বাঙালির আতিথেয়তার অন্যতম অনুসঙ্গ পান। বিভিন্ন উৎসব-অনুষ্ঠান, পালা-পার্বণ, বিয়ে-আয়োজন সব শেষে যেন পান থাকতেই হবে। সেই ঘুম পাড়ানি মাসিপিসি ছড়ার মতো বলতে হয়, ‘বাটা ভরা পান দেব, গাল ভরে খেও’। গ্রামবাংলা এমন কি শহুরে বাঙালির অনেকেই পান খেয়ে থাকেন।
সেই পান চাষ করেই স্বাবলম্বী হয়েছেন অনেকেই। তাদের একজন দিনাজপুরের বিরল উপজেলার কৃষক মো. ইউসুফ আলী।
বিজ্ঞাপন
![]()
জানা যায়, ২০১১ সালে বিদেশে যান ইউসুফ আলী। ২০১৭ সালে দেশে ফেরেন। দেশে আসার পর নানান চিন্তা মাথায় আসে তার। কি করবে সেটাই চিন্তা। এরপর তিনি রাজশাহীতে যান এবং পানের ওপর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে এলাকায় এসে পান চাষ শুরু করেন। ২০১৮ সালে প্রথমে ১২ শতাংশ জমিতে পানের চাষ করেন। ২০১৯ সালে আরও ৮ শতক জমিতে চাষ করেন। ২০২২ সালে তিনি আরও ১৫ শতক জমি চাষ করেন। মোট ৩৫ শতক জমিতে পানের চাষ করে ইউসুফ আলী বছরে ৬ লাখ টাকা আয় করেন। এবং তার খরচ হয় আড়াই লাখ টাকা।

পাশের গ্রামের কৃষক আব্দুল লতিফ ঢাকা মেইলকে বলেন, আমি পাশের গ্রাম থেকে ইউসুফ ভাইয়ের পান চাষ দেখতে এসেছি। ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম যে ধান, গম, ভুট্টার চেয়ে পানে লাভ বেশি হচ্ছে। আমিও আগ্রহী হয়েছি এবং ভাইয়ের কাছে পরামর্শ নিচ্ছি যাতে আমিও পানের বরজ করতে পারি।
বিজ্ঞাপন
![]()
বিরল উপজেলার সেগুন বাড়ি বাজারে কৃষক মোস্তফা ঢাকা মেইলকে বলেন, আমি শুনলাম যে বিরল উপজেলার আজিমপুর ইউনিয়নে পানের বরজ আছে। সেই পানের বরজ দেখার জন্যই আমি এসেছি। যদি পান চাষে লাভবান হওয়া যায় তাহলে আমিও আগামীতে এই পান চাষ করব। তবে এখানে এসে দেখি যে এত সুন্দর গাছ এবং পরিবেশটা এত সুন্দর দেখে মন ভরে গেল। তবে কৃষক যদি চাষ করে অবশ্যই লাভবান হওয়া যাবে। আমি ইউসুফ ভাইয়ের কাছ থেকে চারা নিয়ে গিয়ে পানের বরজ দেব।
![]()
পান বাগানের শ্রমিক ঢাকা মেইলকে বলেন, আমি এই বাগানে কাজ করি। পান বাগানে কাজ করার পাশাপাশি আমার ট্রেনিং হচ্ছে। আমার ইচ্ছা আছে এদের সঙ্গে কাজ করে এবং অভিজ্ঞতা অর্জন করে ভবিষ্যতে বড় করে পানের বরজ দেওয়ার।
পান ব্যবসায়ী আজিজ রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, আগে আমরা বিভিন্ন জেলা থেকে পান সংগ্রহ করে দিনাজপুরের আশপাশের উপজেলাগুলোতে বিক্রি করতাম। বর্তমানে আমাদের এলাকায় ভালো মানের পান চাষ হয়। তাই আমরা আমাদের এলাকার পান বিক্রি করছি। বাইরে থেকে পান নিয়ে আসলে পচাপান ও বাসি পান থাকতো। এতে আমরা অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হতাম। কিন্তু এখন আমাদের এলাকায় যে পানটি চাষ হচ্ছে মোটামুটি বাইরের থেকে অনেক ভালো। আমরা বিক্রি করছি। মোটামুটি আমরাও স্বাবলম্বী এবং কৃষকও স্বাবলম্বী হচ্ছেন। বর্তমানে আমাদের দিনাজপুরের পান নাটোরে পাঠাই।
![]()
পান চাষির ছেলে হাবিবুর রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, আমরা ৩৫ শতাংশ জমিতে পানের বরজ করেছি। আমরা দুই ভাই ও বাবা মিলে কাজ করি। সঙ্গে দু’চার জন শ্রমিক আছে। পান চাষ করে আমাদের সংসার সুন্দরভাবে চলছে। পানের বরজে যারা কাজ করে তারাও স্বাবলম্বী হচ্ছেন।
কৃষক মো. ইউসুফ আলী ঢাকা মেইলকে বলেন, আমি ২০১১ সালে বিদেশ গিয়েছিলাম। ২০১৭ সালে দেশে ফিরে আসি। এরপর চিন্তা করলাম আমার দুই ছেলে আর আমি এখন কি করব। এরপর আমি রাজশাহীতে যাই এবং সেখানে পান চাষের প্রশিক্ষণ নিই। আমার কিছু আত্মীয় আছে, তারা আমাকে সহযোগিতা করলেন। তারপর ২০১৮ সালে আমি প্রথম পান চাষ শুরু করি। ২০২০ সাল থেকে আমি পুরোপুরি লাভবান হয়েছি। আমার আশপাশে যদি কেউ পানের বরজ করতে চায় তাহলে আমি তাদেরকে বীজ দেওয়ার জন্য প্রস্তুত আছি।
![]()
তিনি আরও বলেন, ২০১৮ সালে ১২ শতাংশ জমিতে প্রথম পানের চাষ শুরু করি। ২০১৯ সালে পান চাষে আরও ৮ শতক জমি বাড়িয়ে দেই। ২০২২ সালে আরও ১৫ শতক জমি বাড়িয়ে দেই। এ নিয়ে এখন মোট ৩৫ শতক জমিতে পানের চাষ আমার। আশা আছে আমি সামনে আরও বাড়ানোর। বর্তমানে আমি চারা করি। প্রতি সপ্তাহে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার পান তুলি। পান চাষ করে আমার বছরে ৬ লাখ টাকা আয় হচ্ছে। এবং খরচ হয় দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা।
আরও পড়ুন
বিরল উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মোস্তফা হাসান ইমাম ঢাকা মেইলকে বলেন, কৃষিকে নিয়ে বর্তমান সরকারের মূল স্লোগান ‘কৃষিই সমৃদ্ধি’। শুধু মগজে নয় এই বাক্যটি মনে ধারণ করে আমরা নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছি। নিত্যনতুন কৃষি উদ্যোক্তা তৈরিতে আমাদের মাঠকর্মীরা নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। ১ নম্বর আজিমপুরের পানচাষী মো. ইউসুফ আলী তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
![]()
তিনি আরও বলেন, উপজেলা কৃষি অধিদফতরের তত্ত্বাবধানে আমরা চেষ্টা করেছি পানের সম্প্রসারণ করার। আমরা উদ্যোগ নিয়েছি এবং সফল হয়েছি। মূলত আমাদের এক নম্বর আজিমপুর ইউনিয়নে উদ্যোক্তা মো. ইউসুফ আলীকে নিয়ে আমরা কাজ শুরু করেছি। সেখানে পান চাষ হচ্ছে। আপনার জানেন যে অনেকগুলো পানের জাত আছে। যেমন- বারি পান ১,২,৩ ইত্যাদি। বিভিন্ন ভ্যারাইটি পান থাকলেও আমরা মূলত এখানে দেশীয় উন্নত জাতের পান চাষ করছি। পান চাষের ক্ষেত্রে রোগবালায় তুলনামূলক কম। যদি আমরা পরিচ্ছন্নভাবে চাষাবাদ করতে পারি। আগাছা মুক্ত রাখতে পারি। বেলে দোআঁশ মাটিতে চাষাবাদে যে সম্ভাবনা রয়েছে সেটিকে মূলত আমরা কাজে লাগিয়েছি। আমাদের বর্তমানে যে তরুণ কৃষি উদ্যোক্তারা আছে তাদের ক্ষেত্রে আমরা দেখলাম এটি একটি নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে।
প্রতিনিধি/এসএস

