পর্যটন অধ্যুষিত সবুজের সমারোহে পরিপূর্ণ চায়ের দেশ মৌলভীবাজার। এখানকার বহু দর্শনীয় স্থানসহ সব প্রাকৃতিক পর্যটনকেন্দ্রেগুলো সারাবছরই ভিড় করেন দেশের বিভিন্ন স্থানের পর্যটকরা। আর এখানে মিশ্র চিরহরিৎ প্রাকৃতিক বনে গড়ে তোলা হয়েছে ‘বর্ষিজোড়া ইকোপার্ক’। কিন্তু এখনও এই পার্কটিতে গড়ে ওঠেনি পরিবেশবান্ধব পর্যটনের সুযোগ-সুবিধা।
ইকোপার্কের চারপাশে জনবসতি থাকলেও জনসাধারণের অবাধ চলাচল রোধে প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা নেই। জেলা শহরের কাছে সবুজ ছায়ানিবিড় ইকোপার্কটির অবস্থান হলেও সুযোগ-সুবিধা ও নিরাপত্তার অভাবে পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠতে পারেনি।
বিজ্ঞাপন
বন বিভাগের বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সদর উপজেলায় মিশ্র চিরহরিৎ প্রাকৃতিক বনে গড়ে তোলা হয়েছে বর্ষিজোড়া ইকোপার্ক। বন্য প্রাণী ও উদ্ভিদবৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং পর্যটকদের আকর্ষণ করতে ২০০৬ সালে সংরক্ষিত এই বনভূমিকে ইকোপার্ক ঘোষণা করা হয়। ইকোপার্কটির আয়তন ৮৮৭ একর।
![]()
বর্ষিজোড়া ইকোপার্কে পর্যটকদের সুযোগ-সুবিধার জন্য ২০০৬-০৭ অর্থবছরে ২টি দুই কক্ষবিশিষ্ট ইকোকটেজ, ৪টি পিকনিক স্পট, ২টি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার, ৪টি নিরাপত্তাচৌকি, ৫টি গণশৌচাগার, ১টি টিকিট কাউন্টার ও ১টি তোরণ নির্মাণ করা হয়। কিন্তু জনবলসংকটে ইকোপার্কটি চালু হয়নি। ইকোকটেজসহ অন্যান্য অবকাঠামো ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে আছে। সুযোগ-সুবিধা না থাকা ও নিরাপত্তার অভাবে শহরের এত কাছে হওয়া সত্ত্বেও পর্যটকদের ইকোপার্কটি আকর্ষণ করতে পারেনি। সীমানা প্রাচীর না থাকায় ইকোপার্কটি অনেকটাই অরক্ষিত অবস্থায় আছে।
চিরসবুজ এই বনে রয়েছে শাল, গর্জন, শিমুল, বনাক, জারুল, মেহগনি, সেগুন, লোহাকাট, আমলকিসহ আরো হরেক রকমের বৃক্ষ। জীবজন্তুদের মধ্যে রয়েছে বানর, হনুমান, শিয়াল, মেছাবাঘ, উঁদ, কাঠবিড়ালী, শজারু, বনরুই, কাঁকড়া, খরগোশ, অজগরসহ বিভিন্ন প্রজাতির জীবজন্তু।
![]()
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, ২০২২ সালে লাউয়াছড়া-সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান ও বর্ষিজোড়া ইকোপার্কে বনায়ন ও ইকোট্যুরিজম উন্নয়ন প্রকল্প নামের একটি প্রকল্প বন অধিদফতরে জমা দেওয়া হয়েছিল। এতে বলা হয়, গুরুত্বপূর্ণ বন্য প্রাণী এ অঞ্চল থেকে হারিয়ে গেছে। অনেক প্রজাতি বিরল ও বিপন্ন হিসেবে টিকে আছে। এই পরিস্থিতিতে বন্য প্রাণী, জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষায় সহযোগী প্রাকৃতিক উদ্ভিদ পুনরুৎপাদনের পরিবেশ তৈরি প্রয়োজন। পর্যটনের জন্য পরিবেশবান্ধব অবকাঠামো নির্মাণ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ, গাছপালার সঙ্গে পরিচয়ের ব্যবস্থা, পর্যটকদের জন্য বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু প্রকল্পটি আর আলোর মুখ দেখেনি।
![]()
সম্প্রতি বর্ষিজোড়া ইকোপার্ক ঘুরে দেখা গেছে, পার্কটির প্রধান ফটক তালাবদ্ধ। পাশের ছোট একটি ফটক দিয়ে ইকোপার্ক-সংলগ্ন এলাকার মানুষ চলাচল করছেন। বনের একটু ভেতরে গেলে দেখা যায়, দুই টিলার দুই ধারে দু’টি কটেজ রয়েছে। কটেজে গেলে দেখা যায়, নতুন করে নির্মিত এই স্থাপনার দরজা-জানালা ভেঙে চৌচির। কটেজে কোনো আসবাবপত্র নেই। উন্মুক্ত কটেজ দু’টিতে মরীচিকা ধরেছে। এখানকার কর্তব্যরত কোনো চৌকিদার কিংবা গার্ডদের কাউকে দেখা যায়নি। বনের ভেতরের বিশাল আয়তনের যতদূর চোখ যায়, হাজারও জারুল, মেহগনি ও সেগুন গাছ চোখে পড়ে।
স্থানীয় অনেকের সাথে কথা হলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা জানান, এই পার্কে লোকবলের অভাব। রাতের বেলা বনের যে কোনো জায়গা থেকে বৃক্ষ কেটে নিলে মানুষ তো দূরের কথা কোনো কাক-পক্ষীও টের পাবে না।
পার্কের বাইরে চা বিক্রি করেন শফিক মিয়া। তিনি বলেন, এটি ইকোপার্ক নামে ঘোষণা হলেও আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয়নি এখনও। এখানে আসার পরিবেশ থাকলে পর্যটক অবশ্যই আসতেন। এখনও আসার পরিবেশ হয়নি। তবে মাঝেমধ্যে দুই একজন আসেন বলে তিনি জানান।
![]()
পরিবেশকর্মী সৈয়দ মহসিন পারভেজ বলেন, এ জেলায় একাধিক পর্যটন কেন্দ্র রয়েছে। এর মধ্যে বর্ষিজোড়া অন্যতম একটি ইকোপার্ক। কিন্তু সুযোগ-সুবিধা না থাকা ও নিরাপত্তার অভাবে শহরের এত কাছে হওয়া সত্ত্বেও পর্যটকদের ইকোপার্কটি আকর্ষণ করতে পারেনি।
পরিবেশবাদী লেখক ও শিক্ষক জাহাঙ্গীর জয়েস বলেন, পর্যটন শহর হিসেবে এ বর্ষিজোড়া ইকোপার্ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার কথা। এতদিনে এ পার্ক চালু না হওয়া অত্যন্ত দুঃখজনক।
![]()
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) জাতীয় পরিষদ সদস্য আ স ম সালেহ সোহেল বলেন, ইকোপার্ক চালু করলে সরকারের অনেক রাজস্ব আসবে। কারণ এখনও অনেক প্রকৃতিপ্রেমী প্রতিদিন এ নিরিবিলি পরিবেশে বেড়াতে পছন্দ করেন। কিন্তু এই ইকোপার্কের চারদিকে জনবসতি। সীমানাপ্রাচীর নেই। কোনো কিছু না থাকায় তারা আসলেও, হতাশ হয়ে চলে যান।
বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ সিলেটের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ইকোপার্ক নিয়ে লং টার্ম পরিকল্পনা দরকার। আমরা একটা পরিকল্পনা জমা দিয়েছিলাম। সেই আলোকে একটা মাস্টারপ্ল্যান নেওয়া হচ্ছে।
প্রতিনিধি/এসএস

