সোনার বাংলাদেশে স্বর্ণের মতোই উজ্বল সম্ভাবনাময় একটি খাত হচ্ছে জুয়েলারি শিল্প। দিন দিন বড় হচ্ছে এই খাত। বাড়ছে বিনিয়োগ ও পরিধি। বর্তমানে সারাদেশে ৪০ হাজারেরও বেশি ব্যবসায়ী এই শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত। প্রায় ৪৪ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান রয়েছে এই খাতে। কিছু প্রতিবন্ধকতার কারণে এখনও তেমন রফতানির সুযোগ সৃষ্টি না হলেও খুব শিগগিরই বড় সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশে বেসরকারিভাবে সোনা পরিশোধনাগার স্থাপন হয়েছে। দেশে প্রথমবারের মতো স্থাপন হচ্ছে বিশ্বমানের বিশেষায়িত জুয়েলারি পার্ক।
এই খাত সংশ্লিষ্ট ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিবন্ধকতাগুলো কাটিয়ে সম্ভাবনার দিকগুলোকে কাজে লাগাতে পারলে পোশাক খাতের মতো জুয়েলারি শিল্পও হবে দেশের বৃহৎ রফতানি আয়ের মাধ্যম। অনায়াসে বিলিয়ন ডলারের রফতানি আয়ের সম্ভাবনা তৈরি হবে। ২০২৬ সালের মধ্যে সরকার যে ১০০ বিলিয়ন ডলার রফতানি টার্গেট নিয়েছে, সে লক্ষ্য পূরণে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখতে পারে জুয়েলারি শিল্প।
বিজ্ঞাপন
দেশের প্রাচীন শিল্পের মধ্যে অন্যতম জুয়েলারি খাত। আদিকাল থেকে উপমহাদেশসহ প্রায় সারাবিশ্বেই জুয়েলারি ব্যবসা চলে আসছে। আমাদের দেশেও অলঙ্কারের প্রতি নারীর সহজাত আকর্ষণ প্রাচীনকাল থেকেই। বাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্য, সংস্কৃতির সঙ্গে স্বর্ণালঙ্কারের নানা বিষয় জড়িয়ে রয়েছে। প্রাচীনকাল থেকেই স্বর্ণের গহনা মানুষের কাছে মূল্যবান সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। এটা অনেকের আভিজাত্যের, মর্যাদার অংশ হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে। আমাদের সমাজে ধনী-গরিব সব শ্রেণির মানুষ কমবেশি তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী স্বর্ণের অলঙ্কার ব্যবহার করে। অনেকে ভবিষ্যতের জন্য সম্পদ হিসেবে যতটা সম্ভব স্বর্ণের গহনা নিজের কাছে রাখতে চান। সবচেয়ে বড় কথা হলো, স্বর্ণ অলঙ্কার মানে জুয়েলারি শিল্পে ভ্যালু অ্যাড অর্থাৎ মূল্য সংযোজন অন্যান্য শিল্পের তুলনায় অনেকগুণ বেশি। হাতে তৈরি স্বর্ণের গহনার প্রায় ৮০ শতাংশ বাংলাদেশ ও ভারতে প্রস্তুত হয়।

বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাজুস) দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সারা বিশ্বে ২০২১ সালে সব রকমের অলঙ্কারের বাজারের মোট আকার ছিল ২৪৯ দশমিক ০২ বিলিয়ন ডলার। যার ৪০ শতাংশই স্বর্ণালঙ্কার। ২০২২ সালে এ খাতে বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ২৬৯ দশমিক ১৯ বিলিয়ন ডলার। প্রতিবছর গড় ৮ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি ধরে ২০৩০ সালে সারা বিশ্বে অলঙ্কার শিল্পের মোট বাজার হবে ৫১৮ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলার। বিশ্ব বাজারের ৬০ শতাংশ অংশীদার এশিয়া প্যাসেফিক অঞ্চল। উৎপাদক ও রফতানির মধ্যে শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে বেলজিয়ামসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ও চীন এবং ভারত। আর আমদানির ক্ষেত্রে শীর্ষে আছে সুইজারল্যান্ড, চীন যুক্তরাজ্য, হংকং, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, আরব আমিরাত বেলজিয়াম, জার্মানি ও সিঙ্গাপুর।
সংগঠনটি বলছে, হাতে তৈরি অলঙ্কারের প্রায় ৮০ শতাংশ বাংলাদেশ ও ভারতে উৎপাদিত হয়। কিন্তু বিশ্ববাজারে অলঙ্কার রফতানিতে খুব বেশি ভূমিকা রাখতে পারছে না। চাহিদার প্রায় পুরোটাই রফতানি করছে ভারত। ২০২১-২২ অর্থবছরে অলঙ্কার রফতানিতে ভারতে আয় ছিল ৩৯ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে শুধু স্বর্ণ থেকে রফতানি আয় ছিল ৯ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার। ২০২০ সালে স্বর্ণ রফতানি করে বাংলাদেশ আয় করেছিল ২২ লাখ ২০ হাজার ডলার মাত্র। পুরোটাই রফতানি হয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাতে। ওই বছর স্বর্ণ রফতানির তালিকায় বাংলাদেশ ছিল ১৪৬তম দেশ। দেশের রফতানি পণ্য থেকে আয় করার মধ্যে স্বর্ণে আয় ছিল ১৮৫তম অবস্থানে। স্বর্ণ আমদানির দিক থেকে বাংলাদেশ ৩৩তম। ২০২০ সালে বাংলাদেশ ৩৯ কোটি ৭০ লাখ ডলারের স্বর্ণ আমদানি করে।
বিজ্ঞাপন
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে বেসরকারিভাবে এই প্রথম সোনা পরিশোধনাগার স্থাপন হয়েছে। বিশ্ব বাজারে আর কিছু দিন পর রফতানি হবে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ লেখা সোনার বার ও অলংকার।
বাজুস মনে করছে- আগামী দিনে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে জাগরণ তুলবে জুয়েলারি শিল্প। বর্তমানে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জুয়েলারি শিল্পে আনুমানিক ৪৪ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান রয়েছে। আগামীতে এই শিল্পে এক কোটি মানুষের কর্মসংস্থান সম্ভব। দুবাই যেমন সোনার ব্যবসার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে, তেমনি বাংলাদেশেও এই সম্ভাবনা রয়েছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাজুস) সহ-সভাপতি ও বিশিষ্ট জুয়েলারি ব্যবসায়ী ডা. দেওয়ান আমিনুল ইসলাম শাহীন ঢাকা মেইলকে বলেন, আমাদেরে রেভিনিউ বাড়াতে বা এটাকে ধরে রাখতে আমাদের উৎস বাড়াতে হবে। সে ক্ষেত্রে গোল্ড একটা বড় উৎস হতে পারে। আমরা মনে করি বিশ্ববাজারে যে ধরনের অলঙ্কারের চাহিদা রয়েছে বিশেষ করে ইন্ডিয়ান জুয়েলারি নামে যেসব স্বর্ণালঙ্কার বিক্রি হয় সেই মানের অলঙ্কার আমাদের বাংলাদেশের কারিগররাও ভালো তৈরি করতে পারে। এই জিনিসটা যখন আমরা আন্তর্জাতিক বাজারে সমতুল্য পর্যায়ে অলঙ্কারের প্রধান কাঁচামাল স্বর্ণ সংগ্রহ করতে পারব তখন আমরাও রফতানি করতে পারব। এখন দেখা যাচ্ছে আমি যে কাঁচামাল দিয়ে প্রোডাক্ট তৈরি করব সেটা যদি বিভিন্ন কারণে কেনা বেশি পড়ে যায় তখন উৎপাদন ব্যয় বেশি পড়ে যাবে। যার কারণে আমি বিশ্ব বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারব না।
তিনি আরও বলেন, যখন আমি নিজস্ব উৎস থেকে গোল্ড পাব, পিওর গোল্ড আকরিক হিসেবে যখন আসবে, এসে বাংলাদেশে রিফাইন হওয়ার পরে একটা বার তৈরি হবে। বারটা এক্সপোর্টও হবে এবং আবার আমাদের লোকাল মার্কেটেও ইউজ হবে। স্থানীয় মার্কেটে যে অলঙ্কার তৈরি হবে তখন আমাদের দেশে বিদেশিরা আসবে, আমরা মেলার আয়োজন করব, তারা দেখবে, অর্ডার দেবে, আগামী ৫-১০ বছরে এটার একটা ভালো রেজাল্ট আমরা পাব। আমার হিসেবে আমাদের দেশের ৪০ হাজারেরও বেশি জুয়েলার্স আছে। সবাই যদি গড়ে একভরি বা দুই-তিন ভরি হিসেবেও রফতানি করতে পারে তবেই তো একটা বিশাল অংক দাঁড়ায়।
বাজুসের আরেক কর্মকর্তা, কেন্দ্রীয় কমিটির কোষাধ্যক্ষ উত্তম বণিক ঢাকা মেইলকে বলেন, বাংলাদেশে জুয়েলারি শিল্প অনেক সম্ভবনাময় একটি খাত। আমাদের কিছু সমস্যা, কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। আমরা যদি আমাদের সব প্রতিবন্ধকতাগুলো কেটে উঠে সম্ভাবনার দিকগুলো কাজে লাগাতে পারি তবে খুব অনায়াসেই বছরে রফতানি আয় বিলিয়ন ডলার করা যাবে। এটা আরও অনেক বেশি হবে। তবে এক্ষেত্রে কিছুটা সময় লাগতে পারে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ইন্ডিয়া যেভাবে শুরু করেছে তাদের শুরু করার কিন্তু খুব বেশি দিন হয়নি। মাত্র ১০ বছর আগে তারা শুরু করেছে। এখন তাদের রফতানি আয় প্রায় ৪০ বিলিয়ন ডলার। আমরা যদি সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যেতে পারি তবে আমরাও একটা বড় রফতানি আয় অর্জন করতে পারব।
এদিকে ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের ২০২২ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী বিশ্ব বাজারে সোনার চাহিদা ছিল ৪ হাজার ৭৪০ টন। এরমধ্যে সোনার অলঙ্কারের চাহিদা ২ হাজার ১৮৯ দশমিক ৮ টন। বাংলাদেশে সোনার বার্ষিক চাহিদা প্রায় ৪০ টন। তবে প্রকৃত চাহিদা নিরূপণে সরকারের সমীক্ষা প্রয়োজন। বৈধভাবে সোনার চাহিদা পূরণ করার ক্ষেত্রে বড় বাধা কাঁচামালের উচ্চমূল্য, অতিরিক্ত উৎপাদন ব্যয়, শিল্প সংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতির উচ্চ আমদানি শুল্ক।
বর্তমানে জুয়েলারি শিল্পের প্রায় সকল ধরণের পণ্য ও যন্ত্রপাতির আমদানি শুল্ক ৩০ থেকে ৬০ শতাংশ। যা স্থানীয় অন্যান্য শিল্পে আরোপিত শুল্কের চেয়ে অনেক বেশি। এতে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। পাশাপাশি ৫ শতাংশ হারে উচ্চ ভ্যাট হার ও অতিরিক্ত উৎপাদন খরচের কারণে ভোক্তা পর্যায়ে আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে দামের পার্থক্য হচ্ছে। এতে ক্রেতা হারাচ্ছেন জুয়েলারি ব্যবসায়ীরা। আর সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ছোট ছোট জুয়েলারি ব্যবসায়ী।
এ বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, জুয়েলারি শিল্প বাংলাদেশের জন্য একটি সম্ভাবনাময় খাত। খনিপ্রধান দেশগুলো স্বর্ণ ব্যবসায় অগ্রসর হয়নি। যারা কাঁচামাল আমদানি করে স্বর্ণ রফতানি করেছে, তারা এগিয়েছে। রফতানি বাজারে আমাদের অংশগ্রহণ বাড়াতে হলে আমাদের আমদানিও বাড়াতে হবে। প্রতিবছর চার হাজার ৭০০ টনের মতো স্বর্ণ লেনদেন হয়ে থাকে। ১০টি বড় দেশের মধ্যে ছয়টিই এশিয়ার দেশ। এটিও আমাদের জন্য একটি বড় সম্ভাবনা। আমাদের দেশে স্বর্ণের বাজার কত বড়, সেটি আমাদের বের করতে হবে। এ জন্য বিনিয়োগকারীদের কাছে একটি বিশ্বাসযোগ্য তথ্য থাকতে হবে।
এছাড়াও বিদেশি বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান কিউওয়াই রিসার্চের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০ সালে বাংলাদেশে ২৮৫ কোটি ৪০ লাখ ডলার মূল্যের স্বর্ণালঙ্কার, স্বর্ণের বার ও রুপার অলঙ্কার বিক্রি হয়েছে। টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকা। ২০৩০ সাল পর্যন্ত এই বাজার প্রতিবছর গড়ে ১২ দশমিক ১ শতাংশ হারে বাড়বে। ফলে ওই সময় বাংলাদেশে স্বর্ণালংকার, স্বর্ণবার ও রুপা মিলিয়ে স্থানীয় বিক্রির পরিমাণ দাঁড়াবে ২ হাজার ১০৯ কোটি ৬০ লাখ মার্কিন ডলার। আর বাজুস সূত্র বলছে, চলতি বছর (২০২৩) আমদানি করা স্বর্ণের পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে তার আর্থিক বাজার মূল্য দাঁড়িয়েছে ৪৫ হাজার কোটি টাকা।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সহ-সভাপতি মো. আমিন হেলালী ঢাকা মেইলকে বলেন, বাংলাদেশের সবচেয়ে আদি ব্যবসার একটি হচ্ছে জুয়েলারি ব্যবসা। বাংলাদেশে অনেকগুলো খাত আছে তার মধ্যেই এটিই প্রাচিনতম ঐতিহ্য। সেই আদলেই বাংলাদেশে ব্যবসাটা পরিচালিত হয়ে আসছিল। আগে খুব বেশি মর্ডানাইজড হয়নি। সম্প্রতি আমরা যে ধাপে অর্থনৈতিকভাবে এগিয়েছি ঠিক একই ভাবে যারা এই খাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত উদ্যোক্তা শ্রেণি এবং সংগঠনকেন্দ্রিক যারা রয়েছে তারা একটি নেক্সট লেবেলে এই জুয়েলারি ব্যবসাটাকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে ‘র গোল্ড’ জুয়েলারি প্রসেস করার যে প্রক্রিয়া সেটা অলরেডি তৈরি হয়েছে। এটাকে এখন মূল স্টিমে নিয়ে যাওয়ার একটা প্রক্রিয়া আমরা দেখতে পাচ্ছি। এর মাধ্যমে ওয়ার্ল্ড ক্লাস বিজনেস এখান থেকে শুরু হবে। যেহেতু এটা আমাদেরে দেশের একটা আদি ব্যবসা, আমাদের এখানে কারিগর টেকনেশিয়ান সবই আছে, সে হিসেবে আমাদের এই ব্যবসা প্রসারের অন্যতম একটা সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে।
টিএই/এএস

