি পোশাক রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান যুক্তরাষ্ট্রের বাজার থেকে সরে আসতে বাধ্য হতে পারে। ফলে এর সরাসরি প্রভাব পড়বে শ্রমিকদের ওপর। কিছু কারখানাও বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ইতোমধ্যে শ্রমিক ছাঁটাইয়ের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। ফলে শ্রমজীবী মানুষদের জীবন-জীবিকা চরম ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তার মুখে পড়বে।

উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বৈদেশিক আয়ের একটি বড় অংশ তৈরি পোশাক খাত থেকে অর্জিত হয়। এই খাতে প্রায় ৪০ লাখের বেশি শ্রমিক কাজ করেন। পাল্টা শুল্ক আরোপের বিষয়টি কূটনৈতিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সঙ্গে আলোচনার জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানায় সংগঠনটি। এ ক্ষেত্রে মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব যেন শ্রমিকের মজুরির ওপর না পড়ে, তার দায়ভার ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিতে হবে।

নতুন করে আরোপ করা শুল্ক ঘোষণায় বিশ্বব্যাপী সমালোচনার ঝড় উঠেছে। খোদ ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীরাই সমালোচনা করছেন বেশি। শুল্ক আরোপের ঘোষণার পর থেকে সারা বিশ্বে পুঁজিবাজারগুলোয় ব্যাপক দরপতন হচ্ছে।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য প্রবেশের ওপর ১০ শতাংশ ভিত্তি ধরে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিশ্বজুড়ে আরোপ করা শুল্ক গত শনিবার থেকে কার্যকর হয়েছে। ফলে দেশটির আমদানি করা সব পণ্যের ওপর এদিন থেকেই বাড়তি অর্থ আদায় শুরু করেছে ট্রাম্প প্রশাসন। ট্রাম্পের নতুন শুল্ক ঘোষণায় বিশ্বজুড়ে পুঁজিবাজারে অস্থিরতা এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে বিক্ষোভ শুরু হওয়ার প্রেক্ষাপটে দেশবাসীকে ‘অনমনীয়’ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরুর সময় অর্থাৎ ২০২০ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত মার্কিন পুঁজিবাজারের জন্য এটিই ছিল সবচেয়ে খারাপ সপ্তাহ। ফেডারেল সরকারের আকার কমানোসহ ট্রাম্পের নতুন আর্থিক নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে গত শনিবার ওয়াশিংটন ডিসি, নিউইয়র্ক ও অন্যান্য শহরের রাস্তায় নেমে আসেন হাজারো মানুষ। ট্রাম্প পুঁজিবাজারের ওই অস্থিরতাকে ‘অর্থনৈতিক বিপ্লব’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র এতে জিতবে (অস্থিরতা কাটিয়ে উঠবে)।

নতুন করে আরোপ করা শুল্ক ঘোষণায় বিশ্বব্যাপী সমালোচনার ঝড় উঠেছে। খোদ ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীরাই সমালোচনা করছেন বেশি। শুল্ক আরোপের ঘোষণার পর থেকে সারা বিশ্বে পুঁজিবাজারগুলোয় ব্যাপক দরপতন হচ্ছে।

সম্প্রতি ফিশার ইনভেস্টমেন্টের প্রতিষ্ঠাতা এবং নির্বাহী চেয়ারম্যান ধনকুবের কেন ফিশার এক্সে এক পোস্টে বলেছেন, ট্রাম্প যে ঘোষণা দিয়েছেন, সেটা বোকামি, ভুল, চরম উদ্ধত, ব্যবসায়িক অভিজ্ঞতাকে অবজ্ঞা করা এবং সমস্যাই নয়- এমন একটি বিষয়কে ভুল যন্ত্র দিয়ে সমাধানের চেষ্টা করা। আমার অভিজ্ঞতা বলছে, এটা ব্যর্থ হবে এবং সমস্যা যতটা তার চেয়ে আতঙ্ক বেশি এবং এখান থেকে এটা অতিরঞ্জিত।

এদিকে বাংলাদেশ থেকে আমদানি করা পোশাকের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ শুল্ক আরোপ উচিত হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন নোবেলজয়ী মার্কিন অর্থনীতিবিদ পল ক্রুগম্যান। তিনি বলেছেন, এই সিদ্ধান্ত মার্কিন ক্রেতাদের জীবনে বিঘ্ন ঘটাবে এবং মার্কিনিদের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাবে।

মার্কিন সংবাদমাধ্যম দৈনিক দ্য নিউইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন। বিভিন্ন দেশের ওপর ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের আরোপিত শুল্ককে বিশ্বের ইতিহাসের বৃহত্তম বাণিজ্যিক ধাক্কা বলেও অভিহিত করেছেন ক্রুগম্যান।

পল ক্রুগম্যান বলেছেন, বাংলাদেশ থেকে পোশাক আমদানিতে উচ্চ শুল্ক আরোপ করাটা একেবারেই উচিত নয়। এটি এমন এক পদক্ষেপ যা আমেরিকান ক্রেতাদের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়িয়ে তোলে, আমাদের অধিক নিরাপত্তার জন্য কিছুই করে না।

তিনি বলেন, জাতীয় নিরাপত্তা বিবেচনায় দেশীয় উৎপাদন বাড়ানোর কথা বলা হচ্ছে। তবে এক্ষেত্রে বন্ধু ও প্রতিবেশী দেশগুলোর কথাও বিবেচনায় রাখতে হবে। নিকটবর্তী দেশগুলো থেকে পণ্য নিলে সরবরাহ ব্যবস্থা সহজ ও নিরাপদ থাকবে। যদি আমরা এটি করতে চাই, তাহলে আমরা ভিয়েতনাম এবং বাংলাদেশে শুল্ক আদায় করব না। আমরা অবশ্যই কানাডা এবং মেক্সিকোর ওপর শুল্ক আরোপ করবো না; যদিও এসব দেশ শুল্ক থেকে অব্যাহতি পেয়েছে।

দেশের অন্যতম বৃহৎ ডেনিম রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান প্যাসিফিক জিন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ এম তানভীর গণমাধ্যমকে বলেন, আমরা সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। কারণ ট্রাম্পের আদেশে পরিষ্কারভাবে এটিকে ‘অতিরিক্ত’ শুল্ক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে ৯ এপ্রিলের আগে আমরা নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারব না।

হোয়াইট হাউসের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এই আদেশের দ্বারা নির্ধারিত শুল্কের হারগুলো প্রযোজ্য অন্য কোনো শুল্ক, ফি, কর বা চার্জের অতিরিক্ত। তবে তারা দেশ বা পণ্য অনুসারে আর কিছু জানায়নি।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মাহবুবুর রহমান বলেন, আমরা এখনো পরিষ্কার নই। এটি ৩৭ শতাংশ হতে পারে, কিংবা যদি বর্তমান মোস্ট ফেভারড নেশন (এমএফএন) হারের সঙ্গে যোগ করা হয় তাহলে ৫২ শতাংশেরও বেশি হতে পারে, যা বাংলাদেশের জন্য ইতোমধ্যে অনেক পণ্যে ১৫ শতাংশের ওপরে আছে।

বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক ড. মো. আইনুল ইসলাম মনে করেন, দেশের উদ্ভূত সামগ্রিক বাণিজ্য মোকাবেলা করার জন্য পণ্যের গুণগত মান ঠিক রাখা দরকার। পাশাপাশি উদ্ভাবনী পণ্য তৈরি করতে গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগ করা যেতে পারে, যা বিশ্ববাজারের পরিবর্তিত চাহিদা পূরণ করতে পারে।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক মনে করেন, বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের স্থিতিস্থাপকতা ও অভিযোজন ক্ষমতার ওপর আস্থা রেখে বলা যায়, সক্রিয় ও কৌশলগত পদক্ষেপের মাধ্যমে চলমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে সাহসের সঙ্গে।

এমআর/এএস

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর