গাজীপুরের শ্রীপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্য নিহতের ঘটনায় অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে।
শনিবার (২১ সেপ্টেম্বর) মামলার তথ্যটি নিশ্চিত করেছেন শ্রীপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ জয়নাল আবেদীন মন্ডল।
বিজ্ঞাপন
তিনি বলেন, গত বৃহস্পতিবার (১৯ সেপ্টেম্বর) বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের ময়মনসিংহ সেক্টর সদর দফতরের জেসিও নায়েব সুবেদার সোহেল রানা বাদী হয়ে শ্রীপুর থানায় একটি মামলা দায়ের করেছেন। মামলাটি তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
থানায় দায়ের করা মামলায় বাদীর অভিযোগে গেছে, গত ৫ আগস্ট সকাল ৯টায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের ময়মনসিংহ সেক্টর সদর দফতরের নির্দেশনা মোতাবেক গাজীপুর শিল্প এলাকার নিরাপত্তা বিধানের জন্য ২টি পিকআপ ও ৮টি বেসামরিক বাসযোগে ময়মনসিংহ ব্যাটালিয়ন (৩৯ বিজিবি) হতে বিজিবি সদস্যদের নিয়ে কনভয় আকারে গাজীপুরে মোতায়েনের উদ্দেশে রওনা হই। পথিমধ্যে আমরা ত্রিশাল, ভালুকাসহ বেশ কয়েকটি স্থানে ব্যারিকেডের সম্মুখীন হই। আমাদের কনভয়ে অবস্থানকারী বিজিবি সদস্যরা ওই সমস্ত স্থানে অত্যন্ত ধৈর্য্য এবং সহনশীলতার পরিচয় দিয়ে আলোচনার মাধ্যমে অগ্রসর হই। আনুমানিক সকাল সাড়ে ১০টার দিকে আমরা মাওনা ফ্লাইওভার (মাওনা চৌরাস্তা) সংলগ্ন এলাকায় পৌঁছালে বড় ধরনের বেরিকেডের সম্মুখীন হই।
উল্লেখ্য যে, আমাদের পৌঁছানোর পূর্বেই ওই এলাকায় কয়েকটি বেসামরিক যানবাহন পোড়ানো ও ভাঙচুর করা হয়। ফলে চলাচলের জন্য রাস্তা সংকীর্ণ হয়ে যায়। রাস্তা চলাচলের জন্য সংকীর্ণ হয়ে যাওয়ায় এবং হাজার হাজার জনতা রাস্তায় অবস্থায় করায় কনভয়টি ধীরগতিতে চলতে থাকার কারণে বিজিবি সদস্য বহনকারী ২টি বেসামরিক বাস ও ১টি পিকআপ কনভয় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পেছনে পড়ে। তৎক্ষণাত স্থানীয়দের মাঝে আমাদের নিয়ে গুজবের সৃষ্টি হয় যে, উক্ত কনভায়ে ভারতের ‘বিএসএফ’ এবং ‘র’ এর এজেন্ট বিজিবির পোশাক পরে ছদ্মবেশে ঢাকার উদ্দেশে যাচ্ছে। ফলে এই ধারণার বশবর্তী হয়ে, রাস্তায় অবস্থানকারীরা বাস দুটির গতিরোধ করে ‘বিএসএফ’ বলে চিৎকার করতে থাকে। তখন বেশ কয়েকজন ক্ষিপ্ত হয়ে বাসে উঠে পড়ে এবং বিজিবি সদস্যদের ‘ভারতীয় বিএসএফ’ এবং ‘র’ এর এজেন্ট বলে গালিগালাজ করতে থাকে।
বিজ্ঞাপন
বাসে উপস্থিত বিজিবি সদস্যরা তাদেরকে বারংবার পরিচয় নিশ্চিত করাসহ প্রত্যেকের আইডি কার্ড প্রদর্শন করে। বিজিবির কথায় কোনো কর্ণপাত না করে তারা বাস দুটিকে একটি পেট্টোল পাম্পের কাছে নিয়ে যেতে বাধ্য করে। অতপর বিক্ষুব্ধ জনতা বাসের চাকার হাওয়া ছেড়ে দেয়। এমন সময় একটি বাসের সবার অস্ত্র এবং মোবাইল বিক্ষোভকারীরা বস্তার মধ্যে নিয়ে নেয় এবং অপর বাসের অস্ত্র এবং মোবাইলও জমা নেয়া শুরু করে। ইতোমধ্যে বিক্ষুবদ্ধ জনতার মধ্যে কয়েকজন ইন্ধন দিয়ে বাসের ভেতর অবস্থানকারী বিজিবি সদস্যদের পুড়িয়ে দেওয়ার জন্য বাসের গায়ে পেট্টোল ঢালতে থাকে এবং বাসের তেলের ট্যাংকি ছিদ্র করে দেয়। তখন বাসের ভেতরে প্রবেশ করা অন্যান্য বিক্ষুব্ধ জনতা যারা আগে উঠেছিল তারা নামতে শুরু করে এবং বাসের গেইট জিআই তার দিয়ে বন্ধ করে দেয়। তখন বাসে অবস্থানকারী বিজিবি সদস্যরা নিজের জীবন বাঁচাতে জোরাজোরি করে বস্তা থেকে অস্ত্র নিয়ে বাসের বাইরে নেমে আসে। এই সময় উত্তেজিত লোকজন বিজিবির হাত থেকে অস্ত্র ছিনিয়ে নিয়ে যায় এবং তাদেরকে লাঠিসোঁটা দিয়ে প্রহার করতে থাকে।
চারিদিক থেকে তখন আরও হাজার হাজার মানুষ আসতে থাকে এবং ইট, পাটকেল, ককটেল, পেট্টোলবোমা নিক্ষেপ করতে থাকে। ইতোমধ্যে বিক্ষুব্ধ জনতা নম্বর-৬১৪১১ নায়েক মো. আব্দুল আলীম শেখসহ ১০/১২ জনকে গুরুতর আহত করে এবং নারকীয় তাণ্ডব চালিয়ে যেতে থাকে। তখন আমরা জান-মালের হেফাজতের জন্য আত্মরক্ষার্থে ফাঁকা গুলি করি। এ সংবাদ পেয়ে সামনে পিকআপে থাকা দলটি আমাদেরকে উদ্ধারের জন্য এগিয়ে আসে। কিন্তু ততক্ষণে গুজব ছড়িয়ে পড়ার কারণে পিকআপে থাকা দলটি উত্তেজিত জনতার রোষানলে পড়ে। ফলে দলটি আমাদের কাছাকাছি এসেও উদ্ধার করতে ব্যর্থ হয় এবং এক সময় দলটি পিকআপ ছেড়ে দৌড়ে গ্রামের ভেতরে এক বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। তখন বিক্ষুব্ধ জনতা ছেড়ে যাওয়া পিকআপটি আগুনে পুড়িয়ে দেয়। আনুমানিক বেলা ৩টার দিকে গাজীপুর ব্যাটালিয়ন (৬৩ বিজিবি) হতে আরেকটি দল ২টি এপিসি সহকারে আমাদেরকে উদ্ধারের জন্য ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। পথিমধ্যে এপিসিগুলোতে স্থানীয় জড়ো হওয়ায় জনতা আটকে দিয়ে এপিসির উপরে উঠে পড়েছিল। এপিসিগুলো ঘটনাস্থলের কাছাকাছি পৌঁছে স্থানীয়দের শান্ত করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। ইতোমধ্যে ঘটনাস্থলে আবারও এলোপাতাড়ি ইট, পাটকেল, পেট্টোলবোমা নিক্ষেপ করতে থাকলে এই এপিসি দুটিসহ অন্য স্থানে চলে যায়।
আনুমানিক বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে ময়মনসিংহ হতে আরও একটি দল বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও ২জন ম্যাজিস্ট্রেটসহ আমাদেরকে উদ্ধার করতে আসে। ঘটনাস্থলে বিজিবি দলটি পৌঁছে গাড়ি থেকে নেমে উত্তেজিত জনতাকে প্রশমিত করার চেষ্টা করে। ইতোমধ্যে বিজিবি সদর দফতর হতে হেলিকপ্টারের মাধ্যমে আমাদেরকে কয়েকবার উদ্ধারের চেষ্টা করা হয়েছে। হেলিকপ্টারের আগমনে ভারতীয় সেনাবাহিনী এসেছে বিএসএফকে উদ্ধার করতে এমন গুজব আরও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। ফলশ্রুতিতে বিক্ষুব্ধ জনতা হেলিকপ্টার লক্ষ্য করে ক্রমাগত ইট পাটকেল ছোড়ে এবং হাজার হাজার জনতার উপস্থিতির কারণে হেলিকপ্টার অবতরণ করতে পারেনি। ইতোমধ্যে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ করার খবর ছড়িয়ে পড়লে আরও হাজার হাজার মানুষ এই মিছিলে যোগ হতে থাকে।
ময়মনসিংহ হতে আগত দলটি বারংবার মেগাফোনের মাধ্যমে উত্তেজিত জনতাকে বোঝানোর চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু বিক্ষুব্ধ জনতা তাদের নারকীয় তাণ্ডব চালিয়ে যেতে থাকে এবং বেশ কয়েকজনকে আহত করে ফেলে। পরবর্তীতে আমাদের দল সেনাবাহিনীর আশ্রয়ে থেকে যায় ময়মনসিংহ হতে আগত দলটিকে হাজার হাজার উত্তেজিত আক্রমণকারীরা ধাওয়া করে মারতে মারতে কিছু সদস্যকে প্রায় ৬ কি. মি. পর্যন্ত দূরে নিয়ে গড়গড়িয়া মাস্টারবাড়ির একটি মসজিদে আটকে রাখে। মসজিদে আটক গুরুতর আহত ৫জন যে মুসলমান এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার পরে মসজিদে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়। এসময় হাজার হাজার উত্তেজিত আক্রমণকারী মসজিদের কাচের দরজা ভেঙে ফেলার চেষ্টাকালীন স্থানীয় কতিপয় সহায়তাকারী ব্যক্তিদের সঙ্গে মারপিটের সময় ২জন বিজিবি সদস্য বেসামরিক পোষাক পরে বের হয়ে যেতে সক্ষম হয়। এরপর আরও আক্রমণকারীরা একত্রিত হয়ে রামদা এবং লাঠিসোঁটাসহ মসজিদের মধ্যে অবস্থানকারী অবশিষ্ট ৩ জনকে তাদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য চিৎকার করতে থাকে।
স্থানীয় ব্যক্তিদের সহায়তায় উক্ত তিনজন লুঙ্গি এবং গেঞ্জি পরিধান করে নেয়। রাত আনুমানিক ৯টার দিকে আক্রমণকারীরা মসজিদের কাঁচের দেয়াল ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করলে আক্রমণকারীদের মধ্যে হতে উক্ত ৩ জন বিজিবি সদস্য কৌশলে বের হয়ে যায় এবং রাস্তা পার হয়ে কিছু বেসামরিক ব্যক্তি সহায়তায় একটি বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করে। এ ঘটনায় বিক্ষুদ্ধ অজ্ঞাত জনতা রেজিঃ নম্বর-৬১৪১১ নায়েক আব্দুল আলীম শেখকে গুরুতরভাবে আক্রমণ করে ঘটনাস্থলে হত্যা করে। তাছাড়া আক্রমণকারীদের হামলায় আরও ৬৪ জন বিজিবি সদস্য গুরুতর আহত হয় এবং বিজিবির সরকারি ১টি জিপ, ৬টি পিকআপ, তিনটনের তিনটি ট্রাক, ১টি ম্যাজিস্ট্রেটের পিকআপ ও দুইটি সিভিলবাস ভাঙচুর করে পুড়িয়ে দেয়।
বিজিবির সরকারি সম্পদ বিনষ্ট যার আনুমানিক মূল্য ৪ কোটি ১২ লাখ ৯ হাজার ২৩৮ টাকা এবং নিরাপত্তায় নিয়োজিত বিজিবি সদস্যদের সরকারি কাজে বাধা প্রদান করে। পরবর্তীতে নায়েক আব্দুল আলীম শেখের মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।
প্রতিনিধি/এসএস

