রোববার, ১৯ মে, ২০২৪, ঢাকা

কুমিল্লার পথে পথে নজরুল-নার্গিস-প্রমীলার উপাখ্যান

সাকলাইন যোবায়ের
প্রকাশিত: ২৭ আগস্ট ২০২২, ০৯:১৯ এএম

শেয়ার করুন:

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর একটি গানে লিখেছেন, ‘ঘুমিয়ে আছে শ্রান্ত হয়ে আমার গানের বুলবুলি।’ বাংলার গানের বুলবুলি জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামও ঘুমিয়ে আছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদের পাশে। কবির জীবনের বিরাট এক অধ্যায়ের সাথে জড়িত কুমিল্লা। কুমিল্লার মাটি, মানুষ, নদী, প্রেম, ভালবাসা, বিবাহ, বিরহ, বিচ্ছেদ, বিদ্রোহ এবং সাহিত্যকর্মের অনেক সৃষ্টি। এক কথায় কবির জীবনের অনেক ঘটনার স্বাক্ষী কুমিল্লা।

কাজী নজরুল প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ১৯১৭ সালে নজরুল যুদ্ধে গিয়েছিলেন। তিনি সেখানে ব্যাটালিয়ন কোয়ার্টার মাস্টার ছিলেন। তখন কুমিল্লার বাসিন্দা ক্যাপ্টেন আলী আকবর খাঁর সঙ্গে তার পরিচয় হয়। ১৯১৯ সালে যুদ্ধ শেষ হয়ে যায়। সে সময় আলী আকবর খানের সঙ্গে নজরুলের সখ্য গড়ে ওঠে। তিনি কাজী নজরুলের প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে তাকে কুমিল্লায় তার গ্রামের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানান। ১৯২১ সালের ৩ এপ্রিল নজরুল কলকাতা থেকে চট্টগ্রাম মেইলে করে আলী আকবর খাঁ’র সাথে রাতে কুমিল্লায় আসেন। ফলে কুমিল্লার সাথে সূচিত হয় নজরুলের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের। ওই রাতে নজরুল কুমিল্লা শহরের কান্দিরপাড়ে তার সহপাঠী বন্ধু ইন্দ্র কুমার সেনের ছেলে বীরেন্দ্র কুমার সেনের বাড়িতে ওঠেন। এখানে বীরেন্দ্রের মা বিজয়া সুন্দরী দেবীকে সাম্যের কবি কাজী নজরুল মা বলে সম্বোধন করতেন। কাজী নজরুল মোট ৫ বার কুমিল্লায় এসেছেন। কুমিল্লায় অতিবাহিত করেছিলেন কবি তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ মুর্হূতগুলো।
nargis homeকুমিল্লায় নজরুলের জীবনের প্রথম প্রেয়সী ছিলেন দৌলতপুরের নার্গিস। কথিত রয়েছে যে, তার হাতেই নজরুলের প্রেমের হাতেখড়ি। কুমিল্লায় এসে কান্দিরপাড় এলাকায় বীরেন্দ্র কুমার সেনের বাড়িতে দু’দিন বেড়ানোর পর ৬ এপ্রিল আলী আকবর খাঁ নজরুলকে নিয়ে মুরাদনগরের বাঙ্গরা ইউনিয়নের দৌলতপুরে নিজ বাড়িতে যান। বর্তমানে যেখানে আলী আকবর মেমোরিয়াল ট্রাস্টের বিল্ডিংটি অবস্থিত। এখানে আরেকটি ঘর ছিল, এ ঘরেই নজরুলকে থাকতে দেয়া হয়। এ ঘরটি ৪৫ হাত দৈর্ঘ্য ও ১৫ হাত প্রস্থ ছিল। বাঁশের তৈরি আটচালা ঘরটির একেবারে পূর্ব পাশে নজরুল থাকতেন। এই বাড়িতে থাকার সুবাদে আলী আকবর খাঁর ভাগ্নি পাশের বাড়ীর সৈয়দা নার্গিস আশার খানম এর সাথে নজরুলের পরিচয় হয় এবং দু’জনে প্রেমে মগ্ন হন। 


বিজ্ঞাপন


দৌলতপুরের এই বাড়িতে দুটি বড় আম গাছ নজরুলের স্মৃতির সঙ্গে জড়িত। নজরুল একটি আমগাছের তলায় দুপুরে শীতল পার্টিতে বসে তিনি কবিতা ও গান রচনা করতেন। এই আমগাছের পাশেই ছিল কামরাঙ্গা, কামিনী, কাঠাঁল গাছের সারি। এখানে কবি নজরুল খাঁ বাড়ির ও গ্রামের ছেলে মেয়েদেরকে নাচ, গান, বাদ্য শেখাতেন। পুকুরের দক্ষিণপাড়ে অবস্থিত আম গাছটির নিচে বসে নজরুল বাঁশি বাজাতেন। যদিও সে গাছটি আর নেই। কয়েক বছর আগে গাছটি মারা গেছে। গাছের গোড়াটি পাকা করে রাখা হয়েছে। আম গাছের সামনে রয়েছে একটি শান বাঁধানো ঘাট। এই আমগাছের পাশ্বর্বতী পুকুরেই নজরুল ঘণ্টার পর ঘণ্টা সাঁতার কাটতেন। একবার পুকুরে নামলে উঠবার নামও করতেন না। নজরুল সাবানের পর সাবান মেখে পুকুরের পানি সাদা করে ছোট মনিদের নিয়ে লাই খেলতেন, ডুব দিয়ে তাদেরকে কলের গান শোনাতেন। পুকুরের পশ্চিমপাড়ে একটি আম গাছ আছে। এ আম গাছের তলায় এসে কবির মা (কবি আলী আকবর খাঁ’র নিঃসন্তান বোন ইফতেখারুন্নেছাকে মা ডাকতেন) খাবার নিয়ে এসে ডাকতেন ‘আয় নুরু, খেতে আয়!’ তখন কবি ভদ্র ছেলের মত গোসল সেরে বাড়িতে এসে ভাত খেতেন। কবি শখ করে জাল কিংবা পলো দিয়ে পুকুরে মাছ ধরতেন।
basor nazrulকবি আমতলায় রাত দুপুরে মন ভোলানো উদাস সুরে বাশিঁ বাজাতেন। পাপড়ি খোলা কবিতাটি এই গাছতলায় রচনা করেন।

জানা যায়, কবি থাকাকালে খাঁ বাড়িতে ১২টি কামরাঙ্গার গাছ ছিল, এখন আছে ২টি। কবির শয়নকক্ষের সংলগ্ন ছিল একটি প্রাচীন কামরাঙ্গা গাছ যা তার অনেক কবিতা গানে, হাসি-কান্না, মান অভিমান এবং মিলন বিরহের নীরব স্বাক্ষী। কবি মাঝে মধ্যে, বিশেষ করে দুপুরে এই গাছটির শীতল ছায়ায় বসে আপন মনে গান গাইতেন, গান রচনা করতেন। একটি কামরাঙ্গা গাছে একটি ফলক লাগানো রয়েছে। কবি এ গাছকে নিয়েই লিখেছেন- ‘কামরাঙ্গা রঙ্গ লোকের পীড়ন থাকে , ঐ সুখের স্মরণ চিবুক তোমার বুকের, তোমার মান জামরুলের রস ফেটে পড়ে, হায় কে দেবে দাম।’
pukrকবি এবং আলী আকবর খাঁ যখন বিকেল বেলায় একসঙ্গে গাছের ছায়ায় বসে শীতল পাটি বিছিয়ে কবিতা ও গান রচনা করতেন, রূপসী নার্গিস তখন নানা কাজের ছলে ছুটে আসতেন এই গাছের নীচে। কবি ও কবি প্রিয়ার চোখের ভাষায় ভাবময় করে তুলতেন তাদের হৃদয় লোকের কামরাঙ্গা গাছটিকে। কবির বুকের স্বপ্নগুলো এখানে লেখা এবং উত্তরকালের নার্গিস নজরুলের অনেক অবিনাশী কবিতা শুনে এই গাছটি কাব্য সুষমা পেয়েছেন। খাঁ বাড়ির পাশেই মুন্সী বাড়ি। নার্গিস এ বাড়ির আবদুল খালেক মুন্সীর মেয়ে। বাল্যকালে নার্গিসের বাবা-মা মারা গেছেন। নার্গিস অধিকাংশ সময় মামার বাড়িতে থাকতেন। সেখানে নজরুলের কবিতায় আটি গাঙ্গের কথা এসেছে। এটি দৌলতপুরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে। বুড়ি নদী একটি, তবে কবি নজরুলের সেই আটি এখন খালে পরিণত হয়েছে। আটি নদীতে তিনি সাঁতার কেটেছেন। গোমতীতে নিয়মিত সাঁতার কাটার কোনো সংবাদ পাওয়া না গেলেও গোমতীকে তিনি খুব কাছ থেকে দেখেছেন। তাই তো তার কবিতায় এসেছে –
‘আজো মধুর বাঁশরী বাজে, গোমতীর তীরে পাতার কুটিরে, আজো সে পথ চাহে সাঁঝে।’

দৌলতপুর থাকাকালে নজরুল যেসব গান আর কবিতা লিখেছেন, এসব গান ও কবিতার বিষয়জুড়ে ছিল শুধুই নার্গিস। 

সরেজমিনে কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার নার্গিস এর বাড়িতে গেলে কথা হয় তাঁর উত্তরসূরি বাবলু আলি খান এর সঙ্গে। তিনি ঢাকা মেইলকে জানান, নার্গিস এঁর সঙ্গে নজরুল ইসলাম ভালবাসা দিয়েই তিনি প্রেমিক হয়ে ওঠেন। নার্গিস ও নজরুল ইসলামের স্মৃতি ধরে রাখতে হলে এখানে সরকারি ভাবে বেশ কিছু উদ্যোগ নিতে হবে। নাহলে এক সময় এগুলো হারিয়ে যাবে। তার দাবি, এখানে একটি যাদুঘর স্থাপন করা হোক এবং কবি নজরুল ও নার্গিসের। যাতে করে নজরুল ইসলামের যে ভাল সময় দৌলতপুরে কাটিয়েছেন তা মানুষ জানতে পারবে। 

১৮ জুন ১৯২১ (বাংলা ১৩২৮ সালের ৩রা আষাঢ়) নজরুল-নার্গিসের বিবাহ সম্পন্ন হয়। জানা গেছে, যেই ঘরে কবি নজরুল নার্গিসের বাসর সম্পন্ন হয় সেটি ১৯৬২ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত আটচালা ছিল । বর্তমানে চারদিকে বেড়ার আর টিনের ছাউনিতে রুপান্তরিত হলেও আয়তনে কোনো পরিবর্তন হয়নি। নজরুল ও নার্গিসের বাসর ব্যবহৃত খাট, পালঙ্ক, বিছানা, ২টি বালিশ, কম্বল ও কাঠের সিন্ধুকটি এখনও সংরক্ষিত রয়েছে।
monchজানা যায় বাসর রাতে কবি নার্গিসকে একটি কবিতা উপহার দেন। তিনি লিখেছিলেন,
“ব্যর্থ মোদের গৌধূলী-লগন এই সেই জনমে নহে,
বাসর শয়নে হারায়ে তোমায় পেয়েছি চির বিরহের।
কত সে লোকের কত নদী
পারায়ে চলেছি মোর নিরবধি।
মোদের মাঝারে শত জনমে শত সে জলধি বহে,
বারে-বারে ডুবি, বারে-বারে উঠি জন্ম মৃত্যু দহে।”

কিন্তু বিয়ের রাতেই বাসর ঘর থেকে নজরুল বের হয়ে যান নার্গিসকে একা ফেলে এবং ওই রাতেই নজরুল অঝোর বৃষ্টি উপেক্ষা করে ১১ মাইল পথ পায়ে হেঁটে মুরাদনগরের দৌলতপুর ত্যাগ করে কুমিল্লা শহরের কান্দিরপাড় নজরুল এভিনিউ রোডের বাড়িতে আসেন। এরপর তিনি কখনো দৌলতপুরে ফিরে যাননি। দৌলতপুর ত্যাগ করার সময় নজরুল লিখে গেছেন— ‘‘আমি চিরতরে দূরে চলে যাবো তবু আমারে দেব না ভুলিতে”। 

সত্যিই নজরুল আর কখনো দৌলতপুরে না ফিরলেও নজরুলের স্মৃতি এখনো আঁকড়ে ধরে আছে দৌলতপুরবাসি। নজরুলকে ভুলতে পারেনি এ জনপদের মানুষ। দৌলতপুরে কবি নজরুলের ৪টি স্মৃতি ফলক রয়েছে। 

মুরাদনগর নার্গিস নজরুল বিদ্যানিকেতনের প্রধান শিক্ষক মো. জহিরুল ইসলাম জানান, দৌলতপুরে কবি নজরুল এর অনেক স্মৃতি রয়েছে। এখানে কবি নজরুল তাঁর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ দুই মাস অতিবাহিত করেছেন। কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিকে ধরে রেখে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে কবির সাহিত্য, গল্প এবং সংগীতসমূহ তুলে ধরার জন্য এ নার্গিস নজরুল বিদ্যা নিকেতন প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রতিষ্ঠার ১৫ বছর পর বিদ্যা নিকেতনটি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় এমপিও পায়। 

মুরাদনগর উপজেলার ইউএনও আভিষেক দাস বলেন, মুরাদনগরের দৌলতপুর গ্রামটি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিধন্য। কবি এখানে তাঁর বেশকিছু সাহিত্য কর্ম রচনা করেছেন। তিনি তাঁর  জীবনের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সময় এখানে কাটিয়েছেন। তাই দৌলতপুর গ্রামকে কবি তীর্থ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এখানে  কবির ম্যুরাল, নার্গিস নজরুল বিদ্যা নিকেতন, নজরুল মঞ্চসহ আরও বেশ কিছু স্থাপনা রয়েছে। কিছুদিন আগে কবি নজরুল ইসলামের জন্মবার্ষিকী কবি তীর্থ দৌলতপুরে পালিত হয়েছে। ১২ই ভাদ্র  শনিবার কাজী নজরুল ইসলামের এর ৪৬তম মৃত্যুবার্ষিকী দৌলতপুরে পালিত হবে। 

কান্দিরপাড় এসে নজরুল তার মামা শ্বশুর আলী আকবর খানকে লেখা চিঠিতে বাবা শশুর সম্বোধন করে লেখেন, “আপনাদের এই অসুর জামাই পশুর মতন ব্যবহার করে এসে’ যা কিছু কসুর করেছে তা সকলে ক্ষমা করবেন। এইটুকু মনে রাখবেন, আমার অন্তর-দেবতা নেহায়েৎ অসহ্য না হয়ে পড়লে আমি কখনো কাউকে ব্যথা দিই না। আমি সাধ করে পথের ভিখারী সেজেছি বলে লোকের পদাঘাত সইবার মতন ক্ষুদ্র আত্মা অমানুষ হয়ে যাইনি। আপনজনের কাছ থেকে পাওয়া অপ্রত্যাশিত এতহীন ঘৃণা অবহেলা আমার বুক ভেঙ্গে দিয়েছে।”

নজরুলের অতিসংবেদনশীল মনের পরিচয় পত্রাংশে পাওয়া গেলেও কেন তার মন ভেঙ্গে যায় এটি উল্লেখ করা হয়নি পত্রের কোথাও। অনুমান করা হয় হয়তো খান পরিবারের কোনো সদস্যের আচরণে তার মনের এ অবস্থা। তবে কথিত রয়েছে যে, বিয়ের আসরে কাবিনের শর্ত নিয়ে তর্কাতর্কি হয়েছিল। তাছাড়া কন্যাপক্ষ এমনও দাবি, করেছিল যে, বিয়ের পর নজরুল বউ নিয়ে কোথাও যেতে পারবেন না বরং নজরুলকেই শশুর বাড়িতে থাকতে হবে। হয়ত তা নিয়েই হয়তো নজরুল মনে আঘাত পেয়েছিলেন।
nazrul chetonaকান্দিরপাড়ে কিছু দিন অবস্থান করে নজরুল প্রেম-বিরহ ও বিচ্ছেদের অগ্নিজ্বালা নিয়ে ৮ জুলাই বিকেল বেলায় কুমিল্লা ত্যাগ করে কলকাতা চলে যান।

দৌলতপুরের নার্গিসের সাথে বিচ্ছেদের বিরহ কাটিয়ে নজরুল প্রেমে মজেন কুমিল্লা কান্দিরপাড়ের মেয়ে আশালতা সেনগুপ্তা প্রমীলার। ১৯২৪ সালের ২৫ এপ্রিল (বাংলা ১৩৩১ সালের ১২ বৈশাখ) তারিখে শুক্রবার বাদ জুম্মা কলকাতার ৬ নং হাজী লেনে নজরুলের সঙ্গে আশালতা সেনগুপ্তা প্রমীলার বিয়ে হয়। প্রমীলাকে নিয়েই কেটেছিল নজরুলের দাম্পত্য জীবন। যদিও নজরুলের বিয়ে তৎকালীণ কুমিল্লার হিন্দু সমাজ মেনে নিতে পারেনি। সেনগুপ্ত পরিবার এবং বিরজাসুন্দরী দেবীও অখুশী হন। তবে তাতে কী, নজরুল তার বাকি জীবনটা প্রমীলার হাত ধরেই পার করেছেন।

জানা যায় কুমিল্লায় গোমতী নদীর আনন্দময় স্মৃতিকে মধুরতম করতেব নজরুল লিখেছিলেন, “উদাস দুপুর কখন গেছে এখন বিকাল যায়, ঘুম জড়াল গোমতী নদীর ঘুমুর পরা পায়। (চৈতী হাওয়া ছায়ানট)। প্রমীলাকে নিয়ে গোমতীর নদীর স্মৃতিও উঠে এসেছে তার লেখায়। তিনি লিখেছেন, “প্রথম উঠিল কাঁদি অপরূপ ব্যথা, গন্ধ নাভি পদ্মমূলে।” (পূজারীনি দোলনচাপাঁ) । 

>> আরও পড়ুন: মানিকগঞ্জের এই আঙিনায় বেড়ে উঠেছিলেন কবিপত্নী প্রমীলা নজরুল

নজরুল কুমিল্লায় থাকাকালীন (১৯২১-২৩) ভিক্টোরিয়া কলেজ সংলগ্ন রানীর দিঘীর পশ্চিমপাড়ে কৃষ্ণ চূড়া গাছের নীচে বসে প্রতিদিন কলেজ পড়ুয়া তরুনদের নিয়ে কবিতা-গানের আসর জমাতেন, আড্ডা দিতেন বলেও জানা যায়। বর্তমানে স্থানটিতে একটি স্মৃতি ফলক রয়েছে। এখানে বসে কবি নজরুল, ‘মাধবী লতা দোলে’সহ আরও অনেক গান ও প্রমীলার কাছে চিঠি লিখেছেন।

