উদ্বোধন হয়েছে টাঙ্গাইলে যমুনা নদীর ওপর দেশের সর্ববৃহৎ বহুল প্রতিক্ষিত দুই লাইনের রেলসেতু। প্রতি ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১২০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন ৪.৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই সেতু অতিক্রম করতে পারবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই সেতুর ফলে ঢাকার সঙ্গে রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের মধ্যে রেলযাত্রার সময় হ্রাস হবে ৩০ মিনিটেরও বেশি।
মঙ্গলবার (১৮ মার্চ) দুপুর ১২টার দিকে টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরে যমুনা রেল সেতু পূর্ব প্রান্তের ইব্রাহিমাবাদ রেল স্টেশন নতুন সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
বিজ্ঞাপন
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে সেতু উদ্বোধন করেন রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ফাহিমুল ইসলাম। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূত মি. সাইদা সিনিচি এবং জাইকার দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক মহাপরিচালক মি. ইতো তেরুয়েকি।
এদিন উদ্বোধনী ট্রেনটি ১২০ কিলোমিটার গতিতে সেতু পার হয়। ৪.৮ কিলোমিটার মূল সেতু পার হতে ৩ মিনিট ২১ সেকেন্ড সময় লাগে।
হুইসেল বাজিয়ে অতিথি, যাত্রী ও সংশ্লিষ্টদের নিয়ে বেলা ১২টা ৬ মিনিটে উদ্বোধনী ট্রেনের হুইসেল দেওয়া হয়। বেলা ১২টা ৯ মিনিটে ট্রেনটি সিরাজগঞ্জ পশ্চিম প্রান্তের সয়দাবাদ রেল স্টেশনের উদ্দেশে যাত্রা করে। পরে বেলা ১২টা ১৯ মিনিটের দিকে সায়দাবাদ রেলস্টেশনে পৌঁছে ট্রেনটি।
বিজ্ঞাপন
ইতোপূর্বে ট্রেন যমুনা সেতুতে লাগানো রেল লাইন হয়ে চলাচল করেছে। যমুনা সেতু মূলত সড়ক যোগাযোগের উদ্দেশ্যে নির্মিত হওয়ায় দ্রুত গতির ট্রেন চলাচলের জন্য অনুপযোগী। একারণে সেতু পারাপারে ট্রেন অত্যন্ত ধীর গতিতে চলেছে। ফলে ঢাকার সঙ্গে রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের মধ্যে রেলযাত্রায় অনেক বেশী সময় লেগেছে। যমুনা রেলসেতু চালু হওয়ায় ট্রেন প্রতি ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১২০ কিলোমিটার গতিতে সেতু অতিক্রম করতে পারবে। ফলে যাতায়াতের সময় কমে আসবে অন্তত ৩০ মিনিট কমে আসবে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সমান্তরাল ডুয়েল গেজ ডাবল ট্র্যাকের এ সেতুর প্রতিটি স্প্যানের ওপর জাপানিদের অত্যাধুনিক প্রযুক্তির রেললাইন বসানো হয়েছে।
বাংলাদেশ রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অবকাঠামো) এবং যমুনা রেলওয়ে সেতু প্রকল্পের পরিচালক আল ফাত্তাহ মো. মাসউদুর রহমান বলেন, আগে যমুনা সেতু দিয়ে যেখানে ২০-২৫ মিনিট লেগেছে। সেখানে নতুন যমুনা রেল সেতু দিয়ে মাত্র আড়াই থেকে ৩ মিনিট সময় লাগবে সেতু পার হতে। ৪.৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের যমুনা রেল সেতু দিয়ে সর্বোচ্চ ১২০ কিমি বেগে দুটি ট্রেন পাশাপাশি চলাচল করবে। দুই প্রান্তের সিঙ্গেল ট্র্যাকের কারণে যমুনা রেল সেতুর পুরোপুরি সুবিধা পেতে দেরি হলেও সেতুটি নির্মাণের ফলে উত্তর ও পশ্চিম অঞ্চলের মানুষের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হবে।
জাপান ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথ অর্থায়নে ৪.৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এ প্রকল্পটির ব্যয় ১৬ হাজার ৭৮০ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে ২৭ দশমিক ৬০ শতাংশ অর্থায়ন এসেছে দেশীয় উৎস থেকে এবং ৭২ দশমিক ৪০ শতাংশ ঋণ দিয়েছে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি-জাইকা।
যমুনা রেল সেতু উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে রাজধানী ঢাকার সঙ্গে ময়মনসিংহসহ উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের খুলনা, রাজশাহী এবং রংপুর বিভাগের প্রায় অর্ধশত জেলায় রেল যোগাযোগ ব্যবস্থায় নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন হলো। একই সঙ্গে মানুষের ভাগ্য বদলের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। এছাড়া ভারত, মিয়ানমার ও ভূ-বেষ্টিত নেপাল, ভূটানসহ এ অঞ্চলের ট্রানশিপমেন্ট কেন্দ্র ও ট্রান্সপোর্ট হাব হিসেবে গড়ে ওঠার বিশাল সম্ভাবনা তৈরি হলো বাংলাদেশের। ফলে এই রেল সেতুটি জাতীয়, আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক যোগাযোগ নেটওয়ার্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
১৯৯৮ সালের ২৩ জুন যমুনা বহুমুখী সেতু চালু হওয়ার পর ঢাকার সঙ্গে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রেল যোগাযোগ স্থাপিত হয়। সেতুটি চালু হওয়ার প্রায় ১০ বছর পর ২০০৮ সালে সেতুটিতে ফাটল দেখা দেওয়ায় ট্রেনের গতি কমিয়ে দেওয়া হয়। সেতুটি দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ৩৮টি ট্রেন পারাপার হতো। এই সমস্যার সমাধানে সরকার যমুনা নদীর ওপর আলাদা রেল সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয়।
২০২০ সালের ২৯ নভেম্বর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভার্চুয়ালি এই সেতুর নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০২১ সালের মার্চে পিলার নির্মাণের জন্য পাইলিং কাজ শুরু হয়। ৪.৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই রেল সেতু দেশের দীর্ঘতম প্রথম ডাবল ট্রাকের ডুয়েল গেজের সেতু। এটি ৫০টি পিলারের ওপর ৪৯টি স্প্যানে নির্মিত হয়েছে।
ইএ