- সংস্থাটির বোর্ডসভায় তৃতীয় কিস্তি অনুমোদন
- মিলবে ১১১ কোটি ৫০ লাখ ডলার
- ১৩ বিলিয়নের ঘরেই ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ
করোনা মহামারির ভয়াবহ পরিস্থিতিতে দেশে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ ফুলে ফেঁপে উঠে, তৈরি হয় রেকর্ডের পর রেকর্ড। কিন্তু বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। ইতিহাসের রেকর্ড আমদানি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে সৃষ্ট বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে বিদেশি মুদ্রার সংকটের মধ্যে পড়ে দেশ। শ্রীলঙ্কার দুযোর্গপূর্ণ পরিস্থিতি থেকে শিক্ষা নিয়ে বড় ধরনের সংকটে পড়ার আগেই রিজার্ভ ক্ষয়রোধের প্রস্তুতি নেয় বাংলাদেশ। দ্বারস্থ হয় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ)। নানা শর্ত ও বিভিন্ন খাতের আমূল সংস্কারের বিনিময়ে কিস্তিতে ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ অনুমোদন দেয় আইএমএফ। তবে প্রায় দেড় বছর আগে থেকে ঋণ পাওয়া শুরু হলেও রিজার্ভ স্বস্তিদায়ক অবস্থানে ফেরাতে পারেনি বাংলাদেশ।
বিজ্ঞাপন
পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০২৩ সালের ৩০ জানুয়ারি বাংলাদেশের অনুকূলে ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ প্রস্তাবে অনুমোদন দেয় আইএমএফ। ঋণ অনুমোদনের তিন দিনের মাথায় ২ ফেব্রুয়ারি প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ডলার পায় বাংলাদেশ। প্রথম কিস্তি পাওয়ার পর দেশের রিজার্ভ দাঁড়ায় তিন হাজার ২৬৯ কোটি ডলার, যা আইএমএফের হিসাবপদ্ধতি বিপিএম ৬ অনুযায়ী ২৬ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার। পরবর্তী সময়ে ২০২৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ৬৮ কোটি ৯৮ লাখ ডলার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভে যুক্ত হয়। একই দিনে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) দেওয়া ৪০ কোটি ডলারও রিজার্ভে যুক্ত হয়। তবে পরের মাস ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে দেশের রিজার্ভ (বিপিএম ৬) দাঁড়ায় এক হাজার ৯৯৬ কোটি ডলারে। গত দেড় বছরে বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকেও ঋণ পেয়েছে বাংলাদেশ। এত ঋণ পাওয়ার পরও রিজার্ভ ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এমন পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের তৃতীয় কিস্তি পেতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। সব শর্ত পূরণ না হলেও গতকাল সোমবার (২৪ জুন) আইএমএফের সদর দফতর ওয়াশিংটনে সংস্থাটির নির্বাহী পরিষদের সভায় বাংলাদেশের ঋণের তৃতীয় কিস্তির বিষয়টি অনুমোদন হয়। এর ফলে ১১১ কোটি ৫০ লাখ ডলার পাবে বাংলাদেশ। তবে বর্তমান রিজার্ভের যে অবস্থা তাতে ঋণের তৃতীয় কিস্তির টাকা পেলেও তাতে স্বস্তি মিলবে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী, বর্তমানের ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ দিয়ে তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো কষ্টসাধ্য হয়ে উঠবে বাংলাদেশের জন্য।
বিজ্ঞাপন
বর্তমানে দেশের মোট রিজার্ভ ২৪ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার। বিপিএম ৬ হিসাবে ১৯ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন ডলার। সেখান থেকে চলতি দায় বাবদ ৫ দশমিক ২৪ বিলিয়ন বাদ দিলে ব্যয়যোগ্য রিজার্ভ দাঁড়ায় ১৩ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলার। যা আইএমএফের বেধে দেওয়া লক্ষ্য ১৪ দশমিক ৮০ বিলিয়ন থেকে প্রায় ১ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলার কম।
রিজার্ভ ব্যবস্থাপনায় জড়িত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, গত ৬ জুন পর্যন্ত রিজার্ভের তথ্য আইএমএফকে সরবরাহ করা হয়েছে। তাদের লক্ষ্যের তুলনায় দেড় বিলিয়ন ঘাটতি ছিল। এরমধ্যে বিশ্বব্যাংকের ৯০ কোটি ডলার এলে ঘাটতি কমে যাবে। আর চলতি জুনে মাত্র ৪০ মিলিয়ন ডলার বিক্রি করা হয়েছে। যদিও কারেন্সি সোয়াপের মাধ্যমে ব্যাংক থেকে ডলার কেনায় আইএমএফের আপত্তি আছে, তারপরও বাজার থেকে সরাসরি ডলার কেনা চলমান রয়েছে। সবমিলিয়ে রিজার্ভ ১৪ বিলিয়ন পার হবে। তৃতীয় কিস্তি বাবদ প্রায় ১ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার অনুমোদন ও অর্থছাড় হলে তা রিজার্ভে যুক্ত হবে। এতে কিছুটা রিজার্ভ বাড়বে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক বলেন, সোমবার আইএমএফের বোর্ড সভায় তৃতীয় কিস্তির ঋণের বিষয়টি অনুমোদন হয়েছে। আশা করছি দুই দিনের মধ্যে অর্থ ছাড় হবে। এই অর্থ পেলে রিজার্ভে প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন তিনি।
এর আগে ঋণের তৃতীয় কিস্তি নিয়ে আলোচনা করতে গত ২৩ এপ্রিল ঢাকায় আসে ১০ সদস্যের আইএমএফের প্রতিনিধি দল। ২৫ এপ্রিল বৈঠক হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাথে। বৈঠকে আর্থিক খাত সংস্কার, খেলাপি ঋণ, সুদের হার বাস্তবায়ন, মুদ্রানীতি, মূল্যস্ফীতি, বিদেশি বাণিজ্যের ভারসাম্য ও আউটলুক, মুদ্রা বাজার ও তারল্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে। এর মধ্যে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সংক্রোচনমূলক মুদ্রানীতির মাধ্যমে সুদের হার বৃদ্ধিসহ গৃহীত পদক্ষেপের তথ্য সংগ্রহ করে সংস্থাটি। একইসঙ্গে রিজার্ভ পরিস্থিতি, ডলারের বিদ্যমান রেট, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক লেনদেন বিষয়ে হালনাগাদ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ জানতে চায়।
এছাড়াও ব্যাংক খাতের সংস্কার, একীভূতকরণের পদক্ষেপ, রাজস্ব সংক্রান্ত পরামর্শের অগ্রগতি প্রতিবেদন নিয়েছে আইএমএফ। বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ অন্যান্য সংস্থার গৃহীত পদক্ষেপকে যথাযথ বলে জানিয়েছেন উন্নয়ন সহযোগীর সদস্যরা। আইএমএফ ৪৭০ কোটি টাকা ঋণ ছাড়ের শর্ত হিসাবে যেসব সংস্কার প্রস্তাব দেয় তার বেশিরভাগই বাস্তবায়ন হয়েছে। মূলত সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির মাধ্যমে স্মার্ট পদ্ধতিতে সুদের হার নির্ধারণ, রিজার্ভের লক্ষ্য পূরণ, বাজারভিত্তিক ডলারের রেট কারা আগে ক্রলিং পেগের মাধ্যমে ডলার লেনদেন, জিডিপির তুলনায় রাজস্ব আদায়ের অনুপাত বৃদ্ধি, ব্যাংক কাতের সংস্কারসহ একীভূতকরণ নীতিমালা এবং বৈদেশিক বাণিজ্যিক লেনদেনসহ সামষ্টিক অর্থনীতির রিভিউ সংক্রান্ত বিষয়াবলির ওপর আলোচনা হয়। ওই বৈঠকে বাংলাদেশে গৃহীত পদক্ষপে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করেন আইএমসএফের প্রতিনিধিরা।
গত বছরের ৩০ জানুয়ারি বাংলাদেশের অনুকূলে ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ প্রস্তাবে অনুমোদন দেয় আইএমএফের নির্বাহী পর্ষদ। সাত কিস্তিতে ছয় মাস পরপর প্রতি কিস্তি ছাড়ের শর্তে এ ঋণ পাওয়ার কথা রয়েছে। অর্থাৎ অনুমোদনের পর থেকে ৪২ মাসে সমুদয় কিস্তির অর্থ পাওয়া যাবে। ২০২৬ সালের ডিসেম্বরে ঋণের শেষ কিস্তি পাওয়ার কথা রয়েছে। শর্ত হলো- প্রতি কিস্তি ছাড়ের আগে ঋণের শর্ত বাস্তবায়নের অগ্রগতির বিষয়টি পর্যালোচনা করে ঋণ ছাড়ের সিদ্ধান্ত নেবে। ঋণের গড় সুদের হার ২ দশমিক ২ শতাংশ।
সাধারণত রেমিট্যান্স, রফতানি আয়, বিদেশি বিনিয়োগ, বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার ঋণ থেকে যে ডলার পাওয়া যায় তা দিয়ে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ তৈরি হয়। আবার আমদানি ব্যয়, ঋণের সুদ বা কিস্তি পরিশোধ, বিদেশি কর্মীদের বেতন-ভাতা, পর্যটক বা শিক্ষার্থীদের পড়াশোনাসহ বিভিন্ন খাতে যে ব্যয় হয়, তার মাধ্যমে বিদেশি মুদ্রা চলে যায়। এভাবে আয় ও ব্যয়ের পর যে ডলার থেকে যায় সেটাই রিজার্ভে যোগ হয়। আর বেশি খরচ হলে রিজার্ভ কমে যায়।
২০২২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি দেশের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ ছিল চার হাজার ৪৯৯ কোটি ডলার। আর ২০২১ সালের আগস্টে রিজার্ভ সর্বোচ্চ চার হাজার ৮০০ কোটি ডলার ছাড়িয়েছিল। তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকেই ধারাবাহিকভাবে কমতে শুরু করে রিজার্ভ।
দেশের চলমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে আইএমএফের ঋণ খুব বেশি স্বস্তি দেবে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান নুরুল আমিন ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘রিজার্ভে তো অবশ্যই কিছু যোগ হবে। এটা একটা পজিটিভ দিক। তবে সেটা খুব বেশি কিছু না। আমরা সবসময় যেটা বলার চেষ্টা করি, যতক্ষণ পর্যন্ত এক্সপোর্ট গ্রোথ ভালো না হবে এবং রেমিট্যান্সের আরও বেশি গ্রোথ না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমদানি ঠেকিয়ে রিজার্ভ বাড়ানোর চেষ্টা সফল হবে না। এটা খুবই স্বাভাবিক। এজন্য সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে আমাদের নিজস্ব শক্তি।’
বাংলাদেশ মিশনের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের মাসে এখন যে ব্যয় তার বিপরীতে দাতা সংস্থাগুলো যদি ঋণ দেয় রিজার্ভে সেটা খুব বেশি ভূমিকা রাখতে পারবে না। রিজার্ভের যে পতনের ধারা তা রোধ করতে হলে রফতানি আয় ও রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে হবে।’
টিএই/জেবি