সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

সুদানে হামলায় শহীদ শান্তিরক্ষী জাহাঙ্গীর, বাবাহারা হলো তিন বছরের ইরফান

জেলা প্রতিনিধি, কিশোরগঞ্জ
প্রকাশিত: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮:০০ পিএম

শেয়ার করুন:

সুদানে হামলায় শহীদ শান্তিরক্ষী জাহাঙ্গীর, বাবাহারা হলো তিন বছরের ইরফান

আফ্রিকার দেশ সুদানের আবেই এলাকায় সন্ত্রাসীদের ভয়াবহ হামলায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ছয়জন শান্তিরক্ষী প্রাণ হারিয়েছেন। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে শহীদদের কাতারে যুক্ত হয়েছেন কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলার জাঙ্গালিয়া ইউনিয়নের তারাকান্দি গ্রামের সন্তান জাহাঙ্গীর আলম (৩০)। শান্তির জন্য জীবন উৎসর্গ করা এই সেনাসদস্যের অকাল মৃত্যুর খবরে শোকে স্তব্ধ হয়ে গেছে তার পরিবার ও এলাকা।

শনিবার (১৩ ডিসেম্বর) আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতর (আইএসপিআর) এক খুদে বার্তায় এই মর্মান্তিক ঘটনার তথ্য নিশ্চিত করে। আইএসপিআর জানায়, সুদানের আবেই এলাকায় জাতিসংঘের একটি ঘাঁটিতে সন্ত্রাসীরা অতর্কিত হামলা চালায়। এতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ছয়জন শান্তিরক্ষী নিহত হন এবং অন্তত আটজন আহত হন। হামলার পরও সন্ত্রাসীদের সঙ্গে সংঘর্ষ চলমান রয়েছে। পুরো এলাকা এখনো অস্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে।


বিজ্ঞাপন


নিহত জাহাঙ্গীর আলম কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলার জাঙ্গালিয়া ইউনিয়নের তারাকান্দি গ্রামের আকন্দ বাড়ির হযরত আলীর ছেলে। তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে মেসওয়েটার পদে কর্মরত ছিলেন। তার ব্যক্তিগত নম্বর (সিএস-২২০১০৯)। গত ৭ নভেম্বর পরিবারের চোখের জল আর বুকভরা স্বপ্ন নিয়ে তিনি সুদানে শান্তিরক্ষা মিশনে যোগ দেন।

thumbnail_1000122891

পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, তিন ভাইয়ের মধ্যে জাহাঙ্গীর আলম ছিলেন মেজো। তার বড় ভাই মো. মোস্তফা প্রবাসে কর্মরত এবং ছোট ভাই মো. শাহিন মিয়া বাড়িতে কৃষিকাজ করেন। স্ত্রী রুবাইয়া আক্তার ও তিন বছরের একমাত্র সন্তান ইরফানকে রেখে দেশের বাইরে দায়িত্ব পালনে গিয়েছিলেন তিনি। বাবার মৃত্যুর খবর জানার পর থেকে ছোট্ট ইরফান যেন কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না—বাবার আদর কী, তা বোঝার আগেই চিরতরে পিতৃহারা হলো শিশুটি।

প্রায় ১১ বছরেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন জাহাঙ্গীর আলম। শান্তিরক্ষা মিশনে দায়িত্ব পালনের স্বপ্ন নিয়েই এক মাস সাত দিন আগে সুদানে যান তিনি। পরিবারের সদস্যরা জানান, সন্তান ও পরিবারের ভালো ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিদেশের মাটিতে দায়িত্ব পালন করছিলেন তিনি।


বিজ্ঞাপন


জাহাঙ্গীর আলমের মৃত্যুর খবরে তারাকান্দি গ্রামে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। প্রতিবেশীরা জানান, শান্ত স্বভাবের, বিনয়ী এই মানুষটি দেশের জন্য জীবন দিয়ে গেছেন। এলাকায় শোকের মাতম চলছে। সবাই এক কণ্ঠে শহীদ জাহাঙ্গীর আলমের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছেন এবং তার অসহায় পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন।

নিহতের ছোট ভাই মো. শাহিন মিয়া কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমার ভাই আমাকে খুব আদর করত। কিছুদিন আগেও ফোন দিয়ে বলেছিল মা-বাবার যত্ন নিতে, কৃষিকাজগুলো ঠিকভাবে করতে। সে দেশে ফিরে সব ঠিক করে দেবে বলেছিল। এরপর আমার ফোন নষ্ট হয়ে যায়, ভাইয়ের সঙ্গে আর যোগাযোগ হয়নি।

আরও পড়ুন

সুদানে হামলায় নিহত শান্তিরক্ষী সবুজের গাইবান্ধার বাড়িতে আর্তনাদ

নিহতের চাচাতো ভাই হানিফ মিয়া বলেন, জাহাঙ্গীর আলমের মতো মানুষ খুব কমই হয়। সব বিষয়ে পরিবারের সঙ্গে পরামর্শ করত। গতকাল রাতে মিশনে হামলার খবর শুনে আমরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ি। পরে তার সঙ্গে থাকা একজনের কাছ থেকে নিশ্চিত হই যে সে শহীদ হয়েছে।

শহীদের বাবা হজরত আলী কান্নায় ভেঙে পড়ে বলেন, এক মাস আগে আমার ছেলে মিশনে গেছে। যাওয়ার সময় বলে গেছে তার ছেলেকে দেখে রাখতে। আমি অসুস্থ মানুষ, কাজ কম করতে বলেছে। দেশে ফিরে আমার চিকিৎসার জন্য টাকা দেবে বলেছিল। এখন আমার বাবা আর নেই।” এ কথা বলতে বলতে তিনি বারবার কান্নায় ভেঙে পড়েন।

1000122893

নিহতের মা পালিমা বেগম শোক সামলাতে না পেরে বারবার ছেলের কথা বলতে গিয়ে অসংলগ্ন হয়ে পড়েন। তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, আমার বাবাকে এনে দেন। সে ছিল খুব সুন্দর, লম্বা, আমার ঘরের বাবা। আমি এখনো আমার বাবাকে খুঁজছি।

শহীদের স্ত্রী রুবাইয়া আক্তার স্বামীর মৃত্যুর খবর শুনে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন।

নিহতের ফুফাতো ভাই ও হোসেন্দী ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান মো. সুরুজ মিয়া মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, মিডিয়ার মাধ্যমে হামলার খবর শুনে আমরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ি। পরে তার সঙ্গে থাকা একজন ফোন করে মৃত্যুর বিষয়টি জানায়। দেশের হয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় জীবন দেওয়া গর্বের হলেও এমন মৃত্যু মেনে নেওয়া খুব কষ্টের।

পাকুন্দিয়া উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রুপম দাস বলেন, ঘটনার খবর শোনার পরই আমি শহীদ জাহাঙ্গীর আলমের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। সরকারিভাবে প্রয়োজনীয় সহায়তার বিষয়টি দেখা হচ্ছে।

প্রসঙ্গত, সুদানে চলমান সহিংস পরিস্থিতির মধ্যেও বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা জাতিসংঘের অধীনে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। শান্তি প্রতিষ্ঠায় দায়িত্ব পালনের সময় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যদের এমন আত্মত্যাগ জাতির জন্য গভীর বেদনার ও গর্বের বলে মন্তব্য করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

প্রতিনিধি/এসএস

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর