মৌসুমের অন্তত দুই মাস আগে জয়পুরহাটের মাঠে মাঠে আলু উত্তোলন করছে কৃষকরা। আবহাওয়া অনুকূল থাকায় ফলন ভাল হয়েছে। কিন্তু দাম কম হওয়ায় চিন্তিত চাষীরা। অনেকে আলু উত্তোলনের সময় হওয়ার পরেও বন্ধ রেখেছে। লাভের আশায় আলু রোপণ করে উলটো বেকায়দায় পড়েছে চাষীরা। লাভ তো দূরের কথা, খরচের টাকাই উঠছে না। লোকসানে পড়ে কৃষকের চোখে-মুখে কষ্টের ছাপ। এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামীতে আগাম জাতের আলুর চাষ কমে যাবে বলে ধারণা করছে কৃষকরা।
চাষিরা জানান, গত বছরের তুলনায় এবার আলু চাষে অনেক বেশি খরচ পড়েছে। এ বছর আলুর ফলন বেড়েছে কিন্তু বিক্রি করে লোকসান গুনতে হচ্ছে। একসপ্তাহ আগে যারা বিক্রি করেছেন তারা অল্প হলেও লাভের মুখ দেখেছেন কিন্তু বর্তমানে লোকসান হচ্ছে। প্রতিদিন আলুর দাম কমে যাওয়ায় অনেকেই আলুর বয়স হওয়ার পরও উত্তোলন বন্ধ রেখেছেন। চাষাবাদ, সার, বীজ, কীটনাশক, সেচ ও শ্রমসহ সব খরচ বাদ দিয়ে এবার লোকসান গুনতে হচ্ছে। গত সপ্তাহে বিভিন্ন জাতের আলু প্রতিমণ (৪০ কেজি) ১৪’শ থেকে ১৬’শ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে।
বিজ্ঞাপন
সেই আলু সোমবার বিক্রি হয়েছে ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকায়। প্রথমদিকে দাম বেশি ছিল কিন্তু ফলন কম হয়েছে। এখন দাম কমেছে কিন্তু ফলন বেশি হচ্ছে। গড়ে সমানই ধরা যায়। এভাবে দাম কমতে থাকলে আগামী সপ্তাহে যারা আলু তুলবেন তারা মোটা অঙ্কের লোকসান গুনবেন বলে ধারণা করছেন চাষীরা।
সোমবার মাঠে গিয়ে দেখা যায়, ক্ষেতলালের গোপিনাথপুর, কালাইয়ের হারুঞ্জা ও বেগুনগ্রাম মাঠে মহিলা শ্রমিক নিয়ে আগাম জাতের আলু তুলতে ব্যস্ত সময় পার করছেন চাষীরা। এসব মাঠে সাদা সেভেন, বার-তের, ক্যারেজ, রোমানা পাকরি, লাল পাকরি ও কার্ডিনাল জাতের আলু তুলছেন। পুরুষ শ্রমিকরা সেই আলু জমি থেকে রাস্তার পাশে বিক্রির জন্য নিয়ে আসছেন। পাইকাররা দরদাম করে আলু ট্রাকে করে মহাজনদের ঘরে নিয়ে যাচ্ছেন। এতে করে লাভ করছেন ব্যবসায়ীরা মাঝে মোটা অঙ্কের লোকসান গুনছেন চাষীরা।
বিজ্ঞাপন
৩৩ শতক জমিতে আগাম জাতের ক্যারেজ আলু চাষ করেছেন পশ্চিম রামচন্দ্রপুর গ্রামের কৃষক এনামুল হক। তিনি বলেন, রোপণের ৬৫ দিন বয়সে আলু তুলেছি। ফলন হয়েছে ৭০ মণ। সব মিলে খরচ হয়েছে ৬০ হাজার টাকা। ৭১০ টাকা মণ দরে আলু বিক্রি করেছি ৪৯ হাজার ৭০০ টাকা। নিজের শ্রম তো আছেই। লোকসান হয়েছে ১০ হাজার ৩০০ টাকা। মাঠে আরও আলু আছে, সেগুলোও তুলতে হবে। দাম যেভাবে কমে যাচ্ছে তাতে ভয় পিছু ছাড়ছে না।
হারুঞ্জা মাঠের কৃষক আলমগীর হোসেন বলেন, আলু রোপণ থেকে শুরু করে নিড়ানি, বাঁধানোসহ যাবতীয় কাজ পরিবারের লোকজন মিলে করেছি। তাই অন্যের থেকে বিঘাপ্রতি ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা খরচ কম হয়েছে। এক একর জমির আলু তুলেছি। ফলন হয়েছে ১৯৫ মণ। ৭২০ টাকা মণ দরে বিক্রি করে অনেক লোকসান হয়েছে।
কৃষক সামছুল আলম বলেন, ১২০ টাকা কেজি দরে বীজআলু ও বেশি দামে সার কিনে আলু রোপণ করেছি, অথচ আলু তুলে ১৮ টাকা কেজি দরে বিক্রি করতে হচ্ছে। উৎপাদন খরচই পড়েছে ১৯-২০ টাকা কেজি।
আরেক কৃষক দুলাল মিয়া বলেন, আমার ১৮ বিঘা কার্ডিনাল আলু তুলার সময় হয়েছে। প্রতিদিন দাম কমে যাওয়ার কারণে তুলছি না। আবার বয়স বেশি হলে জমিতেই আলু ফেটে নষ্ট হবে। এই মুহূর্তে কি করবো মাথায় খেলছে না।
কালাই বাজারে কথা হয় দুরুঞ্জ গ্রামের বেলালের সাথে। তিনি বলেন, গত হাটে এক কেজি ক্যারেজ আলু কিনেছি ৬০ টাকায়। আজ সেই আলু কিনলাম ২২ টাকায়। এক সপ্তাহের ব্যবধানে যদি আলুর বাজার এভাবে ধস নামে, তাহলে আরও দিনত পড়েই আছে। আলু নিয়ে এবার কৃষকরা বড় বিপদে পড়েছে।
আলু ব্যবসায়ী সাইদুর রহমান বলেন, আগাম জাতের আলু বিভিন্ন মোকামে সরবরাহ করা হচ্ছে। কাঁচা মালের মূল্য সঠিকভাবে বলা যায় না। আমদানির ওপর দাম ওঠা-নামা করে। বর্তমানে আলুর আমদানি বেশি, তাই দাম কম। পাইকারি বাজারে ১৭ থেকে ১৮ টাকা কেজি দরে আলু ক্রয় করছি। খরচ বাদ দিয়ে প্রতি কেজিতে ৫০ পয়সা থেকে ১ টাকা লাভ হয়।
কালাই পৌর বাজারে খুচরা ব্যবসায়ী অশোক কুমার বলেন, বাজারে বিভিন্ন জাতের নতুন আলু উঠেছে। পাইকারি বাজারে দাম কম হওয়ায় খুচরা বাজারেও কম। জাত ভেদে ২০ থেকে ২২ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রি হচ্ছে। জিনিসপত্রের দাম বাড়লে লাভ বেশি হয়, আর দাম কমলে লাভ কম হয়।
কৃষি বিভাগ জানান, এবার জয়পুরহাটে ৪০ হাজার হেক্টর জমিতে বিভিন্ন জাতের আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রাকে ছাড়িয়ে চাষ হয়েছে ৪৩ হাজার ৫০০ হেক্টর। গত বছরের তুলনায় এবার ৪ হাজার ৬৫০ হেক্টর জমিতে বেশি আলু রোপণ হয়েছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ৯ লাখ ৩১ হাজার ৫০০ মে.টন আলু আশা করা হচ্ছে। ১৯টি হিমাগারে প্রায় ২ লাখ মেট্রিক টনেরও বেশি আলু সংরক্ষণ হবে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মজিবুর রহমান বলেন, আসলে দাম নিয়ে আমাদের বলার কিছুই নেই। আগাম জাতের আলু যে দামে বিক্রি হচ্ছে মৌসুমে এই দাম থাকবে না। কারণ বাহিরের অনেক দেশ বাংলাদেশের আলু নেওয়ার জন্য ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। সবকিছু মিলে দেশে-বিদেশে এবার আলুর চাহিদা রয়েছে। কৃষকদের হতাশ হওয়ার কিছুই নেই।
প্রতিনিধি/ এজে