সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

পাহাড়ে জুমের ধান কাটা শুরু

সুফল চাকমা
প্রকাশিত: ০১ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০১:০১ পিএম

শেয়ার করুন:

পাহাড়ে জুমের ধান কাটা শুরু
ছবি : ঢাকা মেইল

সবুজ পাহাড়ে জুমের থেকে ধান কাটা শুরু হয়েছে। পাহাড়ে পাহাড়ে চলছে এই উৎসব। দল বেঁধে সুউচ্চ পাহাড়ে খুব ভোর থেকে ধান কাটেন তারা। কেউ ধান কাটা শুরু করেছেন, কেউ ধান কাটার আগে ফসল সংগ্রহ করা শুরু করেছেন, আর কেউ জুমের ধান পাকার অপেক্ষায় রয়েছেন। 

মারমা ভাষায় এই ধানের নাম মংথং। ঢালু পাহাড়ে এই ধানের চাষ খুব ভালো হয়। সবুজ পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে জুমের পাকা সোনালী রঙের ধান দোল খায় জুমিয়াদের। পাহাড়ের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী জুমিয়ারা ঐতিহ্যগতভাবে জুমচাষে নির্ভর করে জীবনধারণ। ধান, ভূট্টা, তিল, মিষ্টি কুমড়া, চিনার, মারফাসহ বিচিত্র রকমের ফসল ফলায়। 
 
তবে এবার বছর অনাবৃষ্টি ও বাতাসের তীব্রতার কারণে জুম ধান এখন হাসি ফোটাচ্ছে না জুমচাষিদের মুখে। কাঙ্খিত ধান না পাওয়ার আশঙ্কা করছেন তারা। 


বিজ্ঞাপন


>> আরও পড়ুন : ম্রোদের ভাষা-সংস্কৃতি সংরক্ষণে বান্দরবানের পাহাড়ে ‘গল্প শোনার ঘর’

বান্দরবান কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, বান্দরবান জেলার ৭টি উপজেলায় চলতি বছরে ৮৭৫৫ হেক্টর জায়গায় জুম চাষ করা হয়েছে। ২০১৯ সালে জুম চাষ হয়েছিল ৮৮৯৫ হেক্টর জমিতে প্রতি হেক্টরে চাউল উৎপাদন হয়েছিল ১ দশমিক ৫৭ মেট্রিকটন, ২০২০ সালে জুম আবাদ হয়েছিল ৯০২০ হেক্টর জমিতে আর চাউল উৎপাদন প্রতি হেক্টরে ১ দশমিক ৬৩ মেট্রিকটন ও ২০২১ সালে ৮৩৭৮ হেক্টর জায়গায় জুম আবাদ করা জুমে চাউল উৎপাদন হয়েছিল প্রতি হেক্টরে ১ দশমিক ৬১ মেট্রিকটন। 

পার্বত্য এলাকায় ১১টি বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর বসবাস, তাদের জীবনাচারও ভিন্ন ভিন্ন। চাষাবাদ পদ্ধতিও ভিন্ন। 

jum


বিজ্ঞাপন


সচরাচর দেখা যায়, সমতলে হালের বলদ নিয়ে বা আধুনিক যন্ত্র দিয়ে জমিতে চাষ করা হয়। কিন্তু পাহাড়ি এলাকায় বসবাসকারী জনগোষ্ঠী পাহাড়ের ঢালু জায়গায় এক ধরনের চাষাবাদ করে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। সম্পূর্ণ প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে পার্বত্য অঞ্চলে বন জঙ্গল কেটে রোদে শুকানোর পর আগুনে পুড়িয়ে উঁচু উঁচু পাহাড়ের ঢালু ভূমিতে ধানসহ বিভিন্ন সাথী ফসল উৎপাদনের পদ্ধতিকে জুম চাষ বলা হয়। 

জেলা শহর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে চিম্বুক পাহাড়। সেই পাহাড়ের পাদদেশে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, যামিনী পাড়ার বাসিন্দা ৪৭ বছর বয়সী পালে ম্রো এ বছর ৪ আড়ি ধানের জুম চাষ করেছেন। পরিবারের ৩ জন সদস্য নিয়ে তিনি ধান কাটছেন। 

শ্রমিক কেন নেন নাই, এ প্রশ্ন করা হলে পালে ম্রো বলেন, এ বছর ধান ভালো হয়নি। তাই শ্রমিক নিয়ে ধান কাটলে পোষাবে না। সেজন্য স্ত্রী ও ছেলেকে নিয়ে ধান কাটা শুরু করেছেন। ৪ আড়ি (১ আড়ি সমান ১০ কেজি) ধান চাষ করেছেন। মাত্র ১ শ আড়ি ধান পাওয়ার আশা করছেন, অথচ গত বছর এই ৪ আড়ি জুমে ধান চাষ করে ২ শ আড়ি ধান পেয়েছিলেন। এ বছর অনাবৃষ্টি ও বাতাস বেশি হওয়ার কারণে ধানে চিতা বেশি। 

জুমে ভালো ফলন হয়নি বলে জানান এ জুমচাষি। 

jum

জুমের ধান কাটতে কাটতে বলেন, জুম থেকে যা ধান পাবো, পরিবারে ৭ জন সদস্য নিয়ে বছর পার করা যাবে না। জুমে পাওয়া ধান নিয়ে বড়জোর ৬ মাস পর্যন্ত খেতে পারবো। এর বেশি চলা যাবে না। এ বছর খাদ্য সংকট দেখা দেবে বলে জানান তিনি। তার জন্য সাথী ফসল (তিল, কুমড়া, মিষ্টি কুমড়া, বেগুন, কাকন, চিনাল, মারফা) বিক্রি করে ধানের ক্ষতি পুষিয়ে তোলার চেষ্টা করছেন বলে জানান।

টংকাবতী ইউনিয়ন রামরি পাড়ার আরেক জুমচাষি তংরুই ম্রো (৪৫) ২ আড়ি ধান জুম চাষ করেছেন। এখনও ভালোভাবে পাকে নি। আরও ২০-২৫ দিন পর কাটবেন বলে জানান। 

তিনিও বলেন, এ বছর বৃষ্টি কম ও সময়মতো না হওয়ার কারণে জুমের ধান ভালো হয়নি। 

তংরুই ম্রো যোগ করেন বৃষ্টি কম, আবার বাতাস বেশি হওয়ার কারণে ধানে চিতা বেশি। তাই এ বছর জুমিয়াদের মুখে মলিন হাসি, প্রাণবন্ত হাসি নেই। 

জুম চাষে মিথ

জুমের জায়গা নির্ধারণ নিয়ে পাহাড়িদের মধ্যে বিভিন্ন মিথ প্রচলিত রয়েছে। যেমন যে জুমচাষি একটা পাহাড় বা জায়গা ঠিক করলেন। তিনি সেই জায়গা থেকে এক মুঠো মাটি নিয়ে আসবেন। তারপর শুদ্ধ মনে সেই একমুঠো মাটি বালিশের নিচে রেখে নিয়ত করে ঘুমাবেন। অর্থাৎ রাতে যেন জুমের জায়গাটা সম্পর্কে ভালোমন্দ স্বপ্নে প্রাপ্ত হন। 

এই জুমের জায়গা নির্ধারণ সম্পর্কে থোয়াইঙ্গ্যা পাড়া নিবাসী ৮০ বছর বয়সী মংমে মার্মা  জানান, ভালো স্বপ্ন যেমন বড় মাছ পাওয়া, পাহাড় উঠার স্বপ্ন, সাঁতার কেটে নদী পার হওয়া, গলায় স্বর্ণালঙ্কার পরিহিত অবস্থায়, স্বপ্নে কচ্ছপ পাওয়া দেখলে ভালো বলে ধরে নেওয়া হয়। আর খারাপ স্বপ্ন হলো আগুন দেখলে, সাপ, ভুতপ্রেত, বাঘ, হিংস্র প্রাণী স্বপ্ন দেখলে খারাপ বলে বিবেচিত হয়। জুমচাষি ভালো স্বপ্ন দেখলে ভালো দিনক্ষণ নির্ধারণ করে জঙ্গল কাটা শুরু করেন। আর খারাপ স্বপ্ন দেখলে নতুন জায়গা খুঁজে নেন। 

জুমচাষে প্রস্তুতি ও ধানকাটার সময় 

নভেম্বর-ডিসেম্বরে জুমের জায়গা নির্ধারণ, জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে জুমের জঙ্গল কাটা, মার্চ-এপ্রিল মাসে কাটা জঙ্গল-ঝাড়ে আগুন দেওয়া, এপ্রিল মাস জুড়ে চলে জুমের জায়গা সম্পূর্ণ প্রস্তুত করা আর কাঙ্খিত বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা, বৃষ্টি হলে জুমে ধানসহ সাথী ফসল বপন শুরু করা হয়। যারা বৈশাখ মাসের প্রথম বৃষ্টির পর জুমে ধান বপন করতে পারেন তাদের ধান আগে পাকা শুরু করে। আর যারা একটু দেরিতে বপন করেন, তাদের ধান দেরিতেই পাকে। প্রতিবছর আগস্ট মাসের শেষের দিকে জুমের ধান কাটা শুরু হয়। সেপ্টেম্বর-অক্টোবর পর্যন্ত জুমের ধানকাটা, মাড়াই ও শুকানোর প্রক্রিয়া চলে। 

>> আরও পড়ুন : বান্দরবানে চার বছরেও সম্পন্ন হয়নি ২০ কি.মি. সড়কের কাজ

ধান শুকানো শেষে জুমঘর থেকে মূল ঘরে ধান স্থানান্তর করার পর ফেব্রুয়ারি-মার্চে চলে জুমের নবান্ন উৎসব।
এক জায়গায় প্রতিবছর জুম চাষ করা যায় না, এক বছর একবার জুম চাষ করার পর কমপক্ষে ৩ বছর থেকে ৫ বছর পর্যন্ত জায়গা ফেলে রাখতে হয় মাটি উর্বর হওয়ার জন্য। 

jum

সাধারণত সমতলে প্রথমে বীজতলা তৈরি করতে হয়। কিন্তু জুম চাষে সরাসরি ধান বপন করা হয়। আবার ধানের সাথে মিশ্র করে তুলা বীজ, ঠাণ্ডা আলু বীজ, যব বীজ, মিষ্টি কুমড়ার বীজ, ভূট্টার বীজ, মারফা (শসা জাতীয় ফল), চিনাল (বাঙ্গী জাতীয় ফল) বীজগুলো, আমিলাগুলো বীজ (রোজেলা) ধানের সাথে বপন করা হয়। ধান বপন করার আগে মরিচ, তিল, বেগুন, সাবারাং (মসলা জাতীয় শাক) ধনিয়া পাতার বীজ, কাকন বীজ জুমের জায়গায় ছিটিয়ে দেওয়া হয়। 

জুমে ৩৫-৪০ প্রকার সাথী ফসল করা হয়। 

জুম একটা পুরো বাজারের মতো, শুধু বাজার থেকে লবণ আর চিদোল (শুটকি জাতীয়) কিনলে একজন জুমিয়ার আর কিছুই কিনতে হয় না।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের বক্তব্য

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, গত বছর জুলাই-আগস্ট মাসে বান্দরবানে বৃষ্টিপাত হয়েছিল ৩২৫মিলিমিটার চলতি বছর মাত্র ৫০ মিলিমিটার। এ বছর বৃষ্টিপাত কম হওয়ার কারণে জুমের ঢালু জায়গায় জুম ভালো হয়নি। তবে সাথী ফসল ভালো হয়েছে। 

তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, জুমের ধান এখনও যেগুলো পাকেনি। সামনে বৃষ্টি হলে শেষের ধানের ভালো ফলন হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

প্রতিনিধি/এইচই

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর