সত্তর বছর বয়সী মোখলেসুর রহমান। চাতাল ব্যবসা করেন। চার যুগ ধরে এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত তিনি। বগুড়া জেলা শহর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে শিবগঞ্জ উপজেলার পিরব ইউনিয়নের সিহালী গ্রামে তিনি গড়ে তুলেছেন একটি হরিণের খামার।
১৭ বছর আগে শখের বসে একজোড়া চিত্রা হরিণ কেনেন মোখলেসুর। ২০০৩ সালে ৩৩ হাজার টাকা দিয়ে রাজশাহী চিড়িয়াখানা থেকে তিনি এ হরিণ দুটো কেনেন। ওই সময় হরিণ লালন-পালনে সরকার কোনো ধরনের লাইসেন্স না দিলেও চিড়িয়াখানা থেকে একটা অনুমতিপত্র দেওয়া হয়। পরবর্তীতে সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরের অনুমতি সাপেক্ষে গড়ে তুলেন হরিণের খামার। বর্তমানে তার খামারে রয়েছে ১৭টি হরিণ।
সম্প্রতি খামারে গিয়ে দেখা যায়, ঘরের মধ্যে হরিণ ছোটাছুটি করছে। মোখলেসুর খাবার দিয়ে ডাক দিতেই হরিণগুলো দল বেধে বের হয়ে আসে। ক্যামেরা তাক করার সঙ্গে সঙ্গে তারা চারদিকে ছোটাছুটি করতে থাকে। আবার মুহূর্তেই স্থির হয়ে দাঁড়ায়। তাকিয়ে থাকে ক্যামেরার দিকে।
মোখলেসুর জানান, হরিণগুলো বছরে প্রায় এক লাখ টাকার খাবার খায়। কচি পাতা, কাঁঠাল পাতা, নরম ঘাস, অঙ্কুরিত চারা শৈবাল, নরম ফল খেতে দিতে হয়। আঁশযুক্ত খাবার এরা খায় না। এদের পাকস্থলি ছোট। রেইন হরিণ ছাড়া সকল পুরুষ হরিণের শিং আছে। হরিণ নিজে থেকেই পরিষ্কার থাকে, ওদের রোগবালাইও কম।
বিজ্ঞাপন
কথা হয় মোখলেসুর রহমানের ছেলে মতিয়ার রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, চাতাল ব্যবসার পাশাপাশি ১৭ বছর আগে শখের বসে তার বাবা হরিণের খামার গড়ে তোলেন। প্রথম যখন আনা হলো সারাক্ষণ মুখ গোমড়া করে থাকতো, ওদের ভাষায় কথা বলতো। আস্তে আস্তে ঘর আর বাগানকেই বন মনে করে মানিয়ে নিয়েছে তারা। খাবার দেওয়ার সময় হলে ওরা ছুটে আসে। বনের নিরীহ এই প্রাণীগুলো নিরিবিলি থাকতে পছন্দ করে। যেখানে-সেখানে মলমূত্র ত্যাগ করে না। এমনকি পরিষ্কার না হলে খাবারও খায় না।
মতিয়ার বলেন, ৭ মাস পর পর হরিণ একটি করে বাচ্চা প্রসব করে। বন বিভাগের অনুমতিতে গত ১৫ বছরে ২০-২৫টি হরিণ বিক্রি করেছেন তার বাবা।
তিনি জানালেন, যারা কেনেন তাদেরও লাইসেন্স থাকতে হয়। প্রথম দিকে প্রতি জোড়া হরিণ ২৫ হাজার টাকায় বিক্রি করা হয়। বর্তমানে প্রতি জোড়া ১ লাখ থেকে ১ লাখ ২০ হাজার টাকায় বিক্রি করছেন তারা।
মতিয়ার রহমান জানান, যেহেতু হরিণের মাংস কেনা-বেচা নিষেধ, তাই বাণিজ্যিক ভিত্তিতে হরিণের খামার গড়তেও দিচ্ছে না সরকার। তবে শখের বসে কেউ খামার করতে চাইলে বন্যপ্রাণি সংরক্ষণ অধিদফতর থেকে লাইসেন্স নিতে হয়। লাইসেন্স ফি ১০ হাজার টাকা। এছাড়া প্রতি বছর ১০ হাজার টাকা ও প্রতিটি হরিণ বাবদ ১০০০ টাকা করে ফি জমা দিয়ে লাইসেন্স নবায়ন করতে হয়। নবায়ন ফি আরও কমানোর দাবি জানান তিনি।
>> আরও পড়ুন : শাহ আলমের বেত পণ্য দেশ ছাড়িয়ে পৌঁছে যাচ্ছে বিদেশেও
খামারের কর্মীরা জানান, জন্মের পর বাচ্চার গায়ে হাত দিলে হরিণ আর ওই বাচ্চাকে সহজে দুধ দেয় না। হরিণ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে পছন্দ করে। খামার পরিষ্কার রাখা হয় সবসময়। নারী ও পুরুষ হরিণের মধ্যে খুব ভাব। ভাবের আগে ডাকাডাকি আর লাফালাফিই ওদের প্রেমের আমন্ত্রণ। এই খামারের সব হরিণই চিত্রা হরিণ।
সিহালী এলাকার রহিম মিয়া জানান, প্রতিদিনই জেলার বিভিন্ন জায়গা থেকে লোকজন হরিণ দেখতে আসে। হরিণ পালনে সরকারি লাইসেন্স করতে হয়, খরচও অনেক। এ কারণে ইচ্ছে থাকলেও সহজে কেউ হরিণ পালন করতে পারে না।
খামারের মালিক মোখলেছুর রহমান জানান, প্রায় ২২ শতক জায়গার ওপর খামারটি গড়ে তুলেছেন। প্রথমে ছিল ১২ শতকের উপরে খামারটি। ধীরে ধীরে বাড়িয়েছেন খামারের জায়গা। তবে বন্য অধিদফতর আরও জায়গা বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন।
তিনি আরও জানান, হরিণ পালনের নিয়ম আরও সহজ করা দরকার। ফি, লাইসেন্স ও নবায়ন ফি কমালে দেশে অনেক হরিণ খামার গড়ে উঠবে। যুবকরাও হরিণ পালনে আগ্রহী হয়ে উঠবে। সরকারি সহযোগিতা পেলে তিনি আরও বৃহৎ পরিসরে হরিণের খামার গড়বেন বলে জানান।
বগুড়া জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা জানান, চিত্রা হরিণের খামারে সহযোগিতা করা হয়। যারা হরিণ পালন করছেন তাদের এই ভালোবাসায় খাদ আছে কিনা তাও একটা প্রশ্ন। কারণ তারা হরিণ পালন করে বেশি দামে বিক্রি করে দেন। তবে, সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে লাইসেন্স নিয়ে যে কেউ বৈধভাবে হরিণ খামার গড়ে তুলতে পারে।
প্রতিনিধি/এইচই