মঙ্গলবার, ২২ অক্টোবর, ২০২৪, ঢাকা

এখনও জলাবদ্ধতায় সাতক্ষীরার লক্ষাধিক মানুষ

গাজী ফারহাদ, সাতক্ষীরা
প্রকাশিত: ২২ অক্টোবর ২০২৪, ০৭:২০ পিএম

শেয়ার করুন:

এখনও জলাবদ্ধতায় সাতক্ষীরার লক্ষাধিক মানুষ

ভয়াবহ জলাবদ্ধতার কবলে পড়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে সাতক্ষীরা পৌরসভার নিম্মাঞ্চলসহ সদর উপজেলার বেশ কয়েকটি ইউনিয়নের লক্ষাধিক মানুষ।

সামান্য বৃষ্টিতেই তলিয়ে যাচ্ছে এসব এলাকার রাস্তা-ঘাটসহ বসতবাড়ি। অপরিকল্পিতভাবে বাড়ি-ঘর নির্মাণ, ইচ্ছামত বেড়িবাঁধ দিয়ে মাছচাষ, পৌরসভার ভেতর পর্যাপ্ত ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকা, প্রাণ সায়ের খাল ভরাটসহ অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার কারণে বিস্তীর্ণ অঞ্চল এখনও পানির মধ্যে রয়েছে।


বিজ্ঞাপন


ফলে জলাবদ্ধতার কারণে দিনের পর দিন সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাচ্ছে পৌরসভার নিম্মাঞ্চলসহ বেতনা নদীর তীরবর্তী এলাকার মানুষ।

আরও পড়ুন

ড্রামের ভেলাই তাদের ভরসা 

বর্তমানে বৃষ্টি থামলেও পানি নিষ্কাশনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় সাতক্ষীরা পৌরসভার ৯টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৭টি ওয়ার্ডের নিম্মাঞ্চলের মানুষ জলাবদ্ধতার কারণে নাকাল হয়ে পড়েছে। বর্ষা মৌসুম আসলেই জেলা শহরের নিম্মাঞ্চলসহ আশপাশের বেশ কয়েকটি ইউনিয়নের মানুষদের পড়তে হয় চরম দুর্ভোগে।

দ্রুত পানি নিষ্কাশনের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নিলে এসব এলাকার সহস্রাধিক মানুষ ভিটেহারা হতে পারে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।


বিজ্ঞাপন


খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাতক্ষীরা শহরের ইটাগাছা, কামালনগর, খড়িবিলা, মধুমাল্লারডাঙ্গি, মুনজিতপুরের রথখোলার বিল, রাজারবাগান, মুন্সিপাড়া, পলাশপোল, কামালনগর, মাঠপাড়া, মাগুরা, পুরাতন সাতক্ষীরার বদ্দিপুর কলোনীসহ আশপাশের এলাকা জলাবদ্ধতার কারণে বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।

rain

এ ছাড়া সদর উপজেলার মাগুরা, বিনেরপোতা, গোপিনাথপুর, গোবিন্দপুর, মাছখোলা, ঝাউডাঙ্গা, বল্লী, লাবসা, ব্রক্ষ্ররাজপুর, ধুলিহর ইউনিয়নের নিম্মাঞ্চলের অধিকাংশ স্থান এখনও কোমর পানিতে ডুবে আছে।

সাতক্ষীরা শহরের শেখ নুরল হুদা জানান, শহরের মাঝ দিয়ে প্রবাহিত প্রাণসায়ের খাল। এই খালের এক প্রান্তে বেতনা নদী এবং অপর প্রান্তে মরিচ্চাপ নদী। কিন্তু এই নদী দুটি পলি জমে ভরাট হয়ে যাওয়ায় প্রাণ সায়ের খাল দিয়ে আর আগের মতো পানি নিষ্কাশন হচ্ছে না। খালটি খনন করা হলেও পরিকল্পনা মাফিক কাজ না করায় সেটি খুব একটা কাজে আসছে না। ফলে গ্রামের পর গ্রাম সৃষ্ট হয়েছে জলবদ্ধতা। গত ৭ থেকে ৮ বছর ধরে বর্ষা মৌসুমের শুরু থেকে প্রায় ৩ মাস এসব এলাকা পানিতে ডুবে থাকে। এতে মানুষের অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হয়। অনেকের রান্না-খাওয়ার জায়গা নেই। পৌরসভার প্রায় ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। টানা কয়েকদিনের বৃষ্টিপাতে শহরের নিচু এলাকা প্লাবিত হওয়ায় মানুষের কষ্টের শেষ নেই। পৌর সভার অনেক স্থানে রাস্তার ওপর দুই থেকে তিনফুট পানি। পানি নিষ্কাশন না হওয়ায় বাড়িঘর বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ায় অনেকে তাদের সহায় সম্বল নিয়ে অন্যত্র গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে।

স্কুল ছাত্রী মাইশা তামান্ন বলেন, রাস্তা ওপরে হাটু পানি হওয়ায় ভ্যান রিকশা চালাচল করে না। দীর্ঘ দেড় মাস পানিবন্দী হয়ে আছি। স্কুলে যাওয়ার সময় ভেজা কাপড়ে স্কুলে যেতে হয়। এতে করে আমাদের লেখা পড়া মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।

পৌরসভার কুলিন পাড়ার নজরুল ইসলাম জানান, গত কয়েক দিনের বৃষ্টিতে সাতক্ষীরা শহরের একাডেমি মসজিদ থেকে জেবুনেছা ছাত্রীনিবাস, মুন্সিপাড়া থেকে ফকির ময়ারার বাড়ি ও মুনজিতপুরের চৌধুরি বাড়ি হতে খোলার টালি, বদ্দীপুর কলোনী, সরদার বাড়ি, মাদরাসা পাড়াসহ বিস্তীর্ণ এলাকা পানিতে ডুবে আছে। এসব রাস্তায় দুই থেকে তিন ফুট পর্যন্ত পানি। এসব এলাকার মানুষের ঘরের ভেতর পানি ওঠায় বাসা ভাড়া নিয়ে অনেকেই অন্যত্র চলে গেছে।

আরও পড়ুন

সিলেটে পুরোনো কূপ সংস্কার করতে গিয়ে নতুন গ্যাসের সন্ধান

সদর উপজেলার বড়দল গ্রামের মোকলেছুর রহমান জানান, সদর উপজেলার বেতনা নদীর নব্যতা না থাকার এখন শহর ও কয়েকটি ইউনিয়নে বর্ষা মৌসুম পানি নিষ্কাশন হয় না। ফলে এসব এলাকা জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। আমাদের এলাকার শতাধিক পরিবার জলাবদ্ধতার কারণে পানিবন্দী হয়ে আছে। আমন মৌসুমে রোপণ আমন ধান পানিতে ডুবে থাকায় এলাকার কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অপর দিকে টানা বৃষ্টিতে মাছের ঘের ভেসে যাওয়ায় মাছ চাষিরা সর্বশান্ত হয়ে পড়েছে। বর্তমানে জলাবদ্ধ এলাকায় পানি দূষিত হয়ে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে অনেকে। তাছাড়া কবে নাগাদ তারা এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এ অবস্থা চলতে থাকলে অনেক মানুষকে ভিটেছাড়া হতে হবে। তিনি দ্রুত পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে জোর দাবি জানান।

স্থানীয়দের ধারণা, তিনটি কারণে সাতক্ষীরা পৌরসভার নিম্মাঞ্চলে জলাবদ্ধতা স্থায়ী রূপ নিতে চলেছে। বেতনা নদীর নব্যতা না থাকা, অপরিকল্পিত বাড়িঘর নির্মাণ, পানি নিষ্কাশনের পথ না রেখে মাছের ঘেরের বেড়িবাঁধ নির্মাণ ইত্যাদি।

সদর উপজেলার ধুলিহরের মাওলানা আব্দুস সবুর জানান, আমন মৌসুমে ৫ বিঘা জমিতে ধান চাষ করেছিলেন। কিন্তু পানির মধ্যে থাকায় ধানগাছ পঁচে নষ্ট হয়ে গেছে। বসত বাড়িতে পানি ওঠায় বসবাসে অযোগ্য হয়ে পড়েছে। রাস্তা ঘাটে পানি থাকায় ছেলে মেয়েদের লেখা পড়া ব্যাহত হচ্ছে। উপজেলা প্রশাসন ও একটি রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতাকর্মীদের প্রচেষ্টায় বৈদ্যুতিক মোটর দিয়ে সদর উপজেলার তিনটি ইউনিয়নের পানি নিষ্কাশনে সেচ কাজ অব্যহত আছে। এটা আমাদের ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা। বেতনা নদীর নব্যতা ফিরে পেলে আমাদের দুঃখ দুর্দশা লাঘব হবে।

thumbnail_IMG-20241022-WA0030

সাতক্ষীরা পৌর শহরের পলাশপোল এলাকার মনিরুল ইসলাম মিনি বলেন, ১৮৬৯ সালে প্রতিষ্ঠিত সাতক্ষীরা পৌরসভা কাগজে-কলমে প্রথম শ্রেণি হিসেবে মর্যাদা পেলেও বর্তমানে পরিপূর্ণ নাগরিক সেবা থেকে বঞ্চিত পৌরবাসী। প্রথম শ্রেণির পৌরসভার যে সুযোগ সুবিধা হওয়ার কথা এখানে তা নেই, নেই তেমন নাগরিক সুবিধাও। ৩১.১০ বর্গ কিলোমিটার আয়তন বিশিষ্ট এ পৌরসভা ৯টি ওয়ার্ড ও ৪০টি মহলরা ৫ লাখ মানুষ পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত।

তিনি আরও বলেন, পৌর সভার পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা থাকলেও তা পর্যাপ্ত নয়। অধিকাংশ পয়োনালা রাস্তার কাছে উঁচু এলাকায় হওয়ায় অপেক্ষাকৃত নিচু এলাকার পানি গড়িয়ে যেতে পারে না। অন্যদিকে মোট পয়োনালার এক-পঞ্চমাংশ কাঁচা হওয়ায় সেগুলো দ্রুত মাটির সঙ্গে মিশে যায়। ফলে পানি ঠিকমতো নিষ্কাশিত হয় না। আবার শহরের দেড় কিলোমিটার পয়োনালার জন্য একটি করে কালভার্ট থাকায় সেগুলো দিয়ে পানি দ্রুতনিষ্কাশিত হয় না।

মুনজিতপুর এলাকার বাসিন্দা হাসানুজ্জামান মনা জানান, শহরে জলাবদ্ধতার মূল কারণ অপরিকল্পিতভাবে বাড়িঘর নির্মাণ করা। বিভিন্ন এলাকায় রাস্তার কোল ঘেঁষে বাড়ি নির্মাণ করা হচ্ছে। আবার একজনের বাড়ি থেকে অন্যজনের বাড়ির প্রাচীর একই থাকছে। পানি নিষ্কাশনের কোনো পথ থাকছে না। পয়োনালা নির্মাণ করার জন্য পথ পর্যন্ত দেওয়া হয় না। ফলে অল্প বৃষ্টিতে পানি জমে যায়।

আরও পড়ুন

খানাখন্দে ভরা হাতিয়ার প্রধান সড়ক, ঝুঁকি নিয়ে চলছে যান

পৌরসভার নাজিরুল ইসলাম জানান, গেল বর্ষার পর থেকে বাড়ির চারদিকে ৩-৪ ফুট পানি জমে আছে। পরিবারের লোকজন নিয়ে বসবাস করা মুশকিল হয়ে পড়েছে। মাঝেমধ্যে সাপের উপদ্রুপ দেখা দেয়। এতে ছেলে মেয়েসহ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আতঙ্কে থাকতে হচ্ছে।

সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক মোস্তাক আহমেদ বলেন, অপরিকল্পিতভাবে বসতবাড়ি নির্মাণ এবং পৌরসভার আশপাশে প্রভাবশালীদের ঘের নির্মাণের কারণে প্রতি বছর বর্ষ মৌসুমে এখানে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। জলাবদ্ধ এলাকার পানি নিষ্কাশনের চেষ্টা করা হচ্ছে। সরকারের কাছে প্রয়োজনীয় বরাদ্ধ চাওয়া হয়েছে। বরাদ্ধ পেলে দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

প্রতিনিধি/এসএস

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর