বুধবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

নিয়োগ ও বিএড সনদ সবই ভুয়া, তবু ২২ বছর ধরে শিক্ষকতা করছেন নুরুজ্জামান

জেলা প্রতিনিধি, নেত্রকোনা
প্রকাশিত: ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৫:০২ পিএম

শেয়ার করুন:

নিয়োগ ও বিএড সনদ সবই ভুয়া, তবু ২২ বছর ধরে শিক্ষকতা করছেন নুরুজ্জামান
নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ইংরেজি বিষয়ের সহকারী শিক্ষক মোহাম্মদ নুরুজ্জামান।

নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ইংরেজি বিষয়ের সহকারী শিক্ষক মোহাম্মদ নুরুজ্জামান। অবৈধ নিয়োগে ২২ বছর ধরে চাকরি করার অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে।

পাশাপাশি ভুয়া বিএড সনদ দিয়ে উচ্চতর স্কেলে বেতন ভাতা নিচ্ছেন তিনি।


বিজ্ঞাপন


২০০৩ সালে তার নিয়োগকালে জনবল কাঠামোতে ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষকের পদ ছিল না। জনবল কাঠামো বহির্ভূতভাবে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রচার করায় তার নিয়োগ অবৈধ বলে উল্লেখ করা হয়।

এছাড়া বিদ্যালয়ে নিয়মিত উপস্থিত থেকেও বিএড পড়াশোনা, বিধিবহির্ভূতভাবে বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএড সনদ অর্জন করে উচ্চতর স্কেলে বেতন ভাতা গ্রহণ করছেন তিনি।

এসব কারণে ২০১৬ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদফতরের পরিদর্শন রিপোর্টে মোহাম্মদ নুরুজ্জামানের নিয়োগ অবৈধ উল্লেখ করা হয়। ওই সময় পর্যন্ত উচ্চতর স্কেলে প্রাপ্ত সরকারি বেতন ভাতা সরকারি কোষাগারে ফেরত দিতে বলা হয়।

তবে দীর্ঘ বছরেও বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। উল্টো বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টার অভিযোগ রয়েছে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে।


বিজ্ঞাপন


সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদফতরের পরিদর্শনকালে শিক্ষক মোহাম্মদ নুরুজ্জামানের অবৈধভাবে নিয়োগ ও বিএড সনদ অর্জন এবং উচ্চতার স্কেল প্রাপ্তির বিষয়টি ধরা পড়ে। শিক্ষা পরিদর্শক মো. আব্দুস সালাম আজাদ ও সহকারী শিক্ষা পরিদর্শক মোস্তাফিজুর রহমান স্বাক্ষরিত ওই পরিদর্শন রিপোর্ট প্রকাশ হয় ২০১৮ সালের মে মাসে।

ওই রিপোর্টে ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক মোহাম্মদ নুরুজ্জামানের নিয়োগকালে বিধিবহির্ভূতভাবে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ, বিদ্যালয়ে উপস্থিত থেকেও বিএড অধ্যয়ন এবং নিয়মবহির্ভূতভাবে বিএড সনদ অর্জন করে উচ্চতর স্কেলে বেতন ভাতা গ্রহণ করার বিষয়টি উল্লেখ করেন তারা। সেই সঙ্গে তার নিয়োগ অবৈধ উল্লেখ করে ওই সময় পর্যন্ত প্রাপ্ত সরকারি বেতন ভাতা সরকারি কোষাগারে ফেরত দিতে বলা হয়।

তারা রিপোর্টে লেখেন- ২০০৩ সালের ১৩ মে মোহনগঞ্জ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ইংরেজি বিষয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন মোহাম্মদ নুরুজ্জামান। তার ইনডেক্স নম্বর- ১০০৩৯৩৮। এর আগে একই বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি জাতীয় পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। আর নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় ৯ মে। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয় যে, শূন্য পদে দুই জন ইংরেজি শিক্ষক আবশ্যক। স্নাতকে ইংরেজিসহ সব পরীক্ষায় ২য় শ্রেণি/বিভাগ থাকতে হবে। অথচ ১৯৯৫ সনের ২৪ অক্টোবর তারিখের জনবল কাঠামোতে ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষকের পদ নেই। জনবল কাঠামো বহির্ভূতভাবে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রচার করায় তার নিয়োগ বিধি সম্মত হয়নি।

আরও পড়ুন

মোল্লাকান্দিতে সেনাবাহিনীর অভিযান, ককটেলসহ আটক ৩

তারা রিপোর্টে আরও লেখেন- মোহাম্মদ নুরুজ্জামান ২০০৮ সালে চাকরিরত অবস্থায় ঢাকার শান্তামরিয়াম ইউনিভার্সিটি থেকে বিএড ডিগ্রি অর্জন করেন। বিএড ডিগ্রি অর্জন করার জন্য তাকে শিক্ষা ছুটি মঞ্জুর সংক্রান্ত তৎকালীন পরিচালনা কমিটির অনুমোদন সংক্রান্ত রেজুলেশন এবং ডিগ্রি অর্জন করার পর পাঁচ)বছর চাকরি করার অঙ্গীকারনামা প্রদর্শন করেননি। রেকর্ড যাচাইয়ে দেখা যায়, তিনি নিয়মিত প্রতিষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। চাকরির শর্ত বিধিমালা ভঙ্গ হয়েছে। তিনি শিক্ষা ছুটি না নিয়ে শান্তামরিয়াম ইউনিভার্সিটি থেকে বিএড ডিগ্রি অর্জন করায় বিএড ডিগ্রি অধ্যয়নকালীন সময়ের গৃহীত অর্থ সরকারি কোষাগারে ফেরতযোগ্য হবে। অন্যদিকে মন্ত্রণালয়ের পরিপত্র অনুযায়ী সরকারি -বেসরকারি ও মাধ্যমিক পর্যায়ে পাঠদান/স্বীকৃতি প্রাপ্ত বিদ্যালয়ে কর্মরত বিএড বিহীন শিক্ষক/শিক্ষিকাদেরকে সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে বিএড প্রশিক্ষণ গ্রহণ বাধ্যতামূলক। উক্ত পরিপত্র মোতাবেক তিনি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হতে ২০০৮ সনে বিএড ডিগ্রি অর্জন করায় বিএড দাবিতে উচ্চতর স্কেল পাবেন না। ফলে বিএড এর দাবিতে ২০০৯ সাল থেকে উচ্চতর স্কেলে প্রাপ্ত সব টাকা সরকারি কোষাগারে ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।

বিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মমতাজ জাহান। তিনি উপজেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। দীর্ঘ বছর ধরে বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি পদে ছিলেন প্রধান শিক্ষকের স্বামী, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও পৌর মেয়র লতিফুর রহমান রতন। গত বছরের ৫ আগস্ট পর্যন্ত তিনি সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন। স্বামী-স্ত্রী সভাপতি ও প্রধান শিক্ষক থাকায় পরিদর্শন রিপোর্ট আমলে নেওয়া হয়নি জানান স্থানীয়রা।

পরিদর্শন রিপোর্টের বিষয়টি উল্লেখ করে এ বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযুক্ত শিক্ষক মোহাম্মদ নুরুজ্জামান বলেন, এমন সমস্যা শুধু আমার একার নয়, আরও কয়েকজন শিক্ষকেরও রয়েছে। যারা অডিট করে তাদের অন্যায় আবদার থাকে, আবদার পূরণ না করায় তাদের ইচ্ছামতো রিপোর্ট লিখে দিয়েছে। রিপোর্ট প্রকাশের পর জেলা শিক্ষা অফিসের মাধ্যমে জবাব পাঠানো হয়েছে।

এ বিষয়ে প্রধান শিক্ষক মমতাজ জাহান বলেন, ওই রিপোর্টে বেশ কয়েকজন শিক্ষকের সমস্যার বিষয় উল্লেখ আছে। রিপোর্টের আপত্তির বিষয়গুলো নিষ্পত্তির বিষয়ে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার মাধ্যমে মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে।

বিষয়টি অবহিত করলে বিদ্যালয়ের অন্তর্বর্তীকালীন কমিটির সভাপতি ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আমেনা খাতুন বলেন, অডিট রিপোর্ট দেখার পাশাপাশি এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেব।

এ ব্যাপারে জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর কবির আহাম্মদ বলেন, বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

অভিযুক্ত শিক্ষক মোহাম্মদ নুরুজ্জামান।

প্রতিনিধি/এসএস

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর