- দেড়শ থেকে আড়াইশ টাকায় পচা খেজুর
- যত পচে ততই কমে দাম
- নেই হাইজেনিংয়ের বালাই
- তেল দিয়ে চকচকা করা হচ্ছে
- ফুড পয়জনিংসহ স্বাস্থ্য ঝুঁকি
দুর্দান্ত পুষ্টিগুণ ও ধর্মীয় গাম্ভীর্যের কারণেই খেজুরের কদর আকাশচুম্বী। খেজুর দিয়েই মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ইফতার করতেন। এ কারণে বিশ্বব্যাপী মুসলিম উম্মাহর কাছে খেজুরের কদর অন্য যেকোনো খাবারের শীর্ষে। বাংলাদেশে বছরব্যাপী উচ্চমূল্যের কারণে কেউ খেজুরের খোঁজ না নিলেও রমজানে নবীর সুন্নত পালনে তা রাখে ইফতার আয়োজনে। আর এই খেজুর খাওয়ার সুন্নত পালনে তাই কম দামের নষ্ট খেজুরেই ভরসা!
বিজ্ঞাপন
ট্যারিফ কমিশনের হিসেবে, রোজায় খেজুরের চাহিদা ৬০ হাজার টন। বন্দর দিয়ে এখন প্রতিদিন খেজুর খালাস হচ্ছে। আর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যমতে, গত ১ জানুয়ারি থেকে ২২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত খেজুর আমদানি হয়েছে প্রায় ৫০ হাজার টন। গত বছর একই সময়ে আমদানি হয়েছিল ১৯ হাজার ৬৮৮ টন। তাতে রোজা শুরুর আগে খেজুরের আমদানি চাহিদার চেয়ে বেশি বলছেন ব্যবসায়ীরা। যদিও ভোক্তা পর্যায়ে এসব হিসেবের ইতিবাচক প্রভাব দেখা যাচ্ছে না।
এদিকে, এসব তথ্যের জটিল সমীকরণ না খুঁজলেও বাজারের সস্তা খেজুর খোঁজার বাড়তি আগ্রহ রয়েছে নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষের। কম দামে ভালো খেজুর কিনতে চান তারা। তবে সবার আগে প্রাধান্য পাচ্ছে মূল্য। আর এখানেই বাঁধছে বিপত্তি। জীবনযাত্রার ব্যয় সামলিয়ে ভালো খেজুর পাতে উঠছে না নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষের। ১৫০ থেকে ২০০ টাকার মধ্যে কম দামি খেজুর কিনেই ইফতারে খেজুর খাওয়ার সুন্নত পালন করছেন তারা।
রাজধানী ঢাকার কারওয়ান বাজার, পল্টন ও গুলিস্তান ঘুরে দেখা যায়, বিভিন্ন প্রজাতি ও দামের খেজুরের পসরা সাজিয়ে বসেছেন দোকানিরা। দেড়শ থেকে আড়াই হাজার টাকার মধ্যে খেজুর পাওয়া যায় —এমন দোকানগুলোতে ক্রেতাদের ভিড় বেশি। যেখানে ক্রেতাদের দর কষাকষিতেই টের পাওয়া যাচ্ছে ইফতারির প্লেটে খেজুর তোলার তীব্র আকাঙ্ক্ষা ও পকেটের বাস্তবতা, যারা খেজুরের গুনগত মানে কম্প্রোমাইজ করলেও খরচের লাগাম বাড়াতে ব্যর্থ।
গুলিস্তানে ফুটপাতে বসে গলে যাওয়া খেজুর ঝরিয়ে ঝরিয়ে বিক্রি করছিলেন এক ব্যবসায়ী। সেখান থেকে কিছু ভালো খেজুর বেছে নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন গৃহিণী শাহিনা বেগম। ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, বাজারে সবচেয়ে কম দামের খেজুরটিও ১৮০ টাকা চাচ্ছে। এই ব্যবসায়ী কেজিতে ১০ টাকা কম রাখতে চাইলেন। এ কারণে দেখে দেখে একটু ভালোটা নেওয়ার চেষ্টা করছি। যদিও খেজুরগুলো একটু গলে গেছে, তবে দুর্গন্ধ নাই। খাওয়া যাবে। এর চেয়ে ভালো খেজুর আমাদের পক্ষে খাওয়া সম্ভব না।
পাশেই আরেক ভদ্রলোক খেজুর দেখছিলেন। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে ঢাকা মেইলকে বললেন, খেজুরের দাম কমেছে শুনলাম। মিডিয়া নিউজও করছে। অথচ মার্কেটে এসে কী দেখছি? আমরা গরিবরা পছন্দ করে ভালো খাবার কখনো খেতে পারব না, এটাই নিয়ম।
এই চিত্র শুধু রাজধানী ঢাকাতেই নয়, এসব গলা-চ্যাপ্টা খেজুর দেশের প্রান্তিক এলাকাগুলোতেও ব্যাপক চাহিদার সঙ্গেই বিক্রি হচ্ছে। আর এগুলোর ক্রেতা নিম্ন-মধ্যবিত্তরা।
বিভাগীয় শহর রাজশাহীর সাহেব বাজার এলাকায় দেখা যায়, এসব গলে যাওয়া খেজুরই ২০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। ক্রেতারাও তা কিনছেন।
রাজশাহীর বাসিন্দা সাদ্দাম আলী বলেন, পাঁচশ বা হাজার টাকা কেজি দরে খেজুর খাওয়ার সামর্থ্য আমাদের নেই। আমরা কম দামের মধ্যে একটু ভালোটা খোঁজার চেষ্টা করি। এবারও তাই করেছি। একসঙ্গে তিন কেজি খেজুর কিনলাম। এখান থেকে খুব খারাপ হয়তো এক-দেড়শ গ্রাম ফেলে দিতে হবে। বাকিটা ধুয়ে খাওয়া যাবে।
এখন প্রশ্ন হলো নিম্ন-মধ্যবিত্তের কেনা কম দামের এই খেজুর আদৌতে কতটা ভালো? এ প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে বাংলাদেশ ফলিত পুষ্টি গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের (বারটান) ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা প্রিন্স বিশ্বাস ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘কম দামের খেজুর, যেটা দূর থেকে তেঁতুলের মতো দেখা যায়। এটা খুবই লোয়ার গ্রেডের খেজুর। আমাদের অসৎ ব্যবসায়ীরা বস্তা ধরে কিনে নিয়ে এসে এটা ভাগ ভাগ করে প্যাকেট করে। এই খেজুরটা খাওয়া যাবে না। খাওয়া উচিত না। এটাতে বিভিন্ন ধরণের খারাপ ব্যাকটেরিয়া থাকতে পারে। এটাতে ফুড পয়জনিং হতে পারে।’
তার পরামর্শ খেজুর অবশ্যই শুকনা দেখে কিনতে হবে। প্যাকেজিং করা, সতেজ খেজুর খাওয়ায় উত্তম। সঙ্গে প্যাকেটের গায়ে মেয়াদটাও দেখে নিতে হবে। পাশাপাশি যত ভালো খেজুরই কেনেন না কেন, অবশ্যই তা ধুয়ে খেতে হবে।
এদিকে, দেশের আমদানি পলিসিতে ৭৯টি পণ্যের মধ্যে মোট ৩২টি খাদ্য পণ্যের ক্ষেত্রে ল্যাব টেস্ট করে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই)। তাদের ছাড়পত্র দেওয়া সাপেক্ষে দেশে প্রবেশের সুযোগ পায় পণ্যটি। সেখানে খেজুরের মান পরীক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই দেশে। এতে দেশে কোন কোয়ালিটির খেজুর আমদানি হচ্ছে, তার সঠিক কোন ডাটা নেই, নেই নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাও।
বিএসটিআইয়ের সার্টিফিকেশন মার্কস উইং উপপরিচালক (সিএম) মোহাম্মদ আরাফাত হোসেন সরকার ঢাকা মেইলকে বলেন, যেহেতু ৩২টি খাদ্যপণ্যের তালিকার মধ্যে খেজুর নেই, এ কারণে টেস্ট করা হয় না। সরকার এক্ষেত্রে পলিসি নিলে হয়তো তখন কাজ হবে।
অপরদিকে, বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষও এখন পর্যন্ত খেজুর নিয়ে কোনো টেস্টিং কার্যক্রম পরিচালনা করেনি।
বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত সচিব) জাকারিয়া বলেন, আমরা বাজার মনিটরিং করার সময় খারাপ খেজুর বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেই। এছাড়া কেউ অভিযোগ দিলেও ব্যবস্থা নেই। তবে ক্রেতা হিসেবে আমাদেরও সচেতন থাকা উচিত। আমরা এ বিষয়টি দেখব।
বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের উপ-প্রধান (বাণিজ্য নীতি) মো. মাহমুদুল হাসান ঢাকা মেইলকে বলেন, খেজুরের ক্ষেত্রে কোনো টেস্টিং সিস্টেম নেই। তবে কেউ যদি আবেদন করেন, তখন হয়তো এটা নিয়ে কাজ হতে পারে।
এমএইচটি