লেখাপড়া করে চাকরির জন্য বসে না থেকে নড়াইলের বেকার যুবক-যুবতীরা ঝুঁকছে ফ্রিল্যান্সিংয়ে। ঘরে বসে একটি কম্পিউটার অথবা ল্যাপটপের মাধ্যমে বিদেশ থেকে আনছে রেমিটেন্স। এই পেশায় নিজেদের যুক্ত করে অনেকে হয়েছেন সফল ফ্রিল্যান্সার। জেলায় অর্ধশতাধিক বেকার যুবক-যুবতী হয়েছে কোটিপতি, বেকারত্ব ঘুচিয়েছেন অন্তত দেড় হাজার বেকার নারী-পুরুষ। এই ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশ থেকে প্রতিমাসে নড়াইলে রেমিটেন্স আসছে অন্তত পনেরো কোটি টাকা।
চলতি বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি নড়াইলের ফ্রিল্যান্সার জুয়েল আহম্মেদের বাড়িতে আসেন তার ক্লায়েন্ট জার্মানের একটি সফটওয়্যার ফার্মের প্রজেক্ট ম্যানেজার মি. মার্টিন। প্রায় ৫ বছর আগে কাজের সুবাদে ফ্রিল্যান্সার জুয়েলের সঙ্গে একটি মার্কেটপ্লেসে পরিচয় হয় মার্টিনের। ধীরে ধীরে ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে তাদের। বিনিময় হয় দুই দেশের মানুষের জীবনযাত্রা, সংস্কৃতিসহ বিভিন্ন তথ্যের। একপর্যায়ে ভালোলাগা থেকে জীবনে প্রথমবারের মতো এশিয়ার কোনো দেশ হিসেবে বাংলাদেশে আসেন মার্টিন।
বিজ্ঞাপন
ফ্রিলান্সার জুয়েল বলেন, ফ্রিল্যান্সার হিসেবে অনেক ক্লায়ন্টের সঙ্গে কাজ করা হয়। সম্পর্ক তো সবার সঙ্গে ভালো হয় না। ওনার (মার্টিন) সঙ্গে আমার সম্পর্কটা ভালো। একপর্যায়ে আমি তাকে বাংলাদেশে আসার আমন্ত্রণ জানাই। তিনি রাজি হন। তবে তার পরিবারের সদস্যরা বাংলাদেশে আসতে দিতে চাচ্ছিল না। পরে তাদেরকে বোঝাতে সক্ষম হয়।
নড়াইল ফ্রিল্যান্সার অ্যাসিসোয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মাহমুদ হাসান (রনি) ঢাকা মেইলকে জানান, নড়াইল জেলায় ২০১০ সাল থেকে ফ্রিল্যান্সিং শুরু করে স্থানীয় কয়েকজন বেকার নারী-পুরুষ। তখন হাতেগোনা কয়েকজন এই কাজ করতেন। এর পর ফ্রিল্যান্সারদের সাফল্য দেখে ধীরে ধীরে এর সংখ্যা বাড়তে থাকে। বর্তমানে জেলায় মোট এক হাজার ছয় শত ফ্রিল্যান্সার রয়েছে। এর মধ্যে নারী ফ্রিল্যান্সার আছে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ। এ কাজ করে অর্ধশতাধিক ফ্রিল্যান্সার হয়েছেন কোটিপতি। অনেকে রেমিটেন্সের অর্থে কিনেছেন জমি, গ্রাম ও শহরে গড়েছেন বহুতল ভবন, বাড়ি গাড়ি করার পাশাপাশি বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করছেন এই ফ্রিল্যান্সাররা।
সফল এই ফ্রিল্যান্সার মাহমুদ হাসান (রনি) ঢাকা মেইলকে বলেন, উচ্চমাধ্যমিক পড়ার সময় ২২ বছর বয়সে বাবাকে হারিয়ে ৪ সদস্যের পরিবার নিয়ে যখন সংসার চালাতে হিমসিম খাচ্ছিলাম তখনই নিজ উদ্যোগে একটি কম্পিউটার কিনে ২০১২ সালে ফ্রিল্যান্সিং শুরু করি। ২ মাস পর থেকেই একটু একটু করে আয় আসতে থাকে। ২০১৪ সালের পর আমাকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি বরং তখন থেকে প্রতি মাসে লক্ষাধিক টাকা আয় করি। এই টাকা দিয়েই নিজে লেখাপড়া শেষ করার পাশাপাশি সংসার চালিয়ে নড়াইল শহরের আলাদাৎপুর এলাকায় নির্মাণ করেছেন ৩ তলা বাড়ি। বর্তমানে তার প্রতি মাসে আয় দেড় থেকে ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত। গত ১০ বছরে সফল এই ফ্রিল্যান্সার আয় করেছেন কয়েক কোটি টাকা।
বিজ্ঞাপন
![]()
নারী ফ্রিলান্সার প্রিয়াঙ্কা গাইন ঢাকা মেইলকে বলেন, তার স্বামী মোহন কুন্ডু আগে থেকেই ফ্রিল্যান্সিং করতেন। তবে এ কাজে তেমন আগ্রহ ছিল না তার। কিন্তু স্বামীর অনুরোধে ফ্রিল্যান্সিংয়ে আগ্রহী হন প্রিয়াঙ্কা। একপর্যায়ে ২০১৩ সালের দিকে স্বামীর থেকে ডিজিটাল মার্কেটিং শিখে ফ্রিল্যান্সিং শুরু করেন। সে সময় পরিবারের নানা কাজ সামলে ফ্রিল্যান্সিংয়ের সময় বের করা ছিল খুব কঠিন, তবে হাল ছাড়েননি। স্বামী নিজেই তার প্রশিক্ষক হওয়ায় এবং পরিবারের সকলের সহযোগিতা থাকায় এগিয়ে যেতে থাকেন। তার ক্যারিয়ারের যাত্রা শুরু হয় মাত্র ৭ ডলারের একটি কাজ দিয়ে। এখন তিনি প্রতি মাসে আয় করছেন প্রায় ৮ লাখ টাকা। যদিও কোনো মাসে কম আবার কোনো মাসে বেশিও আয় করেন।
তিনি আরও বলেন, শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ফ্রিল্যান্সিং থেকে তার মোট আয়ের পরিমাণ ৩ কোটির কাছাকাছি। নিজের আয় দিয়ে ইতোমধ্যে ৪৫ লাখ টাকা ব্যয়ে কিনেছেন একটি শখের গাড়ি। জমি কিনে সেখানে তৈরি করছেন বাড়ি। ফ্রিল্যান্সিংয়ে অবদান রাখায় ‘টপউইমেন ফ্রিল্যান্সার’ হিসেবে ‘ন্যাশনাল টেক অ্যাওয়ার্ড ২০২৩’, খুলনা বিভাগ থেকে ‘টপউইমেন ফ্রিল্যান্সার’ অ্যাওয়ার্ড ও নড়াইল জেলার সেরা নারী ফ্রিল্যান্সার সম্মাননা পেয়েছেন তিনি। ভবিষ্যতে নিজ জেলার ফ্রিল্যান্সিংয়ে আগ্রহীদের নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা রয়েছে তার।
আর এক সফল ফ্রিল্যান্সার সাদ্দাম হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, সফল হওয়ার গল্পটা তার মোটেও সহজ ছিল না। সংসার চালাতে এক সময় কাজের সন্ধানে দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটেছেন তিনি। ওই সময় কোনো উপায়ন্ত না পেয়ে শুরু করে সেলস রিপ্রেজেন্টেটিভ বা এস আর এর চাকরি। এরপর করেছেন সিকিউরিটি গার্ডের চাকরি। সামান্য বেতন থাকায় এসব চাকরি ছেড়ে শুরু করেন রাজমিস্ত্রির কাজ। রাজমিস্ত্রি হিসেবে যে পারিশ্রমিক পেতেন তাই দিয়ে সংসার চালাতেন।
![]()
তিনি আরও বলেন, রাজমিস্ত্রির কাজ করতে গিয়ে একটি মাধ্যমে জানতে পারেন অনলাইনে কাজের খবর। রাজমিস্ত্রি কাজের ফাঁকে ধীরে ধীরে ঝুঁকে পড়েন অনলাইন প্লাটফর্মে। অল্পদিনের ব্যবধানে হয়ে ওঠেন সফল ফ্রিল্যান্সার। সেই থেকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি সাদ্দাম হোসেনকেও। বর্তমানে তার আয় প্রতি মাসে ২ থেকে ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত। এক মাসে সবোর্চ্চ ১৮ লাখ টাকা পর্যন্ত ইনকাম করেছেন তিনি। এই কাজ করে কয়েক বছরে আয় করেছেন অন্তত ৪ কোটি টাকা। সেই টাকা দিয়ে নড়াইল পৌর এলাকার গারুচোরায় জমি কিনে করেছেন বাড়ি। এছাড়া বাজারে মার্কেট করার জন্য কিনেছেন জমি।
নড়াইল ফ্রিল্যান্সার অ্যাসোসিয়েশন সূত্রে জানা গেছে, এই কাজ করে সফল হয়েছেন জেলার কয়েক শত শিক্ষিত বেকার যুবক-যুবতী। এর মধ্যে অন্তত অর্ধশতাধিক নারী-পুরুষ হয়েছেন কোটিপতি। আর বেকারত্ব ঘুচিয়েছেন জেলার অন্তত দেড় হাজার বেকার নারী-পুরুষ। এই ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে আমেরিকা, কানাডা, যুক্তরাজ্য, ইটালিসহ বিভিন্ন দেশ থেকে প্রতিমাসে নড়াইলে রেমিটেন্স আসছে অন্তত ১৫ কোটি টাকা।
ফ্রিল্যান্সিংয়ে আয়ের পাশাপাশি এই বিষয়ে নিয়মিত ক্লাস নেন কয়েকজন সফল ফ্রিল্যান্সার। সরাসরি ও অনলাইনে ক্লাস করেন আগ্রহী সব শিক্ষার্থীরা। শুধু চাকরির ওপর নির্ভরশীল না হয়ে হতাশাগ্রস্থ জীবন থেকে বেরিয়ে এসে তরুণ প্রজন্মকে অনলাইনভিত্তিক কাজ করার আহ্বান জানান সফল এই ফ্রিল্যান্সাররা।
নড়াইল শহরের পুরাতন বাজার এলাকার ফ্রিল্যান্সার মো. মাসুম বিল্লাহ ঢাকা মেইলকে বলেন, বর্তমানে নড়াইল শহর থেকে শুরু করে গ্রাম গঞ্জের প্রতিটা পাড়া মহল্লার শিক্ষিত মানুষ এই পেশার সঙ্গে জড়িত হচ্ছে। নতুন যারা এই কাজে আগ্রহী তাদের জন্য জেলায় বেশ কয়েকটি প্রশিক্ষণ সেন্টার রয়েছে, যেখানে অফলাইনে এবং অনলাইনে অভিজ্ঞ প্রশিক্ষকরা প্রশিক্ষণ দেন।
সফল ফ্রিল্যান্সার ও প্রশিক্ষক হাবীব ওয়ায়েদ ঢাকা মেইলকে বলেন, ফ্রিল্যান্সার হতে হলে প্রথমে যে জিনিসটি লাগবে সেটি হল ধৈর্য্য। কারণ ফ্রিল্যান্সিং যারা শুরু করে তাদের প্রথম অবস্থায় কাজ শিখতে এবং কাজ পেতে একটু সময় লাগে। যদি ধৈর্য্য ধারণ করা যায় তা হলে সফল হওয়া যায়।
![]()
আর এক প্রশিক্ষক মো. সুমন ঢাকা মেইলকে বলেন, এই কাজ শিখতে হলে ইংরেজিতে একটু বেশি দক্ষতা থাকতে হবে। যে যত তাড়াতাড়ি ইংরেজিটা আয়ত্তে আনতে পারবে তার জন্য কাজটা তত সহজ হবে।
নড়াইল শহরের ভাদুলিডাঙ্গা এলাকার ফ্রিল্যান্সার মোহন কুন্ডু ঢাকা মেইলকে বলেন, পড়াশোনা করে চাকরির জন্য বসে না থেকে ছাত্রজীবন থেকে ফ্রিল্যান্সারের কাজ করি। প্রথম অবস্থায় মাসে ১০-১৫ হাজার টাকা ইনকাম হতো। বর্তমানে মাসে এক থেকে দেড় লাখ টাকা ইনকাম হয়। কোনো কোনো মাসে ইনকাম ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা ছাড়িয়ে যায়। তার স্ত্রী প্রিয়াংকা কুন্ডু বলেন, স্বামীর সঙ্গে সেও একই কাজ করেন। এই কাজ করে কয়েক বছরে ৫-৬ কোটি টাকা ইনকাম করেছেন তারা। এই টাকা দিয়ে শহরে জমি কিনে বাড়ি করার পাশাপাশি ৪৫ লাখ টাকা দিয়ে প্রাইভেট কার কিনেছেন।
শুধু বেকার যুবক যুবতীরাই নয় অনেক চাকরিজীবীও এখন চাকরির পাশাপাশি ফ্রিল্যান্সিং করছেন। এমনি একজন ফ্রিল্যান্সার শিক্ষক মো. মনিরুজ্জামান। কথা হলে তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, শিক্ষকতার পাশাপাশি ২০১৬ সাল থেকে ফ্রিল্যান্সিং করছেন তিনি। বর্তমানে সে প্রতি মাসে ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করেন।
সমাজকর্মী কাজী হাফিজুর রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে দেশে রেমিটেন্স আসছে। সমাজে বেকারত্ব দূর হচ্ছে। যুব সমাজ কাজের মধ্যে থাকায় বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজ থেকে নিজেদের দূরে রাখতে পারছে। এটা একটি ইতিবাচক বিষয়। সমাজের বেকার ছেলেমেয়েদের সরকারি এবং বেসরকারিভাবে আরও বেশি বেশি প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করা গেলে আরও বেশি রেমিটেন্স আসবে বলে মনে করেন তিনি।
নড়াইল সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. সুজল কুমার বকসি ঢাকা মেইলকে বলেন, দীর্ঘদিন রাত জেগে কাজ করলে দিনের বেলা পর্যাপ্ত না ঘুমালে শরীরে নানা ধরনের রোগ বাসা বাধতে পারে। রাতে কাজ করলেও দিনের বেলা পর্যাপ্ত ঘুমানোর জন্য পরামর্শ দেন তিনি।
নড়াইল জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আশফাকুল হক চৌধুরী ঢাকা মেইলকে বলেন, নড়াইলের অনেক ছেলে মেয়ে ঘরে বসে অনলাইনে কাজ করে বিদেশ থেকে রেমিটেন্স ইনকাম করছে। সরকারি চাকরিজীবীদের থেকে অনেকে ঘরে বসে অনেক বেশি টাকা ইনকাম করছে। এতে সমাজের বেকারত্ব দূর হচ্ছে। প্রতিটা পরিবারে স্বচ্ছলতা বাড়ছে।
তিনি আরও শিক্ষিত ছেলে মেয়েদের কম্পিউটরসহ অনলাইনে দক্ষ করে তোলার জন্য সরকারি ও বেসরকারিভাবে বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। বেশ কয়েকটি প্রকল্পের মাধ্যমে বেকার তরুণ-তরুণীদের কম্পিউটার, ল্যাপটপ ফ্রি দেওয়া হচ্ছে, ফলে আরও বেকারত্ব দূর হবে। আগামীতে আরও বেশি রেমিটেন্স আসবে বলে মনে করেন তিনি।
প্রতিনিধি/এসএস

