চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে ঢুকতে আলাদা কার্ডের প্রয়োজন নেই। তবুও গত ১৬-১৭ বছরে কোনো ধরনের সেবা ছাড়াই গ্রন্থাগার কার্ড ফির নামে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শ্রেণির শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা অতিরিক্ত আদায় করেছে প্রশাসন।
এ নিয়ে সংবাদ প্রকাশের জেরে স্নাতক শিক্ষার্থীদের ভর্তির সময় তাদের থেকে ‘গ্রন্থাগার কার্ড ফি’ আদায় বন্ধ করলেও ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষ থেকে আরও ৫৫ টাকা বাড়িয়ে নতুন করে ‘গ্রন্থাগার ই-রিসোর্চ ও ইন্টারনেট’ ফি হিসেবে ১০০ টাকা নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এই খাতের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা নতুন কী সেবা পাচ্ছেন, তা নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন।
বিজ্ঞাপন
একদিকে, স্নাতক শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ৪৫ টাকা ‘গ্রন্থাগার কার্ড ফিস’ নেওয়া বন্ধ করে ১০০ টাকা ‘গ্রন্থাগার ই-রিসোর্চ ও ইন্টারনেট’ ফি নেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে, স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ‘গ্রন্থাগার ই-রিসোর্চ ও ইন্টারনেট’ ফি না নেওয়া হলেও তাদের কাছ থেকে ‘গ্রন্থাগার কার্ড ফিস’ হিসেবে আগের চেয়ে সোয়া ৭ গুণ তথা ২২০ টাকা করে ফিস নিচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে ভর্তি হওয়া কয়েকজন শিক্ষার্থীর ব্যাংক রশিদ পর্যালোচনা করে এমনই তথ্যের দেখা মিলেছে। এসব শিক্ষার্থীর চূড়ান্ত ভর্তির ব্যাংক রশিদের তথ্য বলছে, কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের কোনো বিভাগে চূড়ান্ত ভর্তি হতে প্রতি শিক্ষার্থীকে ১৪টি খাতে ৪৬১৫ টাকা করে জমা দিতে হয়েছে। যা ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীদের জন্য ছিল ৪৫৬০ টাকা। অর্থাৎ ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষ থেকে চূড়ান্ত ভর্তি ফি বাড়ানো হয়েছে আরও ৫৫ টাকা।
তবে, শুধু কলা ও মানববিদ্যা অনুষদ নয়, অন্য অনুষদগুলো তথা— বিজ্ঞান, সমাজ বিজ্ঞান, আইন, শিক্ষা, মেরিন সায়েন্স, জীববিজ্ঞান ও ইন্জিনিয়ারিং অনুষদের স্নাতকের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকেও ‘গ্রন্থাগার ই-রিসোর্চ ও ইন্টারনেট’ ফি হিসেবে ১০০ টাকা করে নেওয়া হচ্ছে।
রেজিস্ট্রার অফিসের তথ্য মতে, ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে স্নাতকে ভর্তি হয়েছেন প্রায় সাড়ে ৪ হাজার শিক্ষার্থী। অর্থাৎ এই শিক্ষাবর্ষে ‘গ্রন্থাগার ই-রিসোর্চ ও ইন্টারনেট’ ফির নামে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে প্রায় সাড়ে ৪ লাখ টাকা। সে হিসেবে এর আগের শিক্ষাবর্ষের ‘গ্রন্থাগার কার্ড ফি’র তুলনায় চলমান শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীদের থেকে ‘গ্রন্থাগার ই-রিসোর্চ ও ইন্টারনেট’ ফির নামে প্রশাসন অতিরিক্ত প্রায় আড়াই লাখ টাকা আদায় করেছে।
বিজ্ঞাপন
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের স্নাতক শ্রেণির শিক্ষার্থী মোহাম্মদুল্লাহ বলেন, ‘ডিজিটাল যুগে এসে অন্তত ইন্টারনেট ফ্রি করে দেওয়া উচিত। অথচ, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নতুন করে ‘ইন্টারনেট’ ফি নিচ্ছে। তাছাড়া, সেবা নিশ্চিত না করেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ‘ই-রিসোর্চ’ ফিও আদায় করছে। প্রশাসনকে নতুন নতুন খাত তৈরি করে এসব ফি নেওয়া বন্ধ করতে হবে।’
ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের স্নাতকের শিক্ষার্থী মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘প্রশাসন এতোদিন লাইব্রেরি কার্ড নামে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা নিয়েছে। অথচ, সেবা দেওয়া হয়নি। তাছাড়া, যেখানে এতো বছর গ্রন্থাগার ই-রিসোর্চ ও ইন্টারনেট ফি নেয়নি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, সেখানে আজ হঠাৎ করে এই ফি যুক্ত করা অন্যায্য। আমরা প্রশাসনের কাছে এই ফি বাতিলের জন্য জোর আবেদন জানাচ্ছি।’
অন্যদিকে, ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে চবির স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ‘গ্রন্থাগার কার্ড ফি’ নামে ২২০ টাকা করে নিচ্ছে কর্তৃপক্ষ। রেজিস্ট্রার অফিসের তথ্যমতে, ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে চবির স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছেন প্রায় ৪ হাজার শিক্ষার্থী। অর্থাৎ গত এক বছরে ‘গ্রন্থাগার কার্ড ফি’র নামে তাদের কাছ থেকে প্রায় পৌনে ৯ লাখ টাকা আদায় করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
তবে, শিক্ষার্থীরা বলছেন, স্টুডেন্ট আইডি কার্ড দিয়ে গ্রন্থাগার ঢুকতে পারলে কার্ডের দরকার নেই। অথচ গত ১৬-১৭ বছর ধরে প্রশাসন তাদের কাছ থেকে এই ফি নিচ্ছে। তাছাড়া, অনার্সের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ‘গ্রন্থাগার কার্ড ফিস’ নেওয়া বন্ধ করে ‘গ্রন্থাগার ই-রিসোর্চ ও ইন্টারনেট’ ফির নামে টাকা বাড়ানো হয়েছে আরও ৫৫ টাকা। মাস্টার্সে ‘গ্রন্থাগার ই-রিসোর্চ ও ইন্টারনেট’ ফি নেওয়া না হলেও ‘গ্রন্থাগার কার্ড ফি বাড়ানো হয়েছে অন্তত সোয়া সাত গুণ। সেবা নিশ্চিত না করা পর্যন্ত যা সম্পূর্ণ অন্যায়।
আরবি বিভাগের স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থী মুহিবুর রহমান বলেন, কর্তৃপক্ষ কেন লাইব্রেরি কার্ড ফির নামে টাকা দিবে? আমাদেরকে তো কোনো লাইব্রেরি কার্ড দেয়নি। তাহলে টাকা নিলো কেন প্রশাসন? তা-ও গতবছরের চেয়ে প্রায় সাত গুণ বেশি। গতবছর মাস্টার্সের শিক্ষার্থীদের জন্য লাইব্রেরি কার্ড ফি ছিল ৩৫ টাকা। এবছর তা করা হয়েছে ২২০ টাকা। যেখানে লাইব্রেরি কার্ডই দেওয়া হয় না, সেখানে প্রশাসন কিসের ভিত্তিতে মাস্টার্সের শিক্ষার্থীদের জন্য লাইব্রেরি কার্ড ফি বাড়ালো, আমরা এর সুষ্ঠু জবাব চাই প্রশাসনের কাছে।
বাংলা বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী দেলোয়ার হোসেন বলেন, যে ফি দিয়ে আমরা কোনো সেবাই পাচ্ছি না, সে ফি কর্তৃপক্ষ কেনো নিবে? এই অতিরিক্ত টাকা আদায় অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। তাছাড়া, এতো বছর শিক্ষার্থীরা ইন্টারনেট ও কম্পিউটার ব্যবহার করলেও এর জন্য কোনো ফি নেওয়া হয়নি। কিন্ত এবছর থেকে নতুন করে এই ফি কেনো নেওয়া হচ্ছে? এ বিষয়ে সুস্পষ্ট বর্ণনা চাই আমরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের একজন কর্মকর্তা জানান, শিক্ষার্থীরা স্টুডেন্ট আইডি কার্ড নিয়ে আসলে আমরা বই দিচ্ছি পড়ার জন্য। গ্রন্থাগার কার্ডের প্রয়োজন হয় না। তবে, ১৫-১৬ বছর আগে গ্রন্থাগার কার্ডের প্রচলন ছিল। এখন আর গ্রন্থাগার কার্ডের প্রচলন নাই।
স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের ব্যাংক রশিদে ‘গ্রন্থাগার ই-রিসোর্চ অ্যান্ড ইন্টারনেট’ ফি হিসেবে নতুন খাত যুক্ত হয়েছে কেনো, জিজ্ঞেস করা হলে ভারপ্রাপ্ত হিসাব নিয়ামক মো. আমিরুল ইসলাম বলেন, আমাদের লাইব্রেরি অনেকটা ডিজিটালাইজড। যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে ওখানে আমাদের বছরে প্রায় এক-দেড় কোটি টাকা খরচ হয়। এজন্যই ‘গ্রন্থাগার ই-রিসোর্চ ও ইন্টারনেট ফি’ বাবদ ১০০ টাকা করে নেওয়া হচ্ছে।
এতদিন ধরে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ‘গ্রন্থাগার কার্ড ফি’র নামে আদায় করা লাখ লাখ টাকা কোন খাতে ব্যয় করা হয়েছে প্রশ্ন করলে সুস্পষ্ট কোনো উত্তর দিতে পারেননি চবির এই ভারপ্রাপ্ত হিসাব নিয়ামক। তিনি বলেন, টাকাগুলো শিক্ষার্থীদের সামগ্রিক খাতে ব্যয় হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারিক অধ্যাপক ড. মো. আলমগীরের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি যতোটুকু জানি, ‘গ্রন্থাগার কার্ড ফি’র খাতটাই কনভার্ট করে দেওয়া হয়েছে ‘গ্রন্থাগার ই-রিসোর্চ ও ইন্টারনেট ফি’র নামে। গ্রন্থাগারের অনেক খরচ। ইউজিসির মাধ্যমে প্রতিবছর ই-রিসোর্চ কিনতে হচ্ছে। এতে খরচ হচ্ছে প্রায় ৩০ লাখ টাকা। এছাড়া আরেক সংস্থা থেকে আরও ১০ লাখ টাকার মতো ই-বুক, ই-জার্নাল কিনি আমরা।
তিনি আরও বলেন, শিক্ষার্থীরা সেবা পাচ্ছে না, বিষয়টা এমন না। আসলে আমরা শিক্ষার্থীদের জন্য অবারিত সুযোগ রেখেছি। সে চাইলে একদম ফ্রি-তে একটা বিদেশি বই ডাউনলোড করে পড়তে পারছেন। আমাদের যেকোন শিক্ষার্থী এই ই-রিসোর্চগুলো ব্যবহার করতে পারবেন, যেকোন বই ডাউনলোড দিতে পারবেন, বিশ্বের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বই আমরা কিনে আমাদের ই-রিসোর্চে রাখার চেষ্টা করছি। এগুলো আবার মেইনটেনেন্সেরও ব্যাপার আছে আবার। সবকিছু মিলিয়ে এ খাতে খরচ অনেক বেশি।
এ বিষয়ে গ্রন্থাগার কমিটির সভাপতি ও উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান বলেন, লাইব্রেরিকে প্রতি বছর ই-বুক, ই-জার্নাল, ই-ম্যাগাজিন ইত্যাদি কিনতে অনেক বড় একটা খরচ করতে হয়। যা প্রতিবছর রিনিউ করতে হয়, মেইনটেইন করতে হয়। এছাড়া, ইন্টারনেটের ব্যবহারও বাড়ছে, আমরা আমাদের দুষ্প্রাপ্য বইগুলো স্ক্যান করে ডিজিটালাইজ করার চেষ্টা করছি। সেজন্যই মূলত শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে এই ফি-টা নেওয়া হচ্ছে। তাছাড়া, মাস্টার্সের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে গ্রন্থাগার কার্ড ফি আদায়ের বিষয়ে আমরা আলোচনা করবো।
প্রতিনিধি/টিবি