চা বাগানের সবুজ বুকে পাতা তোলার কাজে ব্যস্ত শ্রমিকদের ছবি আমাদের চোখকে যতটা মুগ্ধ করে, তাদের জীবনের গল্প ততটা আনন্দদায়ক বা সৌন্দর্যে মোড়া নয়। এই গল্পের শ্রমিকরা সাংসারিক কাজকর্ম শেষে সকালেই বেরিয়ে পড়েন। কখনো রোদে পুড়ে কখনো বৃষ্টিতে ভিজে তারা কাজ করেন টিলায় টিলায়।
পরিশ্রান্ত কর্মযজ্ঞের ব্যস্ততায় ক্ষুধা জানান দেয়, পেটপূর্তির আয়োজন না হলে বাকি কাজ যে কাঙ্ক্ষিত গতিতে শেষ হবে না! তাই চাই বিরতি। খেতে হবে মধ্যাহ্নের খাবার। দরিদ্র শ্রমিকদের কপালে দামি খাবার জোটে না কোনোদিনই। তবে তারা যেটি খেয়ে থাকেন তা অনেকের কাছেই অজানা। অবিশ্বাস্যও বটে। দুটি পাতা একটি কুঁড়ির দেশ সিলেটে চা পাতার কুঁড়ি দিয়ে তৈরি হয় চা শ্রমিকদের ঐতিহ্যবাহী ভর্তা। মুখরোচক এই বিশেষ ভর্তার নাম ‘পাতিচখা।’
আমরা সবাই জানি যে, চায়ের পাতা দিয়ে সাধারণত পানীয় তৈরির জন্য প্রস্তুত করা হয়। যেগুলোকে আমরা চা-পাতিও বলে থাকি। কিন্তু কাঁচা পাতা সরাসরি খাওয়া যায়, তাও আবার ভর্তা বানিয়ে! শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্য। যুগ যুগ ধরে চা শ্রমিকরা মধ্যাহ্নের আহারে এমনই ‘মুখরোচক খাবার’ খান।
বিজ্ঞাপন
সিলেট বিভাগের পর্যটন অধ্যুষিত জেলা মৌলভীবাজারে রয়েছে ৯২টি চা বাগান। এখানকার মাজদিহি চা বাগানের কয়েকজন নারী চা শ্রমিকের সাথে কথা হয় ঢাকা মেইলের। তারা জানান, সেই সাতসকালে ঘুম থেকে উঠে করতে হয় সংসারের কাজ। বাগান দূরে হলে আগেভাগে রওনা দিতে হয়। সপ্তাহে সোম থেকে শনিবার সকাল আটটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত কাজ করতে হয়।
কথা প্রসঙ্গে জানা যায়, তারা কেউ সকালে খেয়ে বের হন, কারও যদি সময় না থাকে তবে ছুটতে হয় খাবার নিয়েই। মধ্যাহ্নের খাবার বলতে সঙ্গে নিয়ে যান কেউ চাল ভাজা, কেউবা রুটি, কেউ কেউ মুড়ি, পেঁয়াজ, রসুন, কাঁচা কিংবা শুকনো মরিচ এবং লবণ। সেগুলির সাথে চায়ের কুঁড়ির পাতা মিশিয়ে বানানো হয় বিশেষ ধরনের চা পাতার ভর্তা (পাতিচখা)। যা তাদের মধ্যাহ্নভোজের নিত্যসঙ্গী।
আলাপকালে জানা যায়, ক্লান্ত দুপুরে পাতিচখা খেয়ে দুর্বল স্নায়ু আবার সবল করে নেন। আবার শুরু হয় কর্মযজ্ঞ। পড়ন্ত বিকেলে ওজন ধারের কাছে তোলা পাতার হিসাব দিয়ে ঘরে ফিরতে কারও সন্ধ্যা সাতটা থেকে রাত আটটা বেজে যায়। শুরু হয় নিজ সংসারের নানান কাজ।
ঢাকা মেইলকে চা শ্রমিকেরা জানান, তারা কখনো চার-পাঁচজনের, কখনো বা দশ-বারজনের একটি দলের হয়ে কাজ করেন। সেই দলের একজন অন্য শ্রমিকদের কাছ থেকে রুটি, চাল ভাজা, মুড়ি, চানাচুর, পিঁয়াজ, লবন, মরিচ, সেদ্ধ আলুসহ পাতিচখার নানা উপকরণ সংগ্রহ করেন। তারপর একটি পাত্রে সব উপকরণ জমা করেন। সব শেষে চা পাতার কচি কুঁড়ি হাতের তালুতে ডলে সেইসব উপকরণে মিশিয়ে তৈরি করেন পাতিচখা। তারপর সকলের হাতে হাতে বণ্টন করা হয়। সেগুলি দিয়েই চলে ভোজন পর্ব।
চায়ের কাঁচা পাতা রুটির সাথে মিশিয়ে খাওয়ার পর শারীরিক ক্লান্তি দূর হয়ে কর্মস্পৃহা জাগে। শরীরে নব উদ্দীপনা সৃষ্টি হয় বলে চায়ের পাতা খাওয়ার প্রথা আজও প্রচলিত আছে বলে চা শ্রমিকেরা ঢাকা মেইলের এই প্রতিবেদককে জানান।
‘পাতিচখা’র অসাধারণ স্বাদ এবং অনুভূতি একমাত্র চা বাগানেই পাওয়া যায় বলে জানান তারা।
বিজ্ঞাপন
বিশেষজ্ঞদের মতে চা জনগোষ্ঠীর কৃষি ছিল আদি পেশা। ১৮৪০ সালে দিকে বাংলাদেশে চায়ের চাষাবাদ শুরু হয়। মাটি, আবহাওয়া ও জলবায়ু অনুকূলে থাকায় দেশের বেশিরভাগ চা বাগান সিলেট ও চট্টগ্রামে সৃষ্টি হয়। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে চা গাছের পরিচর্যার জন্য আদি জনগোষ্ঠীর মধ্যে থেকে এখানে শ্রমিক আনা হয়। এ জনগোষ্ঠী আদিকাল থেকে চাষাবাদে লিপ্ত ছিলেন। কাজের ক্লান্তি দূর করার জন্য মধ্যাহ্ন বিরতিতে রুটি খাওয়া ছিল তাদের পুরানো প্রথা। চা বাগানে কাজ করতে এসে সেই প্রথাকে আজও ধরে রেখেছেন তারা। সময়ের ব্যবধানে শুধু শুধু রুটি খাওয়াটাকে পছন্দ করেনি অনেকে। মনের অগোচরে চা গাছের কচি পাতা হাতের তালুতে ডলে রুটির সাথে খাওয়া শুরু করেন তারা। চা পাতার ভর্তা খাওয়ার পুরোনো সেই প্রথা এখনো চালু আছে।
প্রতিনিধি/এএ