কয়েক বছর ধরে হবিগঞ্জ শহর ও আশপাশে জলাবদ্ধতা তীব্র আকার ধারণ করেছে। সামান্য বৃষ্টিতে দেখা দেয় জলাবদ্ধতা ও কৃত্রিম বন্যা। শহরের উঁচু-নিচু এলাকা জলমগ্ন হচ্ছে অহরহ। জেলা শহরের প্রধান সড়কসহ বিভিন্ন এলাকার সড়কে পানি জমে থাকে। ঘরবাড়িতে ঢুকছে বৃষ্টির পানি। এতে করে মানুষকে অবর্ণনীয় দুর্দশা পোহাতে হয়।
বৃষ্টির পানিকে গ্রহণ করার প্রধান আধার পুরাতন খোয়াই নদী ও শহরের পুকুর-জলাশয়, খাল দখল ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে এবং শহরের পশ্চিম পাশের বাইপাস সড়ক সংলগ্ন পানি নিষ্কাশনের পথ সংকুচিত হয়ে যাওয়ায় হবিগঞ্জ শহর জলাবদ্ধতার শহর হিসেবে পরিচিত লাভ করেছে। ভবিষ্যতে এই চিত্র আরও ভয়াবহ হবে। এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে হলে পুরাতন খোয়াই নদীসহ পুকুর-জলাশয়, খাল দখলমুক্ত করে সংরক্ষণে যত্নশীল হতে হবে। তা না হলে ভবিষ্যতে এই সংকট বৃদ্ধি পেয়ে ভয়াবহ পরিবেশ ও মানবিক সংকটে রূপ নেবে।
বিজ্ঞাপন
জলাবদ্ধতা নিরসনে পুরাতন খোয়াই নদী, পুকুর ও জলাশয়ের গুরুত্ব শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তারা একথা বলেন।
বিশ্ব পরিবেশ দিবস উপলক্ষে বুধবার (৪ জুন) দুপুরে হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসক সম্মেলন কক্ষে ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা) ও খোয়াই রিভার ওয়াটারকিপার এই আলোচনার আয়োজন করে।
এতে প্রধান অতিথি ছিলেন হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসক ড. মো. ফরিদুর রহমান। ধরার আহ্বায়ক তাহমিনা বেগম গিনির সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথি ছিলেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শামীম হাসনাইন মাহমুদ, বৃন্দাবন সরকারি কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নাগরিক আন্দোলনের সংগঠক অধ্যাপক মো. ইকরামুল ওয়াদুদ। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন খোয়াই রিভার ওয়াটারকিপার তোফাজ্জল সোহেল।
বিশিষ্টজনদের মধ্যে আলোচনায় অংশ নেন হবিগঞ্জ প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অ্যাডভোকেট মনসুর উদ্দিন আহমেদ ইকবাল, দৈনিক হবিগঞ্জ সমাচার সম্পাদক মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফা রফিক, বিশিষ্ট সাহিত্যিক সরকারি মহিলা কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ অধ্যাপক জাহান আরা খাতুন, গবেষক ড. শেখ ফজলে এলাহী, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য অধ্যক্ষ মো. এনামুল হক, মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী মোমিন, হবিগঞ্জ প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি শোয়েব চৌধুরী, অ্যাডভোকেট রুহুল হাসান শরীফ, ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি মো. শামসুল হুদা, অ্যাডভোকেট হাসবি সাঈদ চৌধুরী, সাংবাদিক আব্দুল হালিম, নূরজাহান বিভা প্রমুখ।
বিজ্ঞাপন
প্রধান অতিথির বক্তৃতায় জেলা প্রশাসক ড. মো. ফরিদুর রহমান বলেন, হবিগঞ্জ একটি পুরনো শহর। এই শহরে যেভাবে উন্নয়ন হওয়ার কথা ছিল তা হয়নি। শহরের বিভিন্ন স্থানে নোংরা আবর্জনা, রাস্তাগুলো ছোট, এগুলো প্রশস্ত হওয়া দরকার। এই শহরের জন্য একটি মাস্টার প্ল্যান দরকার। মানুষ চায় পুরোনো খোয়াই নদী থেকে অবৈধ দখল উচ্ছেদ হোক, পুকুর-জলাশয় ভালো থাকুক, এই শহরটি সুন্দর হোক। আমরাও তাই চাই। সে লক্ষ্যে কাজ করছি। ইতোমধ্যেই আমরা পুরোনো খোয়াই নদী দখল উচ্ছেদের কাজ শুরু করার কাজ করছি। সুন্দর নগরী হিসেবে শহরটিকে গড়ে তুলতে সবার সহযোগিতা দরকার। সকল দফতরের সমন্বয়ে কাজ করতে হবে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শামীম হাসনাইন মাহমুদ বলেন, ড্রেনেজ নেটওয়ার্ক পানি নিষ্কাশনের জন্য। কিন্তু এগুলোর বেশির ভাগ বন্ধ থাকে। পানি যাওয়ার সুযোগ নেই। পরিকল্পিত টেকসই ড্রেনেজ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। পুরাতন খোয়াই নদী শহরের বিশাল এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। নদীটি বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের উল্লেখযোগ্য জলাধার হিসেবে ব্যবহৃত হতো। সাম্প্রতিক কালে অবৈধ দখলদারদের কারণে এটির অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাচ্ছে। নদীতে পুনঃখনন করে বাইপাস সংলগ্ন খালের সাথে সংযোগ দিতে হবে যাতে সহজে পানি নিষ্কাশন হতে পারে।
মূল প্রবন্ধে খোয়াই রিভার ওয়াটারকিপার তোফাজ্জল সোহেল বলেন, নাগরিক আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ২০১৪ সালে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে পুরাতন খোয়াই নদী রক্ষার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। সেসময় নদীর একাংশে অবৈধ দখলের সীমানা চিহ্নিতকরণের কাজ শুরু হয় উভয় পাশে ওয়াকওয়ে নির্মাণ ও খননের জন্য। এক সময় কাজ থেমে যায়। পরবর্তীতে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মাছুলিয়া থেকে শায়েস্তানগর পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার এলাকা থেকে কয়েকশ অবৈধ স্থাপন উচ্ছেদ করা হয়। নদীটি খনন, ওয়াকওয়ে নির্মাণ ও সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য সে সময় প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল। নাগরিক সমাজ আনন্দিত হয়েছিল। কিন্তু এই কাজটিও একসময় থেমে যায়। উচ্ছেদ করা অংশ পুনরায় দখলে চলে গেছে।
তিনি বলেন, শহরের বৃষ্টির পানি বাইপাস সংলগ্ন খাল হয়ে পশ্চিম পাশের খাল-জলাশয়ের মাধ্যমে নিষ্কাশন হতো। দিন দিন পানি নিষ্কাশনের পথ সংকুচিত হয়ে পড়েছে। বাইপাস সড়ক সংলগ্ন অনেক বড় বড় স্থাপন হচ্ছে। এসব স্থাপনার পথ তৈরি হচ্ছে খাল ভরা করে। এতে পানি নিষ্কাশন হচ্ছে না। ফলে জলাবদ্ধতা তীব্র হচ্ছে। বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের সব মাধ্যম পুকুর, নদী, খাল জলাশয় হারিয়ে জলাবদ্ধতা তীব্র থেকে তীব্রতা হচ্ছে। জলাবদ্ধতা পানি নিষ্কাশন ও পরিবেশ বিপর্যয়ে মানুষ আতঙ্কিত ও উৎকণ্ঠিত। অথচ জলাবদ্ধতা, পরিবেশ জীববৈচিত্র্য রক্ষার ক্ষেত্রে কার্যকর তেমন কোনো ভূমিকা নজরে পড়ছে না। দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ যথাযথ ভূমিকা পালন না করলে সার্বিক পরিবেশ প্রতিবেশ জনজীবন এর ওপর যে দীর্ঘস্থায়ী মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে তা বলাই বাহুল্য।
প্রতিনিধি/এসএস