মঙ্গলবার, ১৩ মে, ২০২৫, ঢাকা

ভাঙে নদী কাঁদে জনতা, নির্ভার পাউবো কর্মকর্তা!

আমানুল্লাহ আমান, রাজশাহী
প্রকাশিত: ০৯ মে ২০২৫, ০২:৫২ পিএম

শেয়ার করুন:

River erosion

ষাটোর্ধ বৃদ্ধ বেল্লাল হোসেন। তিনি রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার গোপালপুর গ্রামের বাসিন্দা। ৬৫ বছরের জীবনে স্বচক্ষে প্রায় হাজার খানেক বাসতবাড়ি পদ্মা নদীতে বিলীন হতে দেখেছেন তিনি। প্রায় ছয় দশক আগে তিনি শিশুকালে থাকা অবস্থায় নদীগর্ভে চলে যায় তার বাবার বসতভিটা। বর্তমানে বেল্লাল ও তার ৬ ভাইয়ের বাসাবাড়িও নদীতে বিলীন হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। তার আক্ষেপ, কর্মকর্তারা কার্যকরী কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেন না।

বেল্লাল হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, আমরা ৭ ভাই, ৩ বোন। ভাইদের মধ্যে আমি বড়। ৬ ভাই এক জায়গায় আছি। আমাদের পৈর্তৃক ভিটা নদীতে ভেঙে গেছে। এখন আমাদের বাড়িও ভেঙে যাওয়ার মুখে। মাত্র ১০০ হাত দূরে নদী, এবার বর্ষাকালে আমাদের বাড়িও ভেঙে যাবে হয়ত। জীবনে অনেক কিছু দেখেছি। ৩৫ বছর আগে পিরোজপুরে একটি স্কুল ভেঙে নদীতে চলে গেছে, ৪০ বছর আগে একটি মসজিদ ভেঙেছে। এখন ৩৬ জাতের লোক বাস করে চন্দনশহরে। ওখানকার কম করে হলেও ১ হাজার বাড়ি ভেঙে গেছে নদীতে। ফসল হত ধান, গম, মসুর সব হতো। সব ডুবে গেছে।


বিজ্ঞাপন


thumbnail_IMG-20250508-WA0019

বেল্লাল আক্ষেপ করে বলেন, হাটা শিখেছি তখন থেকে নদীভাঙন দেখছি। খালি দেখি, ৩ ঠ্যাংওয়ালা দূরবীনের মতো মেশিন নিয়ে আইস্যা দেখে যায়; ওই মেশিন আর মানুষ (কর্মকর্তা-কর্মচারি) দেখলে গায়ের মধ্যে জলি (জ্বলে) যাই আমারে, দেখতে আসে তখন খুব ভেতরে রাগ হয়। কারণ- বুদ্দি (বুদ্ধি) হওয়াতে দেখছি ৬০-৬৫ বছর হলো, খালি দেখি যায়, কিন্তু একটা ইট কেউ আইন্যা (এনে) ফেলতে পাইরলো না এই কারণে। শ শ মানুষের বাড়িঘর ভাইঙ্গি (ভেঙে) গেল, ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছে। এই মেশিন দিয়ে খালি লাইপি (মেপে) মানুষেক দেখায়ে লাভ আছে? কোনো কাজ করতে দেখিনি, এক মুঠ বালু বা মাটির বস্তা ফেলেনি। তাতি (তাতে) ১০ দিন থেকে বালুর বস্তা ফেলছে। বেল্লাল হোসেনের ভাষ্য, নদীগর্ভে বাড়িঘর হারানো কাউকে ত্রাণ দেওয়া হয়নি। শুধুমাত্র কয়েকজন ৪০০-৫০০ টাকা করে পেয়েছেন। ওই এলাকায় বাঁধ নির্মাণের দাবি জানিয়েছেন তিনি।

thumbnail_IMG-20250508-WA0020

স্থানীয় ব্যবসায়ী আব্বাস আলী ঢাকা মেইলকে বলেন, পিরোজপুর, গোপালপুর, চন্দনশহরের ১ হাজার বাড়ি আমার চোখের সামনে নদীতে ভেঙে গেছে। কাইপাড়া গ্রাম এখন আর নাই, নদীতে চলে গেছে। আমাদের বাড়ি ও একটা মাদরাসা এখন নদীর ভেতর। আমার বর্তমান বাড়ির ৫০ ফিট কাছে পদ্মা নদী আছে। এবার আষাঢ় মাস আসেনি তাও আগাম নদী ভাঙছে। আমরা ঝুঁকির মধেই আছি। স্থায়ী সমাধান ব্লক বা বাধ নির্মাণ, তাহলে আমরা রক্ষা পাব। তাছাড়া আরও অনেক বাড়িঘর পদ্মায় বিলীন হয়ে যাবে।


বিজ্ঞাপন


thumbnail_IMG-20250508-WA0018

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্র জানিয়েছে, রাজশাহী বিভাগে ১৬২ কিলোমিটার এরিয়া নদীর সঙ্গে সংযুক্ত। এরমধ্যে রাজশাহী জেলার ৯০ কিলোমিটার এরিয়া নদী তীরবর্তী। এ বছর বিভাগের ৮ জেলার প্রায় ৬১ কিলোমিটার এলাকা নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। এরমধ্যে রাজশাহী জেলায় ৬ কিলোমিটারের কিছু বেশি জায়গা ভাঙনের কবলে পড়তে পারে। জেলার গোদাগাড়ী, বাঘা ও চারঘাট উপজেলার গ্রামগুলো রয়েছে বেশি ঝুঁকিতে। এছাড়া চাঁপাইনবাবগঞ্জে সাড়ে ৮ কি.মি, নওগাঁয় ৫ কি.মি, নাটোরে প্রায় সাড়ে ৪ কি.মি, পাবনায় আড়াই কি.মি, পাবনার বেড়ায় ২ কি.মি, বগুড়াতে ২৪ কি.মি, জয়পুরহাটে ২ কি.মি ও সিরাজগঞ্জে সাড়ে ৬ কি.মি ভাঙনের শঙ্কায় রয়েছে। এসব এলাকা চিহ্নিত করে প্রতিরোধমূলক কাজের জন্য মন্ত্রণালয়ের কাছে ২৫৫ কোটি টাকার চাহিদা চেয়েছে পাউবো। এরমধ্যে শুধুমাত্র রাজশাহী জেলার জন্য বাজেট চাওয়া হয়েছে ৪৫ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। পদ্মা, যমুনা, আত্রাই, করতোয়া, মহানন্দা ও পুনর্ভবা নদী তীরবর্তী এলাকায় এসব বাজেটে কাজ করা হবে। শুধু রাজশাহীতে পদ্মা এবং কিছু অংশ নওহাটার বার নয় নদী রয়েছে।

আরও পড়ুন

দেওয়ানগঞ্জে যমুনার ভয়াবহ ভাঙন, আতঙ্কে হাজারও মানুষ

প্রতিবছর নদী ভাঙনে বসতভিটা, মসজিদ, স্কুল, মাদরাসা ও ফসলি জমি হারিয়ে ভুক্তভোগীরা চরম হতাশ। তবে এসব ব্যাপারে কর্মকর্তারা একেবারে নির্ভার রয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

thumbnail_IMG-20250508-WA0017

কৃষক বেল্লাল হোসেন বলেন, আমরা এখনও কোনো ত্রাণ পাইনি। এসব ব্যাপারে জানতে পাউবো উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল (রাজশাহী বিভাগীয়) অফিসের সর্বোচ্চ কর্তা অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (পুর) মো. মুখলেসুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। অফিসে গেলে তার ব্যক্তিগত সহকারী জাহাঙ্গীর ও একজন পিওন বলেন, স্যারের সঙ্গে স্থানীয় কোনো সাংবাদিকের দেখা করার অনুমতি নাই। উনার সঙ্গে দেখা করা যাবে না। দীর্ঘক্ষণ বোঝানোর পর মুখলেসুরকে সাংবাদিকের সাক্ষাতের কথা তারা জানান। কিন্তু সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলেননি মুখলেসুর রহমান।

পরে ওই কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রেজাউল করিমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি ঘটনাটি শুনে ওই অফিসের আরেক কর্মকর্তাকে ফোন করে এরকম পুনরাবৃত্তি না হওয়ার ব্যাপারে সতর্ক করেন। এ সময় রেজাউল করিম ঢাকা মেইলকে বলেন, এমনটা হওয়া উচিত নয়। শুধু রাজশাহী বিভাগ বা জেলার বাসিন্দা নয়, সারাদেশের যেকোনো নাগরিকের জন্য আমাদের দরজা খোলা রাখতে হবে। যে কেউ আসতে পারে, দেখা করে কথা বলতে পারে।

IMG-20250508-WA0016

নদী ভাঙনের ব্যাপারে রেজাউল করিম বলেন, নদীভাঙন তো অবশ্যই আমাদের জাতির জন্য অভিশপ্ত। একটা বাড়িতে চুরি হলে বা আগুন লাগলে জিনিসপত্রগুলোই যায়, কিন্তু যখন ওই বাড়িটা নদীতে ভেঙে পড়ে যায়, তখন কিন্ত তার সর্বস্ব চলে গেল। সে আর ওই জায়গাটাতেই থাকতে পারলো না। চুরি হলো ডাকাতি হলো আগুন লাগলো, আবার সাহায্য নিয়ে ঘরটা তুলে নিতে পারে। কিন্তু নদীতে ভেঙে গেলে সর্বস্ব চলে গেল। এটা অবশ্যই আমাদের জন্য অভিশাপ। এজন্য নদী ভাঙনটা সবচেয়ে বড় দুর্যোগ বলে ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি। এটা অনেক কষ্টের। নদী ভাঙনে শুধু বাড়িঘর নয়, স্কুল কলেজ ও কৃষিজমিও নদীতে চলে যায়। এতে অর্থনীতিতে অবশ্যই বড় নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, দেশেরও ক্ষতি হয়।

পাউবোর পদক্ষেপ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আগাম এখনও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তবে প্রতিরোধের জন্য আমরা কাজ করছি। মন্ত্রণালয় থেকে প্রতি বছরই চাহিদা চায়, এবারও চেয়েছে, আমরা ভাঙনের ঝুঁকিতে থাকা এলাকার লিস্ট করে পাঠিয়েছি। আমাদের প্রিপারেশন আছে।

thumbnail_IMG-20250508-WA0021

ভাঙন এলাকায় বাসিন্দাদের উদ্দেশে রেজাউল করিম বলেন, স্থানীয়রাও স্ব উদ্যোগে কাজ করতে পারেন। অনেক জায়গায় আমাদের বাঁধ যেগুলো আছে, সেখানে ইঁদুরে গর্ত থাকে, এপাশ থেকে মাটি কেটে ওই পাশে বের করে দেয়। ওই গর্ত দিয়ে পানি ঢুকে, বর্ষাকালে ওই গর্ত দিয়ে পানি ঢুকে ঢুকে বাঁধটা ভেঙে দেয়। তখন কিন্তু নদীর পানিটা লোকালয়ে চলে আসে। এলাকার জনগণ যদি সতর্ক হয়ে দু’পাশ থেকে দু-চার কোদাল মাটি বা তিন-চার ডালি মাটি এনে দিয়ে দেয়, তাহলে কিন্তু ভালো থাকে।

এ বিষয়ে পাউবো রাজশাহী জেলা অফিসের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুর রহমান অঙ্কুর ঢাকা মেইলকে বলেন, এটা প্রাকৃতিক দুর্যোগ। নদীর গতি ও মরফোলজি বিবেচনা করে প্রজেক্টের আওতায় এনে থাকি আমরা। যে জায়গাগুলো সেভ করার প্রয়োজন হয়, আমরা সেগুলোতে স্টেপ নিই। আমরা ইমার্জেন্সি কাজ শুরু করেছি। জিও ব্যাগ দেওয়া হচ্ছে।

thumbnail_IMG-20250508-WA0015

তিনি বলেন, স্থানীয়রাও কাজ করতে পারে। নদীর জায়গা যাতে কেউ দখল না করে, দখল করলে নদীর ওপর অ্যাডভার্স ইফেক্ট পড়ে, ভাঙনের রূপে ফিরতে পারে। নদী দূষণ যাতে না হয় সে ব্যাপারে সচেতন হতে পারে। অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করলেও প্রভাব পড়ে, কেউ যাতে এমনটা না করে। কেউ করলে স্থানীয়রা প্রশাসনকে বা আমাদেরকে জানাতে পারে।

প্রতিনিধি/এসএস

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর