চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) মার্কশিট শাখায় প্রতিদিন অসংখ্য মার্কশিট সংশোধনির আবেদন পড়ে। এসব আবেদনের অধিকাংশই শিক্ষক বা কর্তৃপক্ষের ভুলের কারণে। কিন্তু মার্কশিটে শিক্ষক বা কর্তৃপক্ষ ভুল করলেও তা সংশোধনির জন্য টাকা গুনতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। এভাবে বছরের পর বছর মার্কশিট সংশোধনির নামে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অন্যায়ভাবে লাখ লাখ টাকা আদায় করছে প্রশাসন।
পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ অফিসের তথ্য মতে, চবির মার্কশিট শাখায় প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২৫টিরও বেশি মার্কশিট সংশোধনির আবেদন আসে। এরকম মাসে গড়ে ২০ দিন অফিস খোলা থাকে। তাহলে এক মাসে সংশোধনির আবেদন আসে প্রায় ৫০০টি। এভাবে বিভিন্ন কারণে প্রতি বছর অন্তত ৬ হাজার মার্কশিট সংশোধনির আবেদন করেন শিক্ষার্থীরা।
বিজ্ঞাপন
তারা বলছেন, এসব মার্কশিট সংশোধন করতে হয় দুইরকম ভুলের কারণে। একটা হলো শিক্ষার্থী কর্তৃক ভুল। যেমন— শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশন কার্ডে ভুল থাকলে তাদের মার্কশিটেও ভুল আসবে। কেননা, রেজিস্ট্রেশন কার্ডের তথ্য অনুযায়ী মার্কশিট প্রস্তুত হয়। এটা শিক্ষার্থীদের ভুল। আরেকটা ভুল হলো শিক্ষক বা কর্তৃপক্ষের ভুল। যেমন— রেজাল্ট বা সিজিপিএ ভুল, আবাসিক হলের নাম পরিবর্তন ইত্যাদি।
তবে, মার্কশিট শাখার একজন কর্মকর্তারা জানান, শিক্ষার্থীদের তেমন ভুল হয় না বললেই চলে। তার মতে, শিক্ষক বা কর্তৃপক্ষের ভুলেই বেশি মার্কশিট সংশোধন করতে হচ্ছে।
তিনি আরও জানান, মার্কমিটে শিক্ষার্থী কর্তৃক ভুলের জন্য ২২০ টাকা পে-অর্ডার করে সংশোধনির আবেদন করতে হয়। আর কর্তৃপক্ষের ভুলের জন্য ১১০ টাকা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত এক বছরে কেবল জননেত্রী শেখ হাসিনা হলের নামের ভুলের কারণেই প্রায় ১০ হাজার ছাত্রীকে মার্কশিট সংশোধন করতে হয়েছিল। যদিও এটি শিক্ষার্থীদের ভুল নয়, তবুও এই ভুল সংশোধনের জন্য শিক্ষার্থীদেরকেই ব্যাংকে পে-অর্ডার করতে হয়েছিল।
বিজ্ঞাপন
শিক্ষার্থী কর্তৃক ভুলের কারণে প্রতি মার্কশিট সংশোধনির জন্য ১১০ টাকা করে পে-অর্ডার করতে হয়। তাহলে মাসে গড়ে ৫০০টি মার্কশিট সংশোধনের আবেদনের জন্য শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে মাসে অন্তত ৫৫ হাজার টাকা অতিরিক্ত আদায় করছে প্রশাসন। তেমনি, বছরে অন্তত সাড়ে ৬ লাখ। এভাবে হিসাব করলে গত এক যুগে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিনাদোষে শিক্ষার্থীদের পকেট কেটেছে প্রায় ৮০ লাখ টাকার।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই দায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের হলেও তারা কোনদিন দায় নেয়নি। এজন্য শিক্ষার্থীদেরকেই নিজ দায়িত্বে তাদের মার্কশিট সংশোধন করতে হয়েছে। তাদের মতে, প্রশাসন যদি হলের নাম পরিবর্তন করতে পারে, তাহলে তাদের মার্কশিট সংশোধনের দায়িত্বও নেওয়া উচিত। তাহলে বিনাদোষে ছাত্র-ছাত্রীদের টাকাও খরচ হবে না আর ঝামেলায়ও পড়তে হবে না।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, আমি মনে করি, কর্তৃপক্ষের ভুলের কারণে যদি শিক্ষার্থীরা টাকা পে-অর্ডার করে, তাহলে তাদের টাকাটা ফেরত দেওয়া উচিত। আমি এ বিষয়ে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের সঙ্গে কথা বলবো। যাতে কর্তৃপক্ষের ভুলের কারণে কোনো মার্কশিট সংশোধনের প্রয়োজন হলে এতে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে যেনো কোন টাকা না নেওয়া হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (মার্কশিট শাখা) মুহাম্মদ এমদাদ হোসেন বলেন, আমাদের কাছে প্রতিদিন ২৫টিরও বেশি মার্কশিট সংশোধনের আবেদন আসে। এসব মার্কশিটে ছাত্রদের ভুল কম। ইদানিং বেশি ভুল হচ্ছে রেজাল্টে। সিজিপিএ, রেজিস্ট্রেশন ফরম, হলের নাম, মার্কশিটে এই ভুলগুলোই হয় মূলত। তবে, ছাত্ররা সচেতন হলে মার্কশিট প্রকাশের তিনমাসের মধ্যে সংশোধনের আবেদন করলে টাকাটা লাগতো না।
তিনি আরও বলেন, এবছর যে কয়টা হলের নাম পরিবর্তন হয়েছে, সেসব হলে যারা অনার্স বা মাস্টার্সে অধ্যয়নরত আছেন তাদেরও মার্কশিট সংশোধন করে হলের নাম পরিবর্তন করতে হবে। নয়তো পরবর্তী জীবনে যেকোনো সমস্যায় পড়তে হতে পারে। বিশেষ করে দেশের বাইরে গেলে প্রশ্নবিদ্ধ হবে। কিন্তু প্রশাসন চাইলে নিজ উদ্যোগে এসব মার্কশিট সংশোধন করতে পারে। তাহলে শিক্ষার্থীদের টাকা এবং হয়রানি দুইটাই কমবে।
কর্তৃপক্ষের ভুলে শিক্ষার্থীদের ব্যাংকে টাকা পে-অর্ডার করে মার্কশিট সংশোধনির আবেদন করতে হচ্ছে কেনো— প্রশ্নের জবাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক ড. মো. এনায়েত উল্যা পাটওয়ারী বলেন, অফিসের ভুলে শিক্ষার্থীরা কেনো টাকা পে অর্ডার করবে? এটা উচিত না। বরং অফিসের বা ওই শিক্ষকের পে করা উচিত, যিনি এসব কাজের জন্য পেমেন্ট পেয়ে থাকেন। এখন থেকে কর্তৃপক্ষের ভুলে শিক্ষার্থীদের টাকা দিতে হবে না।
চবিতে মার্কশিট প্রকাশের পর তাতে কোনোপ্রকার ভুল-ভ্রান্তি থাকলে তিনমাসের মধ্যে বিনামূল্যে মার্কশিট সংশোধনির সুযোগ রয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ শিক্ষার্থী এই তথ্য না জানার কারণে তিনমাস সময় পেরিয়ে যায়। তাছাড়া, অনেকে কোনো প্রয়োজন ছাড়া মার্কশিট ভালো করে যাচাই-বাছাই করেন না। যার কারণে, অনেকটা সময় পর মার্কশিটের ভুল ধরা পড়ে।
শিক্ষার্থীদের সুবিধার্থে মার্কশিট প্রকাশের পর বিনামূল্যে মার্কশিট সংশোধনির তিন মাসের এই সময়সীমা বাতিল করা হবে কিনা জানতে চাইলে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক আরও বলেন, আমার মনে হয় এই সময়সীমাটাও থাকা উচিত না। এ বিষয়ে শিক্ষার্থীরা যদি দাবি জানায়, তাহলে আমরা ব্যবস্থা নিবো ইনশাআল্লাহ।
এ বিষয়ে চবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইয়াহইয়া আখতার বলেন, আমাদের অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সিস্টেমে অনেক জটিলতা রয়ে গেছে। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টাকা নেওয়া হচ্ছে, যেখানে তার কোনো দায় নেই। এটা খুবই লজ্জার ব্যাপার। কর্তৃপক্ষের ভুলে শিক্ষার্থীদের পে-অর্ডার করার নিয়ম পরিবর্তন করা উচিত। আমি পরীক্ষা নিয়ন্ত্রককে অনুরোধ করবো— এক্ষেত্রে তিনি যেনো শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কোনো ফি না নেন।
প্রতিনিধি/টিবি