শীতকালের সঙ্গে জড়িয়ে আছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী সুস্বাদু খেজুর (ডেট পালম) রস। শীত যতই বাড়ে খেজুর রস ও গুড়ের চাহিদা ততই বৃদ্ধি পায়। গ্রামীণ জনপদের ঘরে ঘরে এই রস দিয়ে তৈরি হয় নানা ধরনের পিঠা ও পায়েস। গাছ থেকে কাঁচা রস সংগ্রহ করে আগুনে জ্বাল দিয়ে বানানো হয় বিভিন্ন ধরনের গুড়।
এক সময় গ্রামীণ জনপদে খেজুর গুড় ও রসের কদর ছিল খুব বেশি। বর্তমানে খেজুর রস তেমন পাওয়া যায় না। গ্রাম অঞ্চলে কিছুটা থাকলেও শহরে নেই বললেই চলে। বৈরী আবহাওয়ায় গাছের সংখ্যা কমে যাওয়া ও আধুনিকতার ছোঁয়ায় দিনদিন হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী খেজুর রস।
বিজ্ঞাপন
ঐতিহ্য ধরে রাখতে কক্সবাজার শহর থেকে মাত্র আড়াই কিলোমিটার দূরে খুরুশকুলের মনোপাড়ায় শখের বসে একজন ব্যক্তি গড়ে তুলেছেন খেজুর বাগান (ডেট পালম গার্ডেন)। সে বাগান থেকে দৈনিক ৯০০ থেকে ১ হাজার লিটার খেজুর রস সংগ্রহ করা হয়। আর এ রস জ্বাল দিয়ে তৈরি হয় সুস্বাদু গুড়।

এদিকে তীব্র শীত উপেক্ষা করে প্রতিদিন সকালে খেজুর রস খেতে ওই বাগানে ভিড় করেন শহরের স্থানীয় লোকজন ও পর্যটকরা। তারা খেজুর রস খাওয়ার পাশাপাশি ঘুরে দেখেন পুরো খেজুর বাগান। আর গাছের নিচে বসেই স্বাদ নেন কাঁচা খেজুর রস। অনেকে বোতল নিয়ে পার্সেল করে নিয়ে যায় পরিবারের জন্য।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, ভোর ৫টা থেকেই শুরু হয় ওই বাগানের কর্মব্যস্ততা। সকাল ৬টার আগেই গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে বিশেষ ধরনের ট্রেতে জ্বাল দেওয়া শুরু হয়। এরই মধ্যে মানুষের ভিড় জমতে থাকে। বিশেষ করে মোটরসাইকেল আরোহী তরুণরা বেশি ভিড় জমায়। সেইসঙ্গে অনেক পর্যটকদেরও দেখা যায়। সেখানে প্রতিদিন প্রায় ৩ শতাধিক লোকজনের ভিড় হয়। তারা বাগানে দাঁড়িয়েই গরম খেজুরের রস খায়। আবার অনেকে সিদ্ধ হওয়ার আগেই কাঁচা খেয়ে ফেলেন। বেশির ভাগ লোকজন খাওয়া শেষে প্লাস্টিক বোতলে করে বাড়িতে নিয়ে যায়। আবার অনেকে সুস্বাদু গুড় কিনে নেন। এসব ছাড়াও সেখানে আসা লোকজন পুরো বাগান ঘুরে বেড়ান। সেইসঙ্গে ছবি তোলা আর আড্ডা দিয়ে সময় পার করেন। খেজুর বাগানে রস ও গুড় কেনার ভিড় সকাল ৬টা থেকে ৯টার মধ্যে শেষ হয়ে যায়।
বিজ্ঞাপন
![]()
তথ্য অনুসন্ধানে জানা গেছে, শহরের কস্তুরাঘাট এলাকার বাসিন্দা ছালেহ আহম্মদ শখের বসে খুরুশকুল মনোপাড়ার এই খেজুর বাগান গড়ে তুলেন। তিনি বিভিন্ন দেশ থেকে বিচ সংগ্রহ করে ১৯৯৫ সালে প্রায় ৪৭ একর জায়গাজুড়ে খেজুর বাগান করেন। গত ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এসব খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করছেন তিনি। যেখানে প্রায় ৫ শতাধিক খেজুর গাছ রয়েছে। ওই বাগানে ১০ থেকে ১২ জন অভিজ্ঞ কারিগর কাজ করেন। তারা গাছ থেকে রস সংগ্রহের পর ওই রস জ্বালিয়ে ঘনত্ব বাড়িয়ে রাফ করা হয়। এরপর তা আরও জ্বাল দিয়ে বিভিন্ন ছাঁচে ঢেলে তৈরি হয় গুড়।
বাগান থেকে খেজুর রস কিনতে আসা ফাহমিদুল হান্নান জানান, বন্ধুরা মিলে মোটরসাইকেল নিয়ে খেজুর বাগানে রস খেতে এসেছি। পাশাপাশি শহরের পাশেই মনোরম গ্রামীণ পরিবেশে খেজুর বাগান দেখতে অসাধারণ লাগছে। এই মুহূর্তটা খুবই আনন্দের।
কক্সবাজারে বেড়াতে আসা পর্যটক সমির মল্লিক জানান, এখানে বেড়াতে আসার একদিন পরেই জানতে পারি এ খেজুর বাগান সর্ম্পকে। সত্যিই এই বাগান খুবই সুন্দর। ভোরে কুয়াশার মাঝে গাছের নিচে বসে খেজুর রস খাওয়ার মজা অন্য রকম অনুভূতি।

স্থানীয় বাসিন্দা ফয়েজ আহমেদ জানান, এই বাগানের মালিক একজন প্রকৃতি প্রেমী মানুষ। তার কারণে আজকে শহরের লোকজন বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম দেখতে পাচ্ছে এই খেজুর বাগান। এছাড়া তারা স্বাদ নিতে পারছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী খেজুর রস। পাশাপাশি এটি ভ্রমণ পিপাসুদের পছন্দের জায়গায় পরিণত হয়েছে।
বাগানের কর্মী ফরিদ হোসেন জানান, শীতের সময় অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত খেজুরের রস সংগ্রহ করা হয়। শীত যত বেশি বাড়বে, খেজুরের রস তত বেশি মিষ্টি হবে। সেই রসে গুড়ও ভালো হয়। শীত চলে গেলে এই রস টক হয়ে যায়। খেজুরের গাছ পরিচর্যা থেকে শুরু করে গুড় সংগ্রহ পর্যন্ত অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে কাজ করতে হয়।

খেজুর বাগানের কারিগর মান্নান উদ্দিন জানান, রস সংগ্রহের জন্য বিশেষ কৌশলে গাছ কাটতে হয়। প্রাথমিক অবস্থায় রস পাতলা থাকে। পরে জ্বাল দিয়ে ঘনত্ব বাড়ানো হয়। ঘনত্ব নির্দিষ্ট পরিমাণে পৌঁছালে রস লালচে বর্ণ ধারণ করে। এরপর আরও জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরির উপযোগী করে রস বিভিন্ন ছাঁচে ঢালা হয়। পরে সেই রস ঠান্ডা হয়ে সুস্বাদু গুড়ে পরিণত হয়।
বাগানমালিক সায়মন ছালেহ জানান, আমাদের মূল উদ্দেশ্য গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য ধরে রাখা। শুরুতে পরিবেশের কথা চিন্তা করে এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য রক্ষায় এই বাগান করা হয়। পরে বাণিজ্যিকভাবে রস আহরণ ও প্রক্রিয়াকরণে গুড় তৈরি হলে মানুষের ব্যাপক সাড়া পাওয়া যায়। এতেই আমাদের আনন্দ ও সার্থকতা।
প্রতিনিধি/এসএস

