রোববার, ১৩ এপ্রিল, ২০২৫, ঢাকা

হারিয়ে গেছে ‘বানাই’ ও 'ডালু' জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষা 

জেলা প্রতিনিধি, শেরপুর
প্রকাশিত: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৯:৫১ এএম

শেয়ার করুন:

হারিয়ে গেছে ‘বানাই’ ও 'ডালু' জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষা 
শেরপুরের ৩৫ শতাংশ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিক্ষার্থী এখনও স্কুলের বাইরে রয়েছে

নাকুগাঁও স্থলবন্দরের পাশে বাস করেন দুইশতাধিক 'ডালু' সম্প্রদায়ের মানুষ। এখন সবসময় বাংলা ভাষায় কথা বললেও এক সময় তাদের ছিল নিজস্ব ‘ডালু’ ভাষা ও সমৃদ্ধ সংস্কৃতি। এ সম্প্রদায়ের সবাই একসময় নিজস্ব ভাষাতেই কথা বলত। ঘরে-বাইরে সবখানেই চলত এ ভাষা। কিন্তু সময় পরিক্রমায় ধীরে ধীরে তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি হারিয়ে গেছে। চর্চার অভাবে নতুন প্রজন্ম এ ভাষার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। তারা ভুলে গেছে নিজেদের ভাষা ও সমৃদ্ধ সংস্কৃতি। 

ডালু ভাষা জানা সর্বশেষ লোকটি ২০২০ সালে করোনাকালীন সময়ে মারা গেছেন। এখন আর কেউ ভাষাটি জানে না। করা হয়নি ভাষাটির সংরক্ষণ। একইভাবে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তঘেঁষা নিভৃত এক পল্লি বানাইপাড়া। শেরপুরের ঝিনাইগাতীর কাংশা ইউনিয়নের এ পল্লিতে বাস করে পাহাড়িয়া বানাই সম্প্রদায়ের দেড় শতাধিক মানুষ। কিন্তু স্বাধীনতার পরপরই এ ভাষাটি ধীরে ধীরে হারাতে বসে। এখন আর কেউ 'বানাই' ভাষা জানেন না। তাই এ দু’টি ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষায় সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সহযোগিতা চান এ দুই জাতিসত্তার নেতা ও ভাষা নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো।


বিজ্ঞাপন


আরও পড়ুন: হারিয়ে যাচ্ছে আঞ্চলিক ভাষা

বেসরকারি সংস্থা আইইডির আদিবাসী সক্ষমতা উন্নয়ন প্রকল্পের তথ্যমতে, জেলায় গারো ডালু এক হাজার ৫০০ এবং বানাই জাতিগোষ্ঠীর ১৫০ জন মানুষ র‌য়ে‌ছেন।

এদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর একটি গবেষণা বলছে, শেরপুরের ৩৫ শতাংশ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিক্ষার্থী এখনও স্কুলের বাইরে রয়েছে। উচ্চশিক্ষিত মাত্র তিন শতাংশ। ফলে অনেকেই ভাষার সঙ্গে নিজেদের শিকড় হারিয়ে ফেলছে।

বানাইপাড়ার বাসিন্দা রুমেণ দেব বলেন, ‘আমগোরে (আমাদের) বানাই ভাষা দিন দিন হারাই গেছে গা। এখন পোলাপান (ছেলে-মেয়ে) শুধু বাংলায় বলে আর বাংলায় বলে। বানাই ভাষা কেউ কইতে (বলতে) পারে না। আগে সবাই এ ভাষাতে কথা কইত। আমগোরে নাই নাতিরা (ভবিষ্যৎ প্রজন্ম) হয়ত জানতেই পারবে না বানাই সম্প্রদায়ের নিজস্ব কোনো ভাষা ছিল, নিজস্ব অনেক আচার-অনুষ্ঠান ছিল। আমাগোর ভাষাটা ধরে রাখার দাবি জানাচ্ছি।’


বিজ্ঞাপন


একই এলাকার কৃষি উদ্যোক্তা শুভেন্দ্র কুমার বলেন, আমার নানির কাছ থেকে শুনেছি যে আমাদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি ছিল। কিন্তু আমরা সে ভাষা শিখতে পারিনি। আমার আম্মাও বানাই ভাষা পারে না। আমাদের গ্রামের কেউ পারে না ভাষাটি। ঘরে-বাইরে, হাট-বাজার, স্কুল-কলেজ সব জায়গায় বাংলা ব্যবহার করি। ফলে বানাই ভাষা শেখার জায়গাটাও নেই। আমাদের নিজস্ব ভাষা রক্ষা করা দরকার। এজন্য সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগের দাবি করছি।

বানাই গোষ্ঠীর নেতা প্রদীপ মারাক ঢাকা মেইলকে বলেন, নিত্যকার প্রয়োজন কম হওয়ায় গুরুত্ব হারিয়ে আধুনিকতার দাপটে ভাষাটি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বানাই ভাষার নিজস্ব বর্ণমালা না থাকায় বর্তমান প্রজন্মও নিজস্ব ভাষার প্রতি আগ্রহ হারিয়েছে। চর্চা করার ব্যবস্থা না থাকায় তারাও বাংলা ভাষায় পড়াশোনা করে, কাজ-কর্মসহ সব জায়গায় বাংলা ব্যবহার করে। এখন ভাষাটি খুঁজে বের করে সংরক্ষণ করা জরুরি, তা নাহলে একসময় বানাই ভাষা কেবল একটি শব্দের নাম হবে। 

আরও পড়ুন: ঠাকুরগাঁওয়ে মাতৃভাষা দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ

গারো পাহাড়ে ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করছে বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা ও এনজিও সৃষ্টি হিউম্যান রাইটস সোসাইটি। সংস্থার ভাষা নিয়ে কাজ করা কাঞ্চন মিস্টার মারাক ঢাকা মেইলকে বলেন, গারো পাহাড়ি বানাই সম্প্রদায়ের একসময় নিজস্ব ভাষা ও সাংস্কৃতিক আচার-অনুষ্ঠান ছিল। একইভাবে ডালু সম্প্রদায়ের ছিল নিজস্ব আচার অনুষ্ঠান ও ভাষা। কিন্তু নিজস্ব ভাষার সব জায়গায় ব্যবহার না থাকায় প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম দিন দিন ভাষা ভুলতে থাকে। একপর্যায়ে এ দুই জাতিসত্তার সবাই নিজস্ব ভাষা ভুলে গেছে। হারিয়ে ফেলেছে নিজস্ব সংস্কৃতিও। নিজস্ব ভাষা ভুলে প্রচলিত বাংলা ভাষাতেই কথাবার্তা বলে সবক্ষেত্রে। এছাড়া এ অঞ্চলের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ভাষা চর্চার ব্যবস্থা করা হলে নতুন প্রজন্ম ভাষার প্রতি আকৃষ্ট হবে। আমরা এ অঞ্চলের হারানো ভাষাগুলো নিয়ে কাজ করছি। 

শিক্ষক সঙ্কটের ব্যাপারে জানতে চাইলে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. ওবায়দুল্লাহ ঢাকা মেইলকে বলেন, কয়েকটি ভাষায় প্রাথমিকের বই থাকলেও শিক্ষক স্বল্পতায় সঠিকভাবে সবাইকে পাঠদান করানো সম্ভব হচ্ছে না। ইতোমধ্যে আমরা কিছু শিক্ষকদের ভাষা প্রশিক্ষণ দিয়েছি। বাকিদের প্রশিক্ষণের ব্যাপারে আলোচনা চলছে। আশা করছি, বাকি শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ সম্পূর্ণ হলে তাদের ভাষাতে পাঠ্যপুস্তকগুলো পড়াতে পারবেন।

শেরপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক হাফিজা জেসমিন ঢাকা মেইলকে বলেন, পর্যটনের জেলা শেরপুরকে আরও বেশি আকৃষ্ট করেছে বিভিন্ন নৃগোষ্ঠী। তাদের নিজস্ব আচার-অনুষ্ঠান, ভাষা রীতি, খাদ্যাভ্যাস, লাইফস্টাইল রয়েছে। শেরপুর জেলা প্রশাসন সবসময় এসব নৃগোষ্ঠীদের জীবনমান উন্নয়ন এবং ভাষা সংস্কৃতি রক্ষায় বদ্ধপরিকর। তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষায় জেলা প্রশাসনের বেশ কিছু পরিকল্পনা রয়েছে, সেগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করা হবে।  

প্রতিনিধি/ এমইউ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর