অজপাড়াগাঁয়ে উঁচু দেয়াল ও কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘেরা একটি বাড়ির চারপাশ। ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর উপজেলার এলাঙ্গী ইউনিয়নের এলাঙ্গী গ্রামে কমপক্ষে ৪০ বিঘার ওপর বিশাল বাংলো বাড়িটি। এত সর্বাধুনিক, এত বিশাল এলাকাজুড়ে বাড়ি জেলায় আর একটিও নেই। বাড়িটির মালিক কলকাতায় নৃশংসভাবে খুন হওয়া সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যার ‘মাস্টারমাইন্ড’ আক্তারুজ্জামান শাহীনের।
বাড়িটির ভেতর ঢুকলেই গা ছমছটম করবে যে কারো। একটি মাত্র ইন-আউট গেট। মানুষ খেকো হিংস্র তিনটি জার্মান শেফার্ড কুকুর রয়েছে এই বাড়িতে। যারা অপরিচিত কাউকে দেখলেই ঘেউ ঘেউ করেই চলে অনবরত। আলিশান বাংলোতে ডুপ্লেক্স বাড়ি, ব্যায়ামগার, সুইমিংপুল, গলফ খেলার মাঠসহ রয়েছে শতাধিক সিসি ক্যামেরা।
বিজ্ঞাপন
বাড়িতে ঢুকতেই চোখে পড়ে পথের দু-ধারে আম ও বাহারি ফুল গাছ। পাশেই রয়েছে একটি বিশালাকার সুইমিংপুল ও বিরাট এক পুকুর। পাশের ভবনে নিচের তলায় রয়েছে ব্যায়ামাগার, খাবারের জায়গা। দ্বিতীয় তলায় রয়েছে রাত্রিযাপনের ব্যবস্থা। দুটি ভবনে শীতাতাপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র (এসি) রয়েছে বেশ কয়েকটি। কর্মচারীদের থাকার জন্য রয়েছে আলাদা কোয়ার্টার। বারবিকিউ পার্টির জন্য রয়েছে আলাদা ব্যবস্থা।
আক্তারুজ্জামান শাহীন সম্পর্কে জানা যায়, কোটচাঁদপুর উপজেলার এলাঙ্গী গ্রামের আসাদুজ্জামান কাটুর পাঁচ সন্তানের মধ্যে চতুর্থ আক্তারুজ্জামান শাহীন। ১৯৮৫ সালে কোটচাঁদপুর পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও কোটচাঁদপুর কলেজ থেকে ১৯৮৭ সালে এইচএসসি পাস করেন। এক বছর বিরতি থেকে চট্টগ্রাম মেরিন একাডেমি থেকে দুই বছরের কোর্স করেন, সেখান থেকেই জাহাজের ক্যাপটেন হিসেবে চাকরিতে যোগদান করেন। চাকরির দুই বছর পর সিঙ্গাপুর থেকে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর আমেরিকার (ওপি টিকিট) ফ্রি ভিসা পাওয়ার পর ১৯৯২-৯৩ সালের দিকে আমেরিকা যান। তিনি মার্কিন নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। জাহাজে চাকরি করার সময়কালেই তিনি ঢাকায় বিয়ে করেন। শাহীনের স্ত্রীর নাম কনক ইসলাম। তাদের সংসারে এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। তারা মা-বাবার সঙ্গে আমেরিকায় থাকেন।
আরও জানা যায়, আগে থেকেই তাদের পরিবারে কোনো অভাব ছিল না। তারপরও ছোট থেকেই অর্থ উপার্জন করতেন শাহীন। ২০১৭ সালে দেশে এসে এলাঙ্গী মাঠে বাংলো বাড়ির ওই জায়গাতে ইটের ভাটা করেন। তিন বছর ধরে ইটভাটার ব্যবসায় লোকসান হওয়ায় ভাটা বন্ধ করে দেন। এরপর ২০২১ সলে এসে শুরু করেন বাংলো বাড়ির কাজ। বাবার দেওয়া ও নিজের কেনা ৪০ বিঘার ওপর ২০২২ সালের শেষের দিকে বাংলো বাড়ি নির্মাণকাজ শেষ করেন। ২০২৩ সালে বাংলো বাড়ির উদ্বোধন করেন। তারপর থেকে শুরু হয় নামিদামি ব্যক্তিদের ওই বাংলোয় আসা-যাওয়া।
বিজ্ঞাপন
কোটচাঁদুপর এলাঙ্গী গ্রামের কালু খান বলেন, বাংলোর পাশেই চাষের জমিটা আমার। আগে সেখানে ইটের ভাটা ছিল। দুই বছর হলো এই বাড়িটি করেছে। তারপর থেকেই শাহীন মিয়া এখানে মাঝে মধ্যে আসেন। কিন্তু গ্রামে বা আশপাশের মানুষের সাথে কখনো খারাপ ব্যবহার কিংবা ক্ষতি করেনি। উল্টো গ্রামের কেউ বিপদে পড়ে তার কাছে গেলে অর্থ দিয়ে উপকার করেছেন।
বাড়ির নিরাপত্তা কর্মী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, এখানে কারা আসা-যাওয়া করে সেটা বলতে পারব না। তবে দিনের বেলায় তেমন কেউ আসতেন না। আর যখন আসে অনেক গাড়ি একসাথে আসে। আমি তো কাউকে চিনি না, যার কারণে বলতে পারব না যে, কারা কারা এখানে আসা-যাওয়া করেন। এখানে আমি গেট পাহারা দিই, কুকুরকে খেতে দিই এবং তাদের দেখাশোনা করি।
এলাঙ্গী গ্রামের সাইদুর রহমান বলেন, আমরা শাহীন মিয়ার খুবই কম দেখেছি। এখানে বাংলো বাড়ি করার পর গাড়িতে করে মাঝে মধ্যে এখানে আসেন, তাই দেখি। শাহীন মিয়ার খাবাপ কিছু দেখিনি। তবে এখন যেটা শুনছি সেটা আমরা কখনো কল্পনাও করতে পারিনি। এই বাগান বাড়িতে বড় বড় দামি গাড়ি আসতে দেখেছি।
এলাঙ্গী ওয়ার্ডের সাবেক ইউপি সদস্য আমিনুর রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, শাহীনরা অনেক আগে থেকেই বড়লোক। শাহীনের বাবার অনেক জায়গা জমি ছিল। তবে শাহীন অনেক দিন ধরে আমেরিকায় থাকেন। এখানে বাংলো বাড়ি করার পর মাঝে মধ্যে আসতে দেখেছি। তবে ওই বাগান বাড়িতে রাতে কী হতো না হতো আমরা কিছুই জানি না। গ্রামের কেউ ওই বাগান বাড়িতে ঢুকতে পারে না। আমরাও কখনো জানতে চাইনি যে ওই বাড়ির মধ্যে কী আছে না আছে।
আক্তারুজ্জামান শাহীনের বড় ভাই ও কোটচাঁদপুর পৌর মেয়র সহিদুজ্জামান সেলিম ঢাকা মেইলকে বলেন, এমপি আনারুল আজীম আনারের মেয়ে ডরিন খুবই ছোট মানুষ। তার বাবা মারা গেছে, সে কারণে তার অনেক কষ্ট। আমার বাবা হারালে আমিও ডরিনের থেকে বেশি বলতাম। তবে একটি গোয়েন্দা সংস্থার হাতে এই কেসটি রয়েছে। বিষয়টি তদন্ত চলছে। এ কারণে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাচ্ছি না। গোয়েন্দা বিভাগের তদন্তেই বেরিয়ে আসবে কে জড়িত বা জড়িত না।

এমপি কন্যা ডরিন মেয়রের গ্রেফতার দাবি করেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ডরিন বলবে বলেই পুলিশ আমাকে আটক করবে, বিষয়টি এমন নয়। তারাও বিষয়টি তদন্ত প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যদি মনে করে আমাকে আটক করবে তাতে আমার কোনো আপত্তি নেই।
সেলিম আরও বলেন, শাহীন আমার ভাই, কিন্তু পারিবারিকভাবে অনেক আগে থেকেই সে কোনো যোগাযোগ করত না। তবে শাহীন যদি এই হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত থাকে তাহলে অবশ্যই আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বা গোয়েন্দা বিভাগ এটাকে তদন্ত করছে, তাদের তদন্তে যদি আমার ভাই দোষী হয় বা অভিযোগ প্রমাণিত হয় তাহলে অবশ্যই দেশের প্রচলিত আইনে যে বিচার হয় আমরা মেনে নেব।
মেয়র বলেন, শাহীন আমেরিকায় থাকাকালীন দেশে খুব কমই আসত। যাই আসত ঢাকাতে তার ভাড়া বাড়িতে থাকত। এরপর ২০১৭ সালের দিকে মাঠের মধ্যে বাবা আমবাগান করেছিলেন, সে সেই আমবাগান মেরে দিয়ে ইটের ভাটা করল। তিন বছর ভাটা চালিয়ে লোকসান হওয়ায় ভাটা বন্ধ করে দিয়ে ওইখানে এই বাড়িটা করেছে। সেখানে আমাদের সবার জমি ছিল। বাবা আমাদের শহর থেকে জমি দিয়েছে, সেই জমির মূল্য অনুযায়ী মাঠ থেকে শাহীনকে দিয়েছে। এতে আমাদের মাঝে কোনো ঝামেলা নেই। মাঠের মধ্যে বাড়ি করার পর আমিও ওখানে কয়েকবার গিয়েছি।
প্রতিনিধি/জেবি