ধর্ম সাগরের পশ্চিমপাড়ে বসে নজরুল গান ও কবিতা লিখতেন সেই স্থানে রয়েছে একটি স্মৃতিফলক। প্রমীলাদের বাড়ির পাশেই ছিল বিশিষ্ট কংগ্রেস নেতা বসন্ত কুমার মজুমদারের বাড়ি। কবির সাথে পরিচয় হয় বাগিচাগাঁওয়ের বিপ্লবী অতীন রায়ের সাথে। এ সড়ক সংলগ্ন বসন্ত স্মৃতি পাঠাগারে কবি আড্ডা দিতেন, কবিতা লিখতেন, এখানেও রয়েছে নজরুল ফলক । শহরের বজ্রপুরে অবস্থিত বহু পুরাতন ইউসুফ স্কুল। ১৮৭৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এই স্কুলের নিকটেই ছিল অবিনাশ ময়রার দোকান। এই দোকানের পাউরুটি ও রসগোল্লা ছিল কবির প্রিয়। কবি নজরুল কুমিল্লায় অবস্থানকালে বেশ কয়েকবার দারোগা বাড়ির মাজারের পার্শ্ববর্তী এই বাড়ির সঙ্গীত জলসায় অংশ নিয়েছেন। নজরুল স্মৃতি রক্ষা পরিষদ ১৯৮৩ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর এই বাড়ির সামনে একটি ফলক স্থাপন করে। 
cumillaফলকে উল্লেখ করা হয়, ‘বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ১৯২১, ১৯২২, ১৯২৩ এখানে গজল গানের মজলিসে যোগ দিয়েছেন। এখানে ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খসরুসহ অনেক গান গেয়েছেন। টাউন হল ময়দানে অনেক সমাবেশ, অনেক জনসভায় অংশ নিয়েছেন কবি। শহরের মহেশাঙ্গন স্থানটিও নজরুল স্মৃতিবিজড়িত। ওইসময় স্বদেশী আন্দোলনের
যুগ। প্রতিদিন সভা-সমাবেশ লেগেই থাকতো মহেশাঙ্গনে। এখানে অনেক সমাবেশে ভক্তদের অনুরোধে গানে অংশ নিয়েছেন বিদ্রোহী কবি। ‘আলো জ্বালা আলো জ্বালা’ প্রভৃতি গান গেয়েছেন।

শহরের মুরাদপুর চৌমুহনীর কাছেই ইতিহাসখ্যাত জানুমিয়ার বাড়ি। জানে আলম চৌধুরী ছিলেন নজরুলের সুহৃদ। এই বাড়িতে রক্ষিত ছিল নজরুলের ব্যবহৃত তবলা। বাড়িটি একতলা ছিল, এখন দ্বিতল। এই বাড়ির ফলকে লেখা আছে “এই মুরাদপুর মৌলভী বাড়ির জানে আলম চৌধুরী (জানু মিয়া) ছিলেন একনিষ্ঠ সঙ্গীত সাধক। উপমহাদেশের অনেক প্রখ্যাত সঙ্গীত শিল্পীরা এই বৈঠকখানার গানের আসর জমিয়েছেন।’ তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খসরু, শচীন দেব বর্মণ ও কাজী নজরুল ইসলাম। শহরের ২য় মুরাদপুর মুরগীর খামার অফিসের পেছনে মহারাজ কুমার নবদ্বীপ চন্দ্র দেব বর্মন বাহাদুরের রাজবাড়ীতে ১৯২২ সালে অনেকদিন নজরুল শচীন্দ্র দেব বর্মনের সঙ্গে বসে সঙ্গীত চর্চা করতেন।

কুমিল্লা নজরুল ইনস্টিটিউট-এর কমিটির কর্মকর্তা নজরুল প্রেমী সাংবাদিক অশোক কুমার বড়ুয়া বলেন, কবি কাজী নজরুল ইসলাম আর কুমিল্লা একে অপরের সাথে ওতপ্রোতভাবেই  জড়িত। নজরুল ইসলামের জীবনের প্রথম প্রেম হয় কুমিল্লায়। কুমিল্লাতেই নজরুল ইসলামের দুই প্রিয়তমার বাড়ি।

কুমিল্লা শহরের সার্কিট হাউস রোডে শিল্পকলা একাডেমী প্রাঙ্গনে নির্মিত হয়েছে চেতনায় নজরুল স্মারক ভাস্কর্য, নগরীর বাদুরতলায় অবস্থিত কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতি ফলক, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের পশে বসে গান রচনা করেছেন। নগরীর রানীরকুটি এর পাশে অবস্থিত কাজী নজরুল পরিষদ।

প্রতিনিধি/এএ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর