গাজীপুরে একটি সোয়েটার কারখানায় কাজ করতেন নবী হোসেন (২৩)। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি করতে দেখে নিজেও যোগদেন সেই আন্দোলনে।
গত ৪ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলন যখন তুঙ্গে। সেদিন শহরের বাইপাস এলাকায় মাদরাসা শিক্ষার্থীর বড় ভাই জামাল মিয়াকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলনে যোগ দেন নবী হোসেন।
বিজ্ঞাপন
এদিন বিকেল ৪টার দিকে আন্দোলনে বেপরোয়াভাবে গুলি ছুঁড়ে পুলিশ। পাশাপাশি ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাকর্মীরা বেধড়ক পেটাতে থাকে আন্দোলনকারীদের। সড়কের মাঝখানে থাকায় পাঁচ শতাধিক ছররা গুলি লাগে নবী হোসেনের শরীরে। মুহূর্তেই রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন তিনি। অন্য আন্দোলনকারীরা টিকতে না পেরে দৌড়ে পালিয়ে যায়। এদিকে রাস্তায় পড়ে থাকা নবী হোসেনকে পুলিশ বুট জুতা দিয়ে আঘাত করতে থাকে। আর ছাত্রলীগ-যুবলীগের ৮-৯জন মিলে লোহার রড দিয়ে পেটাতে থাকে। এক পর্যায়ে জ্ঞান হারালে মৃত ভেবে নবী হোসেনকে রাস্তার পাশে থাকা একটি ভবনের বাউন্ডারি গেটের ভেতর নিয়ে গিয়ে কম্বল দিয়ে ঢেকে রেখে দেয়। সেখানে ওইদিন এমন আরও অনেককে রাখা হয়। যাদের বেশির ভাগই মৃত ছিল।
ঘণ্টা দুয়েক পর জ্ঞান ফেরে নিজেকে কম্বলে ঢাকা অবস্থায় দেখতে পান নবী হোসেন। কোনোরকম মুখ বের করে সেই ভবনের লোকজনের কাছে সহায়তা চেয়ে বলেন, আমি জীবিত আছি, আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যান।
পরে তারা গাজীপুরের শহীদ তাজ উদ্দিন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান নবী হোসেনকে। রাত আটটার দিকে খবর পেয়ে বড় ভাই জামাল মিয়া হাসপাতালে গিয়ে নবী হোসেনের সন্ধান পান। তারপর থেকে সুদে আনা টাকায় চলছে নবী হেসেনের চিকিৎসা। এ পর্যন্ত তার চিকিৎসায় ব্যয় হয়েছে প্রায় তিন লাখ টাকা। বর্তমানে ঢাকার সিএমএইচে চিকিৎসাধীন রয়েছেন নবী হোসেন। তবে এখনও ঠিকমতো কথা বলতে পারেন না তিনি।
আরও পড়ুন
নবী হোসেন নেত্রকোনা জেলার বারহাট্টা উপজেলার বাউসী ইউনিয়নের দেওপুর গ্রামের নসর জমার ছেলে। নবী হোসেনরা সাত ভাই ও এক বোন। সবার মধ্যে পঞ্চম তিনি।
গ্রামের স্কুলে সেভেন ক্লাস পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন নবী হোসেন। অভাবের কারণে আর এগোয়নি পড়াশোনা। ৩/৪ বছর আগে গাজীপুরে গিয়ে একটি সোয়েটার কারখানায় কাজ শুরু করেন নবী হোসেন।
বাবা নসর জমা পেশায় কৃষক। বাড়ির জায়গাটুকু ছাড়া আর কোনো জমিজমা নেই।
নবী হেসেনের বড় ভাই জামাল মিয়া নেত্রকোনা এন আকন্দ মাদরাসায় ফাজিল পড়াশোনা করছেন। অন্য ভাইয়েরা কৃষি কাজ করেন।
জুলাই মাসের শেষের দিকে ছোট ভাইকে দেখতে গাজীপুরে গিয়েছিলেন জামাল মিয়া। সেখানে যাওয়ার পর দুই ভাই মিলে যোগ দেন আন্দোলনে।

সেদিনের বর্ণনা দিতে গিয়ে আহত নবী হোসেনের বড় ভাই মো. জামাল মিয়া জানান, শিক্ষার্থীদের ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ দেখে আর থাকতে পারিনি। দুই ভাই মিলে যোগ দেই আন্দোলনে। ৪ আগস্ট সকাল থেকে দুইজন একসঙ্গেই ছিলাম। বিকেল ৪টার দিকে পরিস্থিতি বেগতিক হয়ে যায়। পুলিশ ব্যাপকভাবে গুলি, টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়তে থাকে। চলতে থাকে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া। এক পর্যায়ে অগণিত ছররা গুলি নবী হোসেনের শরীরে বিদ্ধ হলে সে রাস্তায় পড়ে যায়। ধাওয়া খেয়ে আমরা তখন অন্য গলিতে গিয়ে আশ্রয় নেই। তারপর থেকে তাকে আর পাইনি। পুলিশ রাস্তায় ফেলে নবী হোসেনকে বুট জুতা দিয়ে আঘাত করেছে। আর ছাত্রলীগ-যুবলীগের লোকজন লোহার রড দিয়ে পিটিয়েছে। জ্ঞান হারানো নবীকে তারা মৃত ভেবে পাশের একটি ভবনের বাউন্ডারি গেটের ভেতর নিয়ে কম্বল দিয়ে ঢেকে রাখে। সেখানে আরও অনেককে এভাবে রেখেছিল। পরে জ্ঞান ফেরার পর বাড়ির লোকজনকে ডাক দিলে তারা তাকে হাসাপাতালে নিয়ে যায়। রাত ৮টার দিকে খবর পেয়ে তাজ উদ্দিন মেডিকেলে গিয়ে নবী হোসেনকে পাই। শরীরে তার পাঁচ শতাধিক ছররা গুলি দেখতে পাই। এছাড়া দলীয় ক্যাডারদের রডের আঘাতে তার শরীরে বড় বড় গর্ত হয়ে আছে।
আরও পড়ুন
জামাল মিয়া আরও জানান, ভয়ে হাসপাতালের চিকিৎসকরা সামান্য চিকিৎসা দিয়েই রাতেই ঢাকা মেডিকেলে রেফার্ড করে দেন নবী হোসেনকে। রাস্তায় তখন পুলিশ আর ছাত্রলীগের লোকজন ভর্তি। নিয়ে যাওয়ার উপায় নেই। কোনো অ্যাম্বলেন্স রোগী নিয়ে যেতে রাজি হচ্ছিল না। সবার মধ্যে আতঙ্ক। শেষে গাজীপুর থেকে উত্তরার একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাই ১৩ হাজার টাকায়। বেসরকারি হাসপাতালে দুইদিন আইসিইউতে রাখা হয়। এই দুইদিনে বিল আসে ১ লাখ টাকা। গ্রাম থেকে সুদে টাকা এনে বিল পরিশোধ করে ৮ আগস্ট নিয়ে আসি ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ (মমেক) হাসপাতালে। সুদ-ঋণের টাকাও শেষ তাই সেখানে দুই তিন দিন চিকিৎসা শেষে গ্রামের বাড়ি নিয়ে যাই। কিন্তু ৩-৪ দিন৷ পর ব্যথা শুরু হলে বারহাট্টা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করি। তাতে কোনো উন্নতি হয়নি ব্যথা আরও বেড়ে চলে। পরে গত ২২ আগস্ট ফের ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাই। পরিস্থিতি আরও অবনতি হলে শেষে ঢাকার সিএমএইচ হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করা হয়। এখন পর্যন্ত সেখানেই রয়েছে নবী হোসেন। তবে ঠিক মতো কথা বলতে পারছে না সে। এখন পর্যন্ত নবী হোসেনের চিকিৎসায় কেউ সহযোগিতার হাত বাড়ায়নি।
জামাল মিয়া আক্ষেপ করে বলেন, বারহাট্টা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ময়মনসিংহ নিয়ে যাওয়ার জন্য অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া দিয়েছিলেন। এছাড়া আর কেউ এখনও কোনো সহযোগিতা করেননি। আমরা গরিব মানুষ, নবী হোসেন আহত হয়ে থাকায় আয়ের পথ বন্ধ। উল্টো তার পেছনে প্রায় ৩ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। সব টাকাই সুদে আনা। আর কতদিন যে লাগে তার সুস্থ হতে একমাত্র আল্লাহই জানেন।
প্রতিনিধি/এসএস

