ভারতের ঢলে মাত্র দুই ঘণ্টার ব্যবধানে ঘরবাড়িতে পানি অইডা (ওঠে) গেছে। বন্যার পানি আমগোর (আমাদের) ঘরবাড়ি সব ভাইঙ্গা নিয়ে গেছে। ভালো বাড়িঘর রাইখা আসছিলাম, এহন সব এলেমেলো, ভাইঙ্গা পানির ঢলে আমার থাকার ঘর, দাদুর থাকার ঘর, গোয়াল ঘর, রান্না ঘরসব ভেসে গেছে গা। আমরা এখন নিরুপায়। কথাগুলো বলছিলেন নালিতাবাড়ীর দক্ষিণ কাটাবাড়ির বাসিন্দা সূজলী নকরেক।
ভারতের মেঘালয় রাজ্য ও আশপাশ হতে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল আর টানা বৃষ্টিতে শেরপুরের শ্রীবরদী, নালিতাবাড়ী ও ঝিনাইগাতী উপজেলার পাহাড়ি জনপদে মাটির তৈরি ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। এতে দিশেহারা হয়ে পড়েছে অর্ধশতাধিক ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষ।
বিজ্ঞাপন
দিন এনে দিন খাওয়া এসব নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের দরিদ্র মানুষ তাদের পেটের ক্ষুধার চেয়ে মাথা গোজার ঠাঁই নিয়ে বেশি চিন্তিত। ঝিনাইগাতী উপজেলার মরিয়মনগর আদিবাসী গ্রামের প্রায় শতাধিক গারো সম্প্রদায়ের মাটির তৈরি কাঁচা ঘর ভেঙে পড়েছে। এখন তাদের খোলা আকাশের নিচে ঠাঁই নেয়া ছাড়া কোনো পথ নেই।
জানা গেছে, গত বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার ভারতের মেঘালয় রাজ্য থেকে নেমে আসা ভোগাই, চেল্লাখালি ও মহারশি নদী দিয়ে প্রবাহিত পাহাড়ি ঢলের স্রোতের কারণে ঝিনাইগাতী ও নালিতাবাড়ী উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা বন্যা কবলিত হয়ে পড়ে। বিশেষ করে আদিবাসী গারো সম্প্রদায়দের গ্রামের ওপর দিয়ে ঢল নেমে যাওয়ার সময় তাদের কাঁচা ঘরবাড়িগুলো মাটির সঙ্গে মিশে যায়। রোববার থেকে উজানের পানি নেমে আসায় সে ধ্বংসস্তূপের চিত্র ভেসে উঠছে।
উপজেলার গারো অধ্যুষিত মরিয়মনগর, দুধনই, ভাটপাড়া, বারোয়ামারী, ধানশাইল, বাঁকাকুড়া, গজারীকুড়া গ্রামের গারো জনগোষ্ঠীর মাটির ঘরগুলো ক্ষতির শিকার হয়েছে সবচেয়ে বেশি।
বিজ্ঞাপন
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গ্রামগুলোর মধ্যে বেশি ক্ষয়ক্ষতির শিকার ভাটপাড়া। গ্রামটির ৩৭টি পরিবারের সবগুলো ঘর নুইয়ে পড়েছে।
পার্শ্ববর্তী দুধনই, মরিয়মনগর, গজারীকুড়া, বারোয়ামারীতেও একই চিত্র। বারোয়ামারীর যুথিকা রাকসাম, আধুনিকা ম্রং, বণিকা চিরান, লুটিস চিরান, কবিতা ম্রং, সলিন ম্রং, মহিমা চিরান, নির্দেশ চিরান, আলফন্স চিরান প্রমুখের বাড়ি বন্যার পানিতে মাটির ঘরগুলো একেবারে শুয়ে পড়েছে। এছাড়াও অনেকের ঘর ভেঙেছে আংশিকভাবে। অনেকের পুকুর ডুবে গেছে।
ধানশাইল, বাঁকাকুড়ার প্রায় ১০টি গারো পরিবারের ঘর ধসে পড়েছে। তবে ঘরগুলো ধসে পড়ার আগেই মানুষ ঘর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যান। এতে মানুষের হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।
ষাটোর্ধ্ব মিটিলা চিসিম বলেন, দুদিন ধরে খাওয়া-দাওয়া নাই। কাপড়-চোপড় নাই। সব তলায় গ্যাছে। কেউ আঙ্গরে খবর নেয় নাই।
দুধনই গ্রামের মৃন্ময় চিরান জানান, তার গ্রামের প্রায় ৮-১০টি বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বৃষ্টির মধ্যে রাতে অনেকেই তার বাড়িতে আশ্রয় নেন। ঘর হারানো লোকগুলো রীতিমত নির্বাক হয়ে গেছে।
মানবাধিকার কর্মী কাঞ্চন মিস্টার মারাক বলেন, প্রাথমিকভাবে আমরা একটি তালিকা করেছি যাদের বাড়িঘর একেবারেই ভেঙে ভেসে গেছে। তারা হলো নালিতাবাড়ীর খলিসাকুড়া গ্রামের মি. সুজিত ম্রং, জহীন্দ্র দফো, রেমন্ড ম্রং, পুষ্প রাংসা, ববিলা চাম্বুগং, রফিন দিও, স্বপণ রাংসা, বাসেন্দ্র হাজং, তরুণ দফো, লিপি দফো, বলেক হাজং, ঝর্না রিছিল, লেমিতা হাজং, সীমা হাজং, রবিশন দফো, রত্না মান্দিক।
এছাড়াও কাটাবাড়ি এলাকার শিশিলিয়া চিছাম, সূজলী নকরেক, নাকুগাঁও, বাউসি চিরান।
আর বুরুঙ্গা গ্রামের পেটুস চিরান, বাবুল স্কু, অর্পন চিরান।
এদিকে আন্ধারুপাড়া গ্রামের অনন্ত নকরেক, সুজানা স্কু, পারুলা চাম্বুগং।এদের পূণর্বাসন জরুরি।
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি পুনর্নির্মাণ বা পুনর্বাসনের বিষয়ে শেরপুরের জেলা প্রশাসক তরফদার মাহমুদুর রহমান জানায়, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ির তালিকা তৈরির কাজ চলছে। পরবর্তীতে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ দেওয়া হবে।
প্রতিনিধি/এসএস