রোববার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

শেরপুরে ছড়িয়ে পড়ছে ‘অনলাইনে জুয়া’, সর্বস্ব খুইয়ে নিঃস্ব অনেকেই

মো. নাঈম ইসলাম, শেরপুর
প্রকাশিত: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:৩৮ পিএম

শেয়ার করুন:

শেরপুরে ছড়িয়ে পড়ছে ‘অনলাইনে জুয়া’, সর্বস্ব খুইয়ে নিঃস্ব অনেকেই

শেরপুর পৌর শহরের একটি বাজারে রড সিমেন্ট ও টিনের দোকান ছিল জাফর আলীর (ছদ্মনাম)। অল্প সময়েই জমজমাট ব্যবসা করে স্বচ্ছলভাবেই চলছিলেন তিনি। কিন্তু ব্যবসার ফাঁকে শুরু করেন অনলাইনে জুয়া খেলা। প্রথম দিন খেলায় জিতলেও এরপর থেকে হারতে থাকেন। প্রতি মাসেই কয়েকলাখ টাকা খোয়াতে থাকেন। এভাবে প্রতিষ্ঠানের প্রায় ২২ লক্ষাধিক টাকার ঋণে পড়ে যান।

একইভাবে আরেক মনোহরি দোকানদার অনলাইন জুয়ার নেশায় পড়ে ভিটেমাটি বিক্রি করে দেন। কেবল এ দুজনেই নয়, অনলাইনকেন্দ্রিক জুয়ার জাল ছড়িয়ে পড়েছে শেরপুরের গ্রামগুলোতে সবচেয়ে বেশি। অল্প সময়ে বেশি লাভের আশায় অনেক তরুণ এই নেটওয়ার্কে পা ফেলছেন। স্মার্টফোন ও ইন্টারনেটের সাহায্যে মধ্যবয়সী থেকে কিশোর, বাদ যাচ্ছেন না কেউই। শিক্ষার্থী থেকে শ্রমিক, নারী পুরুষ সবাই জড়িয়ে পড়ছে এই ভয়ানক ফাঁদে। এই জুয়ার নেশায় দ্বারা সর্বস্ব খুইয়ে নিঃস্ব হয়েছেন অনেকেই। বাড়ছে পারিবারিক অশান্তি-কলহ। আবার টাকা জোগাড় করতে অনেকেই জড়িয়ে যাচ্ছে নানান অপরাধে, বলছেন সচেতন নাগরিকরা। তবে প্রশাসনের নিয়ম নীতি ফাঁকি দিয়েই চলছে এসব অপরাধ।


বিজ্ঞাপন


সংশ্লিষ্টরা জানায়, স্মার্টফোনে এমসিডব্লিউ, জিটুইন, মোস্টবেট, ওয়ান এক্সেট, বেট উইনার, বেট ৩৬৫, মেলবেট, লাইনবেট, ক্রিক্সে, প্যারিম্যাচসহ বিভিন্ন অ্যাপসের মাধ্যমে চলে অনলাইন জুয়া। সর্বনিম্ন ১০ টাকা থেকে শুরু করে লাখ লাখ টাকার খেলা হয় এসব অ্যাপসে। বিশেষ করে রাশিয়া, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া থেকে জুয়ার সাইট পরিচালনা করা হয়। সাইট পরিচালনায় থাকা এজেন্টরা বিদেশি অ্যাপস পরিচালনাকারীদের কাছ থেকে হাজারে ৪০ থেকে ৬০ টাকা পর্যন্ত কমিশন পান। কেউ হারুক বা জিতুক, পরিচালনাকারীদের একাউন্টে জমা হতেই  থাকবে কমিশন।

শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলার খড়িয়া কাজিরচরের এক পরিচালনাকারীর খোঁজ নিয়ে জানা যায়, একসময় বেকার বাড়িতে বসে থাকতেন। একটি মোবাইল সিম কোম্পানিতেও কিছুদিন চাকরি করেছেন। কিন্তু এখন জিক্সার এসএফ মোটরসাইকেলে চলাফেরা করেন, শেরপুর, জামালপুর ও ময়মনসিংহে নিয়েছেন বাসাও। এ ব্যবসায় এসে দুই বছরেই কয়েক কোটি টাকার মালিকবনে গেছেন। একই গ্রামের আরও চারজন পরিচালনাকারীর অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা এসেছে রাতারাতি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক পরিচালনাকারী বলেন, তারা মূলত মেহেরপুরের কয়েকজনের পরামর্শ ও সহায়তা নিয়ে এ ব্যবসা করছেন। কোনো কোনো সময় আধাঘণ্টায় কয়েক লাখ টাকা তাদের একাউন্টে জমা হয়। আবার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে কোম্পানি কোটি টাকা পেয়ে যায়। এসব খেলায় শিল্পপতি থেকে শ্রমিক, মোটামুটি সব শ্রেণির লোকজনই আছে।

শেরপুর পৌর এলাকার এক জুয়াড়ি জানান, অনলাইন জুয়া প্রকাশ্যে খেললেও কেউ বুঝতে পারে না। মোবাইলে ডাটা থাকলেই চলে। এটা এমন নেশা যে, একবার খেলা শুরু করলে টাকা শেষ না হওয়া পর্যন্ত খেলতে ইচ্ছা করে। এখন দিন দিন নারীদের সংখ্যা বাড়ছে। আর এটি এখন গ্রামে সবচেয়ে বেশি ছড়িয়ে পড়েছে।


বিজ্ঞাপন


অনলাইন জুয়ায় আসক্ত তরুণদের অন্তত ১০ জনের পরিবারের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হলে বেশিরভাগই আত্মসম্মানবোধের কথা চিন্তা করে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি। অবশ্য তাদের খোঁজ নিতে গিয়ে দেখা যায়, কয়েকজন বিল্ডিং বাড়ি ও গাড়ি করে ফেলেছেন। তবে বেশিরভাগই হয়েছেন ঋণগ্রস্ত। অনেকেই ধারদেনা করে বাড়িঘর ছেড়ে চলে গেছেন রাজধানীতে।

অনলাইন জুয়া থেকে বেরিয়ে আসা এক ব্যক্তি জানান, এখন পর্যন্ত প্রায় ১০ লাখ টাকা খুইয়েছেন কেবল অনলাইন জুয়ার বিভিন্ন অ্যাপের ফাঁদে পড়ে। এসব অ্যাপের বেশিরভাগই ভারতীয় এবং লোভ দেখিয়ে টাকা হাতিয়ে নেয়। প্রথম প্রথম ১০ টাকা দিয়ে কয়েক হাজার টাকা পাওয়া যায়, পরে আবার সব একবারেই চলে যায়।

মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আওরঙ্গজেব আকন্দ বলেন, অনলাইন জুয়া হচ্ছে ‘ভার্চুয়াল বিষ’। এর প্রভাবে সামাজিক-সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক পরিবর্তন ঘটছে। ব্যবহারকারীরা বুঝে বা না বুঝে এসব অ্যাপের নেশায় পড়ে যায়। একবার আসক্ত হয়ে পড়লে এ গণ্ডি হতে বের হওয়া মুশকিল। আর টাকা হারিয়ে ফের টাকা যোগাতে অপরাধ করতেও দ্বিধা করবে না আসক্তরা। এখানে আইনের সংস্কার ও প্রয়োগ এবং সামাজিক সচেতনতা জরুরি।

শেরপুরের পুলিশ সুপার আমিনুল ইসলাম বলেন, অনলাইন ক্যাসিনোসহ বিভিন্ন জুয়ার অ্যাপ ব্যবহারকারীদের বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সক্রিয় আছে। এদেরকে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা অব্যাহত আছে।

প্রতিনিধি/টিবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর