প্রতিবছর রমজান এলেই মাছ-মাংস, শাক-সবজি থেকে শুরু করে প্রতিটি নিত্যপণ্যের দাম বাড়তে বাড়তে দ্বিগুণেরও বেশি হয়ে যায়। বিশেষ করে রোজায় ইফতারিতে ব্যবহৃত আমদানিনির্ভর ফল, ছোলা, চিনি, খেজুর, ইসুবগুলের দামে আগুন লাগে। বছরের পর বছর ধরে এমন চিত্রই দেখে আসছেন দেশবাসী। তবে এবার ভিন্ন চিত্র। ভোক্তারা বলছেন, গত ১০ বছরের মধ্যে এবার রজমানে পণ্যের দাম সবচেয়ে কম। বেশিরভাগ খাদ্যপণ্যই ক্রেতা সাধারণের হাতের নাগালে রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আওয়ামী লীগের গত ১৫ বছরের শাসনামলে অসাধু ব্যবসায়ীদের যে সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছিল তা এখন ভেঙে গেছে। এছাড়াও এবছর রমজানকে সামনে রেখে ট্যাক্স-ভ্যাট কমার পাশাপাশি পণ্য আমদানি বেড়েছে, যার সুফল মিলছে বাজারে।
বিজ্ঞাপন
ব্যবসায়ীরা বলছেন, রমজানে বাজারকে স্থিতিশীল রাখতে এবছর সরকার অগ্রিম কর অব্যাহতি, কাস্টমস ডিউটি ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ নির্ধারণ এবং অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু কমিয়ে শুল্কায়ন করেছে। ফলে খেজুরসহ বেশ কটি পণ্যের আমদানি দ্বিগুণ হয়েছে। এতে দাম কমেছে। তবে রোজার শুরুতে বোতলজাত ভোজ্য তেলের সরবরাহ কিছুটা কম থাকলেও এখন আবার স্বাভাবিক হয়েছে। ২ লিটারের বোতল মিলছে ১৭৫ থেকে ১৮০ টাকায়।
বাজার পর্যালোচনায় দেখা গেছে, এবছর রান্নার অন্যতম অনুষঙ্গ পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে পানির দরে। বাজারে ৩০ থেকে ৪০ টাকা কেজি দরে মিলছে পেঁয়াজ, যা গত কয়েক বছরে কল্পনাও করা যেত না। বিগত বছরগুলোতে পেঁয়াজের দাম ৭০-৮০ টাকার নিচে ছিল না। গতবছরই রোজায় পেঁয়াজের কেজি ছিল ১০০ থেকে ১২০ টাকা। বেগুনের কেজি ছিল ১০০ টাকা যা এই বছর ৭০-৮০ টাকা। গত বছর টমেটোর কেজি ছিল ৫০-৬০ টাকা, যা এই বছর ৩০-৪০ টাকা। গত বছর শশার কেজি ছিল ১০০ থেকে ১২০ টাকা, যা এই বছর ৫০ থেকে ৬০ টাকা।
বিজ্ঞাপন
এছাড়া মুরগি ব্রয়লার ২১০ টাকা, লেয়ার ৩৩০ টাকা, সোনালী ৩০০ টাকা, দেশি ৬৬০ টাকা ও হাঁস ৭৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। আর গরুর মাংস ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকা কেজি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রোজার পণ্য’ বলে বিবেচিত যেগুলো দাম নতুন করে বেড়ে যাওয়াই এতদিনের অভিজ্ঞতা। তবে এবার এসব পণ্যের সিংহভাগের দামই স্থিতিশীল কিংবা নিম্নগামী। যেমন খেজুরের দাম সহনীয় করতে কর-শুল্ক হ্রাসের পদক্ষেপ সুফল দিয়েছে। এমন আরও কিছু পণ্যে একই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল, আর সেটা বেশ আগে। তাতে আমদানি ও সরবরাহ অনেক বেড়েছে। সরবরাহ বাড়লে ‘সিন্ডিকেটবাজি’র সুযোগও কমে আসে।
চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা বলছেন, বর্তমানে প্রতি কেজি খেজুরের দাম বছরের ব্যবধানে কমেছে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ। এবার ১০ শতাংশ শুল্কহার কমানোয় খেজুরের দাম কমেছে।
রোজায় বেকারিতে চাহিদা হ্রাসের কারণে হোক অথবা যে কারণেই হোক, এবার ডিমের দাম কম। এলাকা ভেদে ৪২ থেকে ৪৫ হালি বিক্রি হচ্ছে।
চট্টগ্রামের বাজারগুলোতে ইফতারের প্রধান উপাদান ছোলা, চিনি, বেসনের দাম স্বস্তিদায়ক পর্যায়ে রয়েছে। ছোলা বিক্রি হচ্ছে প্রতিকেজি ১১০ টাকা দরে, খেসারি ১৩০, বেসন ১২০, চিনি ১৩০, মুড়ি-চিড়া প্রতিকেজি ৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া দেশি পেঁয়াজ ৩০-৩৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এদিকে আঙুর, নাশপাতি, কমলা, মাল্টাসহ কয়েক ধরনের ‘তাজা ও শুকনা’ ফল আমদানির উৎসে কর কমানোর পর এবার সম্পূরক শুল্ক কমানো হয়েছে। সোমবার (১৭ মার্চ) এসব ফল আমদানিতে ২৫ শতাংশের ওপর থাকা অতিরিক্ত সম্পূরক শুল্ক তুলে নিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। ফলে আমদানিনির্ভর এসব ফলের দাম আরও কমবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এর আগে ১৩ মার্চ কয়েক ধরনের ‘তাজা ও শুকনা’ ফল আমদানির উৎসে কর ১০ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়।
গত ৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশ ছেড়ে পালানোর মাধ্যমে ১৫ বছরের আওয়ামী শাসনের পতন ঘটে। এর ফলে ভেঙে যায় দীর্ঘ সময়ের বাজার সিন্ডিকেট। পাশাপাশি বন্ধ হয়েছে চাঁদাবাজি। বাজারে এর সুফল পড়েছে বলেও মনে করছেন ভোক্তা ও বাজার বিশ্লেষকরা।
এ ব্যাপারে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসাইন ঢাকা মেইলকে বলেন, দুই একটা পণ্যে অস্থিরতা থাকলেও এই বছর অনেক পণ্যেরই দাম কমেছে। বিশেষ করে কৃষিপণ্য। সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম অনেকটাই কমেছে। ফলে বাজারে এর সুফল পড়েছে।
তিনি আরও বলেন, তারপরও কিছু পণ্যে অস্থিরতা রয়েই গেছে। যেমন সয়াবিন তেল। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী অধিক মুনাফার লোভে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরির চেষ্টা করে থাকে। এবারও ভোজ্যতেলের বাজারে এটা চলছে। সরকার খুচরা বাজারে কিছু অভিযান চালাচ্ছে যা পর্যাপ্ত না, সরকারের উচিত মূল জায়গায় হাত দেওয়া।
টিএই/ইএ