সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

‘ক্রেতাশূন্য’ সোনার বাজারে ব্যবসায়ীদের মাথায় হাত

মুহা. তারিক আবেদীন ইমন
প্রকাশিত: ০৫ আগস্ট ২০২৩, ১০:০০ পিএম

শেয়ার করুন:

‘ক্রেতাশূন্য’ সোনার বাজারে ব্যবসায়ীদের মাথায় হাত

বিশ্ববাজারে হু হু করে কমছে সোনার দাম। তবে এর উল্টো চিত্র দেশের বাজারে। ইতিহাসের সর্বোচ্চ দামে বিক্রি হচ্ছে ধাতুটি। ইতোমধ্যে ভরিপ্রতি লাখ টাকা ছাড়িয়েছে স্বর্ণের দাম। ঊর্ধ্বমুখী এই দামের কারণে তা ক্রয়ক্ষমতার অনেকটা বাইরে চলে গেছে সাধারণ মানুষের। অন্যদিকে মার্কেটে ক্রেতা না থাকায় হতাশ ব্যবসায়ীরা। নামি-দামি কিছু ব্র্যান্ডের দোকানে কিছুটা বেচা-বিক্রি হলেও মাঝারি ও ছোট ব্যবসায়ীদের মাথায় হাত। ব্যবসা টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে গেছে অনেকের জন্য।

আরও পড়ুন: দেশের ইতিহাসে স্বর্ণের সর্বোচ্চ দাম


বিজ্ঞাপন


বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জুয়েলারি শিল্পের কথা মাথায় রেখে এবং সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার কথা চিন্তা করে এখনই কার্যকরী পদক্ষেপ না নিলে সাধারণ মানুষ যেমন শখ ও সৌখিনতা থেকে বঞ্চিত হবে তেমনি পথে বসতে পারে অসংখ্য ছোট ও মাঝারি জুয়েলারি ব্যবসায়ী।

দেশের প্রাচীন শিল্পের মধ্যে অন্যতম জুয়েলারি খাত। অলঙ্কারের প্রতি নারীর সহজাত আকর্ষণ প্রাচীনকাল থেকেই। বাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্য, সংস্কৃতির সঙ্গে স্বর্ণালঙ্কারের নানা বিষয় জড়িয়ে রয়েছে। প্রাচীনকাল থেকেই স্বর্ণের গহনা মানুষের কাছে মূল্যবান সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। এটা অনেকের আভিজাত্য ও মর্যাদার অংশ হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে। আমাদের সমাজে ধনী-গরিব সব শ্রেণির মানুষ কমবেশি তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী স্বর্ণের অলঙ্কার ব্যবহার করে। অনেকে ভবিষ্যতের জন্য সম্পদ হিসেবে যতটা সম্ভব স্বর্ণের গহনা নিজের কাছে রাখতে চান। এছাড়া জুয়েলারি শিল্পে ভ্যালু অ্যাড অর্থাৎ মূল্য সংযোজন অন্যান্য শিল্পের তুলনায় অনেকগুণ বেশি।

tt


বিজ্ঞাপন


গত ২০ জুলাই দেশের বাজারে প্রথমবারের মতো লাখ টাকা ছাড়ায় সোনার দাম। বর্তমানে সবচেয়ে ভালো মানের প্রতি ভরি সোনার দাম এক লাখ ৭৭৮ টাকা নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (বাজুস)। পাশাপাশি ২১ ক্যারেটের প্রতি ভরি স্বর্ণ ৯৬ হাজার ২২৮ টাকা, ১৮ ক্যারেটের প্রতি ভরি স্বর্ণ ৮২ হাজার ৪৬৪ টাকা এবং সনাতন পদ্ধতির প্রতি ভরি স্বর্ণ ৬৮ হাজার ৭০১ টাকা নির্ধারণ করা হয়। স্থানীয় বাজারে তেজাবী স্বর্ণের (পাকা সোনা) দাম বাড়ার পরিপ্রেক্ষিতে এই দাম নির্ধারণ করেছে স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের এই সংগঠনটি।

দেশের বাজারে এমন সময় স্বর্ণের দাম বেড়েছে যখন বিশ্ববাজারে কমেছে স্বর্ণের দাম। মার্কিন ডলার সম্প্রতি আরও শক্তিশালী হওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে কমেছে সোনার দাম। ডলার শক্তিশালী হওয়ায় বেড়েছে বন্ড বিক্রিও। এর ফলে অন্তত এক শতাংশ দাম কমেছে সোনার। চলতি সপ্তাহে মুদ্রানীতি ঘোষণা করবে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ (ফেড)। এই কারণে ব্যবসায়ীরা স্বর্ণে বিনিয়োগ কমিয়েছেন। এজন্যই মূলত কমে গেছে সোনার দাম।

আরও পড়ুন: জুয়েলারি শিল্প: বিলিয়ন ডলারের রফতানি আয়ের সম্ভাবনা

গত ১ আগস্ট স্পট মার্কেটে বৈশ্বিক বেঞ্চমার্ক স্বর্ণের দাম কমেছে ১ শতাংশ। প্রতি আউন্সের মূল্য স্থির হয়েছে ১৯৪৪ ডলার ০২১৭ সেন্ট। গত সপ্তাহে যা ছিল ১৯৫০ ডলারের ওপরে। একই কার্যদিবসে ফিউচার মার্কেটে ইউএস বেঞ্চমার্ক স্বর্ণের দাম নিম্নমুখী হয়েছে ১ দশমিক ৩ শতাংশ। আউন্সপ্রতি দর নিষ্পত্তি হয়েছে ১৯৮১ ডলার ৬ সেন্টে।

দেশের বাজারে স্বর্ণের দামের ঊর্ধ্বগতির কারণে এর চরম প্রভাব পড়েছে ক্রেতাদের মধ্যে। সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে সৌখিন এই পণ্যটি। সাধারণত দেশের মানুষ স্বর্ণ কেনার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন বোধ করে বিয়ের মৌসুমে বা বিয়ের অনুষ্ঠান উপলক্ষে। বিয়েতে কনেকে স্বর্ণ উপহার দেওয়া এদেশের অতি প্রাচীন ঐতিহ্য। রাজধানীর শাহবাগে ফুলের দোকানের সামনে ফুল দিয়ে বিয়ের গাড়ি সাজাচ্ছিলেন সাইফুল। কথা প্রসঙ্গে এক পর্যায়ে তিনি বলেন, ‘শুধু স্বর্ণের দাম বাড়তে থাকার কারণে আজ আমার বিয়ে তিন বছর পরে হচ্ছে। বুকে তিন ভরি স্বর্ণালঙ্কার উপহার দেওয়ার কথা ছিল। স্বর্ণের দাম কমবে কমবে এই আশায় ২০২০ সালে যে বিয়ে হওয়ার কথা তা ২০২৩ সালে এসে করতে হচ্ছে। যখন দেখছি স্বর্ণের দাম না কমে উল্টো বাড়ছে তখন আর অপেক্ষা করলাম না। শেষে লাখ টাকা ভরিতে স্বর্ণ কিনে বিয়ে করতে হচ্ছে।’

স্বর্ণের ঊর্ধ্বমুখী দামে শুধু ক্রেতারাই নয়, ব্যবসা ভালো চলছে না ব্যবসায়ীদেরও। বড় কিছু নামি-দামি ব্র্যান্ডের দোকান ছাড়া অধিকাংশ জুয়েলারি দোকান ক্রেতাশূন্য দেখা গেছে। গত বৃহস্পতিবার (৩ আগস্ট) রাজধানীর বৃহৎ জুয়েলারি মার্কেট বায়তুল মোকাররম মার্কেটে কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, তাদের ব্যবসার অবস্থা খুব খারাপ যাচ্ছে। মার্কেটের জনতা জুয়েলার্সের দোকানদার সুমন ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘দেখতেই তো পাচ্ছেন মার্কেটের অবস্থা। বেচাবিক্রি শুধু কম না। নাই বললেই চলে। আমাদের দোকানে আমরা তিনজন আছি। তিনজনই মোবাইলে ভিডিও দেখে সময় কাটাচ্ছি। মানুষের হাতে টাকা নাই। আমাদের তো ছোট দোকান। এই দোকানে সাধারণত মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত ধরনের ক্রেতা আসে। বড় বড় যেসব শোরুম আছে তাদের কিছু কাস্টমার আছে যারা ধনী। তাদের তাদের হাতে সবসময় টাকা থাকে। দুই লাখ টাকা ভরি হলেও তাদের কোনো সমস্যা নাই। ওই ব্র্যান্ডের দোকানগুলাতে যাচ্ছে।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জুয়েলারি শিল্পের কথা মাথায় রেখে এবং সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার কথা চিন্তা করে এখনই কার্যকরী পদক্ষেপ না নিলে সাধারণ মানুষ যেমন শখ ও সৌখিনতা থেকে বঞ্চিত হবে তেমনি পথে বসতে পারে অসংখ্য ছোট ও মাঝারি জুয়েলারি ব্যবসায়ী।

এই মার্কেটের আরেক দোকান দিপা জুয়েলার্সে দায়িত্বরত কর্মী বলেন, ‘বর্তমানে মার্কেটের অবস্থা খুবই খারাপ। বেচা-কেনা একেবারেই সীমিত। কয়েক বছর ধরেই এই অবস্থা। কয়েক বছরের ব্যবধানে আমাদের বেচা-কেনা প্রায় অর্ধেক কমেছে। কিন্তু ব্যায় ঠিকই বেড়েছে।’

স্বর্ণালি জুয়েলার্সের মালিক বলেন, ‘বেচাকেনা খুবই সীমিত। টুকটাক চলছে। সাধারণত বিয়ের সিজনে একটু বেচাকেনা হয়। তাছাড়া চলে কোনোরকম।’

TT1

কথা হয় এই মার্কেটে আসা কয়েকজন ক্রেতার সাথে। তাদের সবারই একটাই কথা দাম বেশি। সাইদ নামে একজন বলেন, ‘হঠাৎ করেই শ্যালকের বিয়ে। তাই কিছু তৈরি স্বর্ণের জিনিস কিনতে আসছি। কিন্তু যে দাম তাতে সাধ্যের অনেক বাইরে চলে যাচ্ছে। এখন আপাতত সামান্য কিছু দিয়ে বিয়েটা সারার চেষ্টা করছি।’

আরেক নারী ক্রেতা বলেন, ‘যে হারে দাম বেড়েছে, নতুন কেনার সামর্থ্য নাই। আমার পুরনো কিছু অর্নামেন্ট ছিল, সেগুলোই একচেঞ্জ করার জন্য এসেছি।’

আরও পড়ুন: দেশে রেকর্ড, বিশ্ববাজারে হু হু করে কমছে স্বর্ণের দাম

গেল তিন বছরের ব্যবধানে প্রতি ভরি সোনার দাম বেড়েছে ৩০ হাজার টাকা। প্রতি ভরি সোনার দাম এখন লাখ টাকা ছাড়িয়েছে, যা তিন বছর আগেও ছিল ৭০ হাজার টাকার কম। প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে তুলনা করলে বাংলাদেশের সোনার দাম অনেকটা লাগামছাড়া বেড়েছে। গত তিন বছরে বাংলাদেশে স্বর্ণের দাম বেড়েছে ৪৩ শতাংশ। অন্যদিকে ভারতে দাম বেড়েছে ১৫ শতাংশ। ভারতের গত তিন বছরে ভরিপ্রতি সোনার দাম প্রায় আট হাজার রুপি বাড়লেও বাংলাদেশে বেড়েছে প্রায় ৩০ হাজার টাকা। গতকাল শুক্রবার (৪ আগস্ট) প্রতিবেশী ভারতে ২২ ক্যারেটের মূল্য ছিল ৫৫ হাজার ৪০০ ভারতীয় টাকা আর ২৪ ক্যারেট ৬০ হাজার ৪৪০ টাকা। তিন বছর আগে ভারতের একই পরিমাণ ২২ ক্যারেট সোনার দাম ছিল ৪৮ হাজার ৯০৬ টাকা আর ২৪ ক্যারেট ছিল ৫২ হাজার ৫১৫ টাকা। আর তিন বছর আগে অর্থাৎ ২০২০ সালে বাংলাদেশের সোনার ভরি ছিল ৭০ হাজার টাকারও কম।

প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে তুলনা করলে বাংলাদেশের সোনার দাম অনেকটা লাগামছাড়া বেড়েছে। গত তিন বছরে বাংলাদেশে স্বর্ণের দাম বেড়েছে ৪৩ শতাংশ। অন্যদিকে ভারতে দাম বেড়েছে ১৫ শতাংশ। ভারতের গত তিন বছরে ভরিপ্রতি সোনার দাম প্রায় আট হাজার রুপি বাড়লেও বাংলাদেশে বেড়েছে প্রায় ৩০ হাজার টাকা।

বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাজুস) কেন্দ্রীয় কমিটির কোষাধ্যক্ষ উত্তম বণিক ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘বাজার বাড়লে তো কাস্টমারের ওপর একটা ইফেক্ট পড়ে। বাজার বাড়লে পরে আমাদের কমিয়ে রাখারও কোনো সুযোগ নেই। আমরা কখনোই চাই না মার্কেট প্রাইজটা হাই হোক।’

বাজুস নেতা বলেন, ‘মানুষ এখন বেশিরভাগ সময় একচেঞ্জ করছে। লোকাল মার্কেটে স্বর্ণের দাম এক লাখ টাকার উপরে চলে যাওয়া নতুন করে অনেকেরই তৈরি করার সাধ্য থাকে না। সবমিলেই আমাদের বেচাকেনা একটু কম হচ্ছে। ট্যাক্স বৃদ্ধিসহ নানা জটিলতার কারণে দেশের মার্কেটে স্বর্ণের দাম বাড়ছে। যার প্রভাব পড়ছে ক্রেতা-ব্যবসায়ীদের ওপর।’

টিএই/জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